গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পদার্থবিদেরা বলেন, এ জগতের সৃষ্টি এক মহাবিস্ফোরণের ফলে। তার ইংরেজি নাম ‘বিগ ব্যাং’। প্রায় ২০০০ কোটি বছর আগে ঘটেছিল এই বিস্ফোরণ। টেলিস্কোপ লাগিয়ে দূরের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকান, দেখবেন সেগুলো আরও দূরে চলে যাচ্ছে। এ হল সেই বিস্ফোরণের রেশ। কোথায় ছিল এর কেন্দ্রবিন্দু? এগরা? বজবজ? মালদহ? সে তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। সত্যি কি একটাই বিস্ফোরণ হয়েছিল? একাধিক বিস্ফোরণকে একটা মহাবিস্ফোরণ বলে চালিয়ে দিলে অঙ্কটা সহজ হয়। তা ছাড়া এর পিছনে প্রশাসনের চাপও থেকে থাকতে পারে।
এগরা বিস্ফোরণের পরে চোখের সামনে দেখলাম এক নতুন বাংলাকে জন্ম নিতে। ‘বিগ ব্যাং’ না দেখার দুঃখ ঘুচে গেল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, এই বাংলায় কোনও বেআইনি বাজির কারখানা থাকবে না। রাজ্যের মানুষ ৭১ লক্ষ ২৫ হাজার চাকরি পাওয়ার পরে কোন মা আর কোন ঝি যাবে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে? থানার দারোগাকে সতর্ক করা হয়েছে। বেআইনি বাজি কারখানার হদিস পেলেই তিনি এফআইআর দায়ের করবেন। দু’বার বলতে হবে না। পেয়াদা এসে পাকড়ে নিয়ে যাবে কারখানার মালিককে। লোকাল রিপোর্টার ছবি তোলার সময়টুকু পেলে হয়!
অনেক পাঠক-পাঠিকার কাছে ‘বিগ ব্যাং’ যা, এগরাও তাই। শোনা কথা। আমার কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের। বছর পাঁচেক আগে বারুইপুরে গিয়েছি মিটিং করতে। এক বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল আমাদের চারতলা পাকা বাড়ি। আমি ভাবলাম, আমরাই আক্রমণের লক্ষ্য। কিন্তু না। দ্বিতীয় কোনও বিস্ফোরণ হল না। শুনলাম কাছেই বাজির কারখানা। সেখানে আগুন লেগেছে। পরে দেখলাম, মিটিং হল থেকে কারখানার দূরত্ব ২০০-৩০০ গজ হবে। ঠিক করতে পারলাম না কার উপর বেশি রাগ করব, দায়িত্বজ্ঞানহীন কারখানার মালিকের উপর, উদাসীন প্রশাসনের উপর, না কি মিটিংয়ের উদ্যোক্তাদের উপর? তোমরা কোনও রকমে টিকে আছ। ভাল। কলকেতার বাবুদের টেনে আনো কেন?
‘‘কাছেই বাজি কারখানা। এখানে মিটিং করিবেন না,’’— একটা নোটিস টাঙিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সে পথে হাঁটেননি। তিনি ঠিক করেছেন, ইচ্ছুকদের জমি অধিগ্রহণ করে জেলায় জেলায় ক্লাস্টার তৈরি করবেন। বাজির কারখানা শুধু সেই ক্লাস্টারেই করা যাবে। সোমবার ফায়ার ব্রিগেড এসে দেখে যাবে সব ঠিক আছে কি না। মঙ্গলবার আসবে এক্সপ্লোসিভ দফতর। বুধবার পরিবেশ দফতর এসে দোদোমার ডেসিবেল চেক করবে। মিনিমাম ওয়েজ ইনস্পেক্টর? তাঁকে আবার কেন? তিনি যেমন ভোটার লিস্ট তৈরি করছেন, তা-ই করবেন।
একসঙ্গে সব আইন মানলে বাজির দাম বেড়ে যাবে না? নিশ্চয়ই। কিন্তু কম দামে বাজি বিক্রি করে রসিদ দেখালে রাজ্য সরকার ভর্তুকি দেবে। প্রয়োজন হলে সরকার একটা সাপোর্ট প্রাইসে বাজি কিনে নেবে। এই পদক্ষেপ ব্যয়সাপেক্ষ হবে ঠিকই, কিন্তু জনপ্রিয় হবে। কে জানে, হয়তো সরকারি কর্মচারীর উপর চাপ আসবে ডিএ আন্দোলন গুটিয়ে নিতে!
এগরাকাণ্ডের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। অন্তত ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে আহত। তাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। হয়তো ভাবলেন, সুপ্তিময় বাঙালিও এতটা সহ্য করবে না। তবে ‘আমি কিছু জানতাম না’ কথাটা না বললেই পারতেন। ওঁর কথায় মনে হল, কোথাও যেন প্রশাসনিক ব্যর্থতাও ছিল। পুলিশের বোধহয় জানা উচিত ছিল, ওখানে এত বড় একটা কারখানা রমরমিয়ে চলছে। আগেও দেখেছি উনি পুলিশ-প্রশাসনকে ছেড়ে কথা বলেন না। রামনবমীর মিছিল নিয়ে হাওড়ার কাজিপাড়ায় অশান্তি হল। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, পারমিশন দেওয়া উচিত হয়নি। পুলিশ ভয় পেয়ে অ্যাকশন নেয়নি। কাউকে রেয়াত করা হবে না। ঠিকই তো। প্রশাসনের সমালোচনা করাই উচিত। কিন্তু এগরার পুলিশ কেমন ওড়িশা গিয়ে কারখানার মালিককে ধরে ফেলল? মেদিনীপুর জেলা এককালে সুবা ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। তাই হয়তো কাজটা সহজ হয়েছে। তা-ও মনে হয় পুলিশের কিছুটা প্রশংসাও প্রাপ্য ছিল।
প্রকাশ্যে পুলিশ-প্রশাসনের সমালোচনা করেও মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দলের সমালোচনা করেন না। হোয়াট্সঅ্যাপের সেই গল্প মনে পড়ে যায়। এক গৃহস্থ তার স্ত্রীর প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে ঠিক করলেন নিজের বহুকষ্টে সংগ্রহ করা বোতলগুলো ভেঙে ফেলবেন। ‘‘তোর জন্য আমি দুটো পয়সা বাড়ি আনতে পারিনি।’’ ‘‘তোর জন্য আমি ছেলেকে টিউশন পড়াতে পারিনি।’’ ‘‘তোর জন্য আমার গৃহিণীর সঠিক চিকিৎসা হয়নি।’’— এই না বলে তিনটে বোতল ভেঙে দেখেন চতুর্থটি ভর্তি। মুহূর্তে নিজেকে সামলে বলেন, ‘‘তোকে ভাঙব কেন রে? তুই তো আমার কোনও ক্ষতি করিসনি!’’ খাগরাগড় থেকে এগরা— মুখ্যমন্ত্রী দেখছেন, দল কখনওই কোনও অপরাধে যুক্ত থাকছে না। তাই বুঝতে পারছেন, দলকে তিরস্কার করা অনুচিত হবে। মাঝেমধ্যে বার করছেন, আবার যত্নে সাজিয়ে রাখছেন আলমারিতে।
ফলস্বরূপ আমরা কী দেখছি? ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি রাজ্যে বাজি কারখানায় আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৬ জনের (এখানে কো-মরবিডিটি চলে না)। পঙ্গু হয়েছেন ৩৬ জন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট হয়েছে। গ্রিন ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। বহু বোতল ভাঙা হয়েছে। সেই বোতলটা রাখা আছে। আত্মবিশ্লেষণের সময় কিন্তু আগত। কারণ ক্লাস্টারে আগুন লাগলে ক্ষয়ক্ষতি ভয়ঙ্কর হবে। আশপাশে জমির দাম পড়ে যাবে। জমি মাফিয়া হতাশ হয়ে রাজ্য ছাড়বে। আপাতত যাঁরা নানা কারণে রাজ্যছাড়া, তাঁরা ফিরে এসে দেখবেন বালির দাম এত কম যে, পড়তা হচ্ছে না।
অভিজ্ঞ পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, উপরে ‘ফলস্বরূপ’ কথাটা আমি পরীক্ষামূলক ভাবে বসিয়েছি। আপনাদের মতামত পাবার আশায়। না হলে কোন ক্রিয়ার কী ফল তা শুধু পুরুষোত্তমই বোঝেন। অনেকটাই হয়তো আমাদের আগের জন্মের কুকর্মের ফল। তার দায়িত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে আমরা দ্বিধা করি না। বিজেপির শিক্ষানীতি মেনে নিয়ে রাজ্য সরকার চার বছরের অনার্স কোর্স চালু করছে। কিন্তু ভগবদ্গীতা কি স্কুলের সিলেবাসে এসেছে? মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া কিন্তু কাজের কাজ হবে না।
বাজির কারখানাগুলি বেআইনি হতে পারে, কিন্তু তারা সামাজিক দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন। নির্বাচন কাছে এলে এই দায়িত্ববোধ বেড়ে যায় বই কি! যার যেমন সাধ্য তারা চেষ্টা করে রাজনৈতিক দলগুলিকে সাহায্য করতে। বাজির উৎপাদন বন্ধ রেখে তখন বোমা তৈরিতে সময় দিতে হয় বেশি। কাঁচামাল মজুত করতেও হয় বেশি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেরি নেই। এগরায় কি তারই প্রস্তুতি পর্ব চলছিল? সে যাই হোক। তদন্তের ভার যখন সিআইডির হাতে তখন সত্য উদ্ঘাটিত হবেই। সেই আশায় আমরা বুক বেঁধেছি।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy