Advertisement
E-Paper

সবার জন্য আরও সুযোগ

স্কটল্যান্ডের ক্রিকেটার হোক বা কানাডার, ভাল খেললে কোনও না কোনও লিগের স্কাউটের চোখে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার জন্য ঠিক দেশে জন্মাতে হয় না আর।

বর্ণাঢ্য: আইপিএল-এ চেন্নাই সুপার কিংস এবং দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-এর টি২০ ম্যাচে চিয়ারলিডারদের উপস্থিতি, নয়াদিল্লি, ২০১০।

বর্ণাঢ্য: আইপিএল-এ চেন্নাই সুপার কিংস এবং দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-এর টি২০ ম্যাচে চিয়ারলিডারদের উপস্থিতি, নয়াদিল্লি, ২০১০। —ফাইল চিত্র।

অভিষেক মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:১২
Share
Save

কী ভিড় সে দিন খেলার মাঠে! সব টিকিট শেষ। তাবড় ক্রিকেটারদের সমাগম, রঙিন পোশাক পরে নামবেন তাঁরা। দু’দলের মালিকরাও থাকবেন অবশ্য। অগাধ সম্পত্তি তাঁদের, ব্যক্তিগত ক্রিকেট দলে মাইনে দিয়ে সেরা ক্রিকেটারদের রাখার ক্ষমতা আছে। ক্রিকেট তো শুধু খেলা নয়, রীতিমতো বিনোদনের প্যাকেজ। মাঠের ভিতরে (কিন্তু খেলার সীমানার বাইরে) তাই গানবাজনার আয়োজনও আছে। আর আছে খেলা নিয়ে হরেক রকমের বাজি ধরা— বিপুল অঙ্কের।

বর্ণনাটা আইপিএলের নয়, তার আড়াইশো বছর আগের কথা এ সব। আদি যুগের ক্রিকেটের সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য নেই আইপিএলের। পর দিন খবরের কাগজে রান-উইকেট ছাপিয়ে থাকত বাজি জেতা-হারার খতিয়ান। সাদা পোশাক? জুটবে কোত্থেকে? শীতের দেশ ইংল্যান্ড, ওই ঠান্ডায় সাদা জামা কাচবে কে? যে যা পারত পরে নামত। টেস্ট ক্রিকেট? সে তো সে দিনের ছোকরা, দেড়শো বছরও বয়স হয়নি তার। আজকের রক্ষণশীলরা আইপিএল দেখে যতই ‘গেল গেল’ রব তুলুন, ইতিহাস সাক্ষী যে, একদম শুরুতে পেশাদার ক্রিকেট আইপিএলের মতোই ছিল। পুরো খেলাটাই চলত টাকার জোরে।

এই টাকা জিনিসটা বরাবরই সমস্যার। শুনি, আজকাল নাকি সবাই টাকার জন্য খেলেন, ভালবেসে খেলার ব্যাপারটা উঠেই গেছে। ফেলে আসা কোনও এক রহস্যময় স্বর্ণযুগে নাকি টাকার কথা ভাবতেনই না কেউ। ঘটনা হল, ক্রিকেটাররা বরাবর টাকার জন্য খেলতেন। আর খেলবেন না-ই বা কেন? অভাব কেউই চান না। ক্রিকেট খেলে অভাব কাটানোর চেষ্টা স্বাভাবিক ভাবেই করতেন সবাই। স্বাধীনতার আগে এ দেশে রাজরাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলত খেলা। পাটিয়ালা থেকে কোচবিহার, নাটোর থেকে কাশ্মীর, সবাই টাকা ঢালতেন ক্রিকেটের পিছনে। ব্যক্তিগত দলে খেলানোর জন্য ভাড়া করে আনতেন তাবড় ক্রিকেটারদের। মইন-উদ-দৌলা গোল্ডকাপে পাটিয়ালা-ভিজ়িয়ানগরের রেষারেষি ছিল দেখার মতো। বিদেশি খেলোয়াড়ও থাকতেন প্রচুর— আইপিএলের মতোই। ব্র্যাডম্যানকে আনতে না পেরে হবস আর সাটক্লিফের মতো কিংবদন্তি ওপেনারদের এনেছিলেন ভিজ়িয়ানগরের মহারাজকুমার। তফাত অবশ্য ছিল একটা। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে মুকেশ অম্বানী বা কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে শাহরুখ খান খেলতে নামার চেষ্টা করেননি কখনও। রাজারা কিন্তু করতেন এটা। সবাই তো আর রঞ্জি-পটৌদি ছিলেন না, তাই ব্যাপারটা কখনও-কখনও হাস্যকর হয়ে উঠত।

ইংল্যান্ডেও দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটসমাজ। ভারতীয় রাজাদের মতোই সেখানেও স্রেফ টাকার জোরে ক্রিকেট খেলার জন্মগত অধিকার থাকত মানুষের। খেলে যাঁরা রোজগার করতেন, তাঁদের বলা হত প্লেয়ার বা প্রফেশনাল। আর যাঁরা টাকাপয়সা নিতেন না, তাঁরা জেন্টলম্যান বা অ্যামেচার। দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে এই শ্রেণিবিভাগ। একই দলে খেললেও ড্রেসিংরুম বা মাঠে ঢোকার গেট আলাদা হত অ্যামেচার আর প্রফেশনালদের। বেশির ভাগ দলের অধিনায়কও হতেন জেন্টলম্যানরাই। আর যে-হেতু টাকা আর ক্ষমতা ছিল তাঁদের কুক্ষিগত, মানুষের মাথায় ঢোকানো হল যে, খেলে রোজগার করলে তাঁদের সম্মান কম হওয়া উচিত। এই ধারণা এখনও চলছে।

তাতে অবশ্য খেলোয়াড়দের কিছু আসে-যায়নি। ইংল্যান্ডের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে খেললে রোজগার ভালই হত। বছরে ছ’মাস খেলার অভিজ্ঞতাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশ-বিদেশের মহাতারকাদের অনেকেই কাউন্টি খেললেও নিয়মিত ভাবে খেলা ভারতীয়দের সংখ্যা সেখানে নেহাতই হাতেগোনা। বেশির ভাগই খেলেছেন মেরেকেটে দু’-এক বছর। তবে টাকার জন্য ইংল্যান্ডের ক্লাবে খেলতেন অনেকেই। ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার কথা ছিল ভারতের। আর সেই সময়ই হ্যাসলিংডেনে খেলার সুযোগ পান বিনু মাঁকড়। তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হলেও মাঁকড় নির্বাচক-সভাপতি সি কে নায়ডুকে প্রশ্ন করলেন, টেস্ট দলে তাঁর সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত তো? নায়ডু আশ্বাস না দেওয়ায় হ্যাসলিংডেনে যোগ দিলেন মাঁকড়— হ্যাঁ, টাকার জন্যই। প্রথম টেস্টে ভারত ধরাশায়ী হওয়ায় শেষে হ্যাসলিংডেনকে জরিমানা দিয়ে মাঁকড়কে ধার করে আনতে হয়।

দীর্ঘ দিন অবধি দেশের মাটিতে ভারত খেললে তা দেখাত দূরদর্শন। ১৯৯১-এ তিনটে এক দিনের ম্যাচ খেলতে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের বোর্ডের সর্বেসর্বা আলি বাখার চেয়েছিলেন দেশের মানুষ খেলা দেখুক। ক্রিকেট দেখিয়ে সেই প্রথম আয় বিসিসিআইয়ের। এর পর ক্রমশ রোজগার বাড়তে থাকে। মোটামুটি একই সময়ে দেশে ঘটল আর্থিক উদারীকরণ। কেবল টিভির হাত ধরে প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট। আর এই সময় কর্তৃপক্ষের মাথায় খেলে একটা ‘হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক’।

মধ্যবিত্ত বাড়িতে একটার বেশি টিভি সচরাচর থাকত না। সন্ধ্যাবেলা গোটা পরিবার জড়ো হত টিভির ঘরে। এই স্লটটাকেই ধরে ফেলল বিসিসিআই। রাতের আলোয় ওয়ান ডে ম্যাচের বিজ্ঞাপনের দাম হত আকাশছোঁয়া। মুক্ত অর্থনৈতিক বাজারে সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল অনেকের, বিশেষত ভারতীয় বাজারে ঢুকে পড়া বহুজাতীয় সংস্থাগুলোর। আর এই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিই নতুন লিগের প্রস্তাব নিয়ে বিসিসিআইয়ের কাছে উপস্থিত হলেন ললিত মোদী। আইপিএল বলতে আজ আমরা যা জানি, মোটামুটি তা-ই— শহরকেন্দ্রিক কয়েকটা দল, তাদের স্বত্ব বিক্রি করবে বিসিসিআই; দেশি-বিদেশি খেলোয়াড় মিলিয়ে তৈরি হবে দল। খেলা তো থাকবেই, তবে মূল উদ্দেশ্য হবে গ্ল্যামার আর বিনোদন। তবে খেলা হবে পঞ্চাশ ওভারের। টি২০ আবিষ্কার হয়নি তখনও।

এই প্রস্তাব খারিজ করে দিলেও ধীরে ধীরে বিশ্বক্রিকেটে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসতে শুরু করে বিসিসিআই। ২০০৭-এ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) নিয়ে এলেন জ়ি টিভির সুভাষ চন্দ্র। একদম এগারো বছর আগের মতোই প্ল্যান, শুধু টি২০। অগত্যা ধুলোটুলো ঝেড়ে ললিত মোদীর পুরনো ফাইল বার করল বিসিসিআই। নতুন টি২০ লিগের আগে নিলামে উঠবেন ক্রিকেটাররা। খেলা হবে ২০০৮-এর গরমের ছুটিতে। মাঠের ধারে থাকবে ডিজে, চিয়ারলিডারদের নাচ। আইপিএল ভারতজয় করল। ক্রিকেট দেখিয়ে এত দিন যা রোজগার হত বিসিসিআইয়ের, তার মাত্র দু’শতাংশ আসত ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে; বাকিটা আন্তর্জাতিক। ২০১৮ সালে টিভি স্বত্ব বিক্রির সময় আইপিএলের একার অবদান দেখা গেল ৭১%।

প্রথম বছর ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের বারণ ছিল, কিন্তু ২০০৯-এ বেঁকে বসলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা— আইপিএল খেলতে দিতেই হবে তাঁদের। একুশ দিনের জন্য পিটারসেন-ফ্লিন্টফদের ছাড়তে বাধ্য হল ইসিবি। ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি দেশগুলোও— আইপিএলের মতো লিগ চাই তাদেরও। এক-দেড় মাস জুড়ে ছ’-সাতটা দলের মধ্যে টি২০ খেলা বই তো নয়, এ আর কী এমন হাতিঘোড়া ব্যাপার? সমস্যা হল, ফর্মুলা হাতে পেলেও রোজগারের একটা উপাদান বাকি থেকে গেল সবার। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ আয়োজন করতে যা খরচ হয়, তা উসুল করে মুনাফা করতে লাগে সরাসরি সম্প্রচার। তার জন্য পর্দার সামনে চাই ভারতের এই বিপুল জনসংখ্যাকে। আর এই ভারতীয় ভক্তরা দেখতে চান শুধু নিজের দেশের তারকাদের। এখানেই মোক্ষম চাল চালল বিসিসিআই— অবসর নেওয়ার আগে অবধি ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিদেশি লিগে খেলার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করল।

কোনও লিগই তাই এঁটে উঠতে পারল না আইপিএলের সঙ্গে। গত বছর থেকে খেলার সংখ্যা কমাতে বাধ্য হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ। প্রায়ই খেলোয়াড়দের টাকা বাকি থাকে বাংলাদেশের লিগ বিপিএলে। উঠেই যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাজ়ান্সি সুপার লিগ। পরে যখন সে দেশে এসএ২০ শুরু হল ২০২৩-এ, ছ’টা দলের ছ’টাই কিনে নিল আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলো। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, আরবের আইএল২০, আমেরিকার মেজর লিগ ক্রিকেট— সর্বত্রই এখন আইপিএল দলের ছড়াছড়ি। লস অ্যাঞ্জেলেস বনাম টেক্সাস মানে কিন্তু ওই নাইট রাইডার্স বনাম সুপার কিংসই। একের পর এক তারকা যোগ দিচ্ছেন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ক্রিকেটে। দেশের জন্য খেলা এখনও গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিতে গেলে লিগে খেলা অনেক বেশি জরুরি। ক্লাব থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে অঞ্চল, অঞ্চল থেকে দেশের চিরাচরিত রাস্তাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। দেশের জন্য খেলার সুযোগ পেলে ভাল, কিন্তু না পেলেও ক্রিকেটজীবন শেষ নয় সেখানেই। খেলাটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে।

এতে কি সত্যিই ক্ষতি হচ্ছে খেলাটার? আন্তর্জাতিক খেলা মানে তো বারোটা দেশ, তার মধ্যেও সবার গুরুত্ব সমান নয়। এর ফলে যুগ যুগ ধরে জন্মসূত্রেই খানিকটা নির্ধারিত হয়ে যেত যে, কে বড় ক্রিকেটার হতে পারবেন, আর কে পারবেন না। আর এখন? স্কটল্যান্ডের ক্রিকেটার হোক বা কানাডার, ভাল খেললে কোনও না কোনও লিগের স্কাউটের চোখে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার জন্য ঠিক দেশে জন্মাতে হয় না আর। আর ভারতে তো প্রায় প্রত্যেক রাজ্যে এখন আলাদা আলাদা টি২০ লিগ, তার প্রত্যেকটার সরাসরি সম্প্রচার হয়।

যে খেলায় অনেকের ভাগ্যে কেরিয়ারের সিঁড়ি জুটত না, আইপিএল আর তার জাতভাইরা সেখানে লিফ্‌ট নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

IPL gambling

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}