Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
জাতিবিদ্বেষী ঘৃণা বজায় থাকলেই নেতাদের লাভ
Israel Palestine Conflict

অহিংসার পথে নয় কেন

ঘৃণা ইজ়রায়েলের দিক থেকেও কম নেই। আরব দেশগুলির প্রতি, বিশেষ করে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি, তাদের বহু দিনের ক্রোধ, অবিশ্বাস, ঘৃণা।

ধ্বস্ত: দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে অসামরিক এলাকায় ইজ়রায়েলি হানা। ২৫ অক্টোবর ২০২৩।

ধ্বস্ত: দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে অসামরিক এলাকায় ইজ়রায়েলি হানা। ২৫ অক্টোবর ২০২৩। ছবি: রয়টার্স।

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২২
Share: Save:

পশ্চিম এশিয়ায় হামাস ও ইজ়রায়েল-এর মধ্যে যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছে, তার মতো এত নৃশংস, এত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ওই অঞ্চলে আগে কখনও হয়নি। দু’দিকেই হাজার-হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন আরও বেশি। মৃত বা আহতদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ নাগরিক, যার বেশ কিছু নারী ও শিশু। এবং বেশির ভাগই প্যালেস্টাইনের নাগরিক। অনিবার্য প্রশ্ন: ইজ়রায়েলকে আক্রমণ করার আগে হামাস কি আন্দাজ করেনি যে, উল্টো দিক থেকে এর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া আসবে? হামাস কি জানত না যে, ইজ়রায়েলি বাহিনীর ধ্বংসশক্তি হামাস-এর তুলনায় অনেক অনেক বেশি?

আক্রমণের আগে হামাস যে এ সব ভাবেনি বা বুঝতে পারেনি, এমন নিশ্চয় নয়। যদি ধরে নিই, সব কিছু জেনে বুঝে, ঝুঁকি এবং লাভ-ক্ষতির তুল্যমূল্য বিচার করেই তারা যুদ্ধে নেমেছে, তা হলে এটাও ধরে নিতে হবে যে, নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের মৃত্যুগুলোও তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল। ইজ়রায়েলি সৈন্যবাহিনীর কাছে নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের মৃত্যু ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। কিন্তু, এই ক্ষতি কি হামাসের কাছেও কোল্যাটারাল ড্যামেজ নয়, যা তাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অপরিহার্য? হামাস তো জানত যে, যুদ্ধ শুরু হলে কিছু নিরীহ প্যালেস্টাইনি মারা যাবেন। তবু তারা যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তার মানে গোড়া থেকেই এই মৃত্যুগুলো তারা মেনে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইজ়রায়েলি বোমা গাজ়ার হাসপাতাল, স্কুল বা অন্যান্য অসামরিক লক্ষ্যে বর্ষিত হয়ে যত বেশি নিরীহ মানুষকে মারছে, ততই ইহুদিদের প্রতি প্যালেস্টাইনিদের ঘৃণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ইহুদিদের প্রতি প্যালেস্টাইনিদের ঘৃণা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত দৃঢ় হচ্ছে হামাস-এর অস্তিত্বের শিকড়। হামাস-এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলি প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণার উপরেই তো দাঁড়িয়ে থাকে।

ঘৃণা ইজ়রায়েলের দিক থেকেও কম নেই। আরব দেশগুলির প্রতি, বিশেষ করে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি, তাদের বহু দিনের ক্রোধ, অবিশ্বাস, ঘৃণা। সেই ঘৃণা বোধ হয় তুঙ্গে উঠেছে গাজ়ায়, প্যালেস্টাইনিদের অন্যতম বসতিতে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস এগোতে এগোতে ২০০৭ থেকে গাজ়ায় পাকাপাকি ভাবে প্রশাসনের ভার এসেছে হামাস-এর হাতে, যদিও বহু ব্যাপারে কর্তৃত্ব কার্যত ইজ়রায়েলের। ইহুদি প্রভুরা গাজ়ায় বসবাসকারী প্যালেস্টাইনিদের মানুষ মনে করে না, হামাসকে বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখে। তাই প্রশাসন হামাস-এর হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে গাজ়া ভূখণ্ড অবরোধ করে রেখেছে ইজ়রায়েল, যাতে সেখানে বেআইনি ভাবে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছতে না পারে। অবরোধের ফলে অস্ত্রশস্ত্রের প্রবেশ কতটা আটকানো গিয়েছে বলা শক্ত, তবে যে ন্যূনতম জিনিসগুলো বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন— খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধপত্র, বহির্জগতের সঙ্গে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিনিময়— গাজ়া ভূখণ্ডে তার তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাবে বেকারত্বের হার ৪৫% ছুঁয়েছে, দরিদ্র মানুষের অনুপাত ৫০%। প্রত্যুত্তরে হামাস জঙ্গিরা ইজ়রায়েলের দিকে বার বার রকেট ছুড়েছে। ইজ়রায়েলের সাধারণ নাগরিকদের অপহরণ করে হত্যা করেছে। ফলে পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে।

বলা প্রয়োজন, দোষ একা হামাস-এর নয়। প্যালেস্টাইনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, তাঁদের নিজস্ব রাষ্ট্রের দাবিকে যদিও নানা আন্তর্জাতিক মহল অনেক দিন স্বীকার করে নিয়েছে, বিভিন্ন অজুহাতে ইজ়রায়েল তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-এ ইহুদিরা তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে, ফলে সঙ্কুচিত হচ্ছে সেখানকার প্যালেস্টাইনিদের পরিসর। আর সবার উপরে গাজ়ার ২০ লক্ষ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেওয়ার ষোলো আনা দায় ইজ়রায়েলের। এ সবের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই করা দরকার। কিন্তু হামাস যে ভাবে লড়াই করছে, সেটা একাধিক কারণে সমর্থন করা শক্ত।

প্রথমত, হামাস এই লড়াই শুরু করার ফলে দু’পক্ষেই নিরীহ মানুষদের প্রাণ যাচ্ছে। এটা নৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অসহায় ইজ়রায়েলি নাগরিকদের অপহরণ ও হত্যা তো অতি জঘন্য অপরাধ। কিন্তু নৈতিকতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রণকৌশল হিসাবে দেখলেও হামাস-এর এই লড়াই ফলপ্রসূ হওয়া অসম্ভব। হামাস-এর তুলনায় ইজ়রায়েলের সামরিক শক্তি প্রশ্নাতীত ভাবে উন্নততর, তার উপরে আমেরিকাসমেত প্রায় সমস্ত পশ্চিমি শক্তি ইজ়রায়েলকে মদত দিচ্ছে। কাজেই পুরো আরব দুনিয়া এক হয়ে গিয়ে যদি হামাস-এর পাশে দাঁড়ায়, তা হলেও মনে হয় না সেই সম্মিলিত আরব শক্তি ইজ়রায়েলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে। তা হলে এই লড়াই চালিয়ে কার লাভ? আসলে, এই ধরনের লড়াই শুরু হলে দু’দিকের নেতাদেরই জনপ্রিয়তা বাড়ে, লাভটা তাঁদেরই। সেই নিরিখে হামাস-এর জঙ্গি নেতাদের যেমন রাজনৈতিক লাভ, তেমনই ইজ়রায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-রও লাভ কম নয়, বিশেষ করে যে-হেতু বছর দুয়েকের মধ্যে ইজ়রায়েলের সাধারণ নির্বাচন। ক্ষতি সাধারণ মানুষের, যাঁরা যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করছেন বা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসাবে মারা পড়ছেন।

গাজ়ার অত্যাচারিত প্যালেস্টাইনিদের কাছে অন্য কোনও রণকৌশল কি ছিল না? পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিবৈষম্যের ঘটনা এই প্রথম নয়, জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইও অনেক দিনের। কয়েক দশক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা অভূতপূর্ব বৈরের বিরুদ্ধে লড়াই করে সে দেশে বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়েছেন। সেই লড়াই যে সম্পূর্ণ ভাবে হিংসাহীন ছিল এমন নয়, কিন্তু তার মূল চালিকাশক্তি ছিল অহিংস অর্থনৈতিক অসহযোগ, বয়কট। বর্ণবৈষম্যবাদী রাষ্ট্রের জোর ছিল তার সামরিক শক্তি, আর দুর্বল জায়গা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের উপরে তার নির্ভরতা। আন্দোলনকারীরা অত্যাচারী রাষ্ট্রের জোরের জায়গাটা চ্যালেঞ্জ করতে যাননি, অসহযোগ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করতে পেরেছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁদের জয় হয়েছিল।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাট দশকে আমেরিকার ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’-এর দিকে তাকালে একই ছবি দেখতে পাব। ষাট দশক অবধি আমেরিকায়, বিশেষত তার দক্ষিণ অংশে, প্রবল বর্ণবৈষম্য ছিল। হোটেল-রেস্তরাঁ, এজমালি পরিবহণ, কারাগার, মিলিটারি, সরকারি স্কুল সবই ছিল বর্ণবৈষম্যে দ্বিখণ্ডিত। সাদাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় কালোদের প্রবেশাধিকার ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ষাট দশকের শেষ অবধি নানা অজুহাতে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট দিতে দেওয়া হত না। ভোট দিতে গেলে আলাদা করে তাঁদের সাক্ষরতার পরীক্ষা দিতে হত, যে পরীক্ষায় তাঁরা প্রায়শই পাশ করতে পারতেন না। ভোটার তালিকায় নাম ঢোকাতে গেলে ‘পোল ট্যাক্স’ দিতে হত। সেটা দেওয়া গরিব কৃষ্ণাঙ্গদের সাধ্যের বাইরে ছিল। কুখ্যাত ‘গ্র্যান্ডফাদার ক্লজ়’-এর দৌলতে যাঁর পিতামহ ভোট দিয়েছেন তাঁকে ‘পোল ট্যাক্স’ দিতে হত না, ফলে সাদাদের বেশির ভাগ পোল ট্যাক্স না দিয়েই ভোট দিতে পারতেন। কালোরা পারতেন না, কারণ এক সময় তাঁরা ক্রীতদাস ছিলেন, এবং সেই ‘ত্রুটি’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁদের বহন করতে হয়েছে। এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা মাঝে-মাঝে হিংসার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে নাগরিক সমানাধিকারের মূলস্রোত আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, অহিংস। এবং জয় সেই কারণেই এসেছিল। প্রবলপ্রতাপ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পেশিশক্তি প্রদর্শন করে কৃষ্ণাঙ্গরা বিশেষ কোথাও পৌঁছতে পারতেন বলে মনে হয় না।

স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতেও বর্ণবৈষম্যের একই চিত্র দেখা যাবে। সেই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ইতস্তত সশস্ত্র সংগ্রাম নিশ্চয় হয়েছিল, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে মূল লড়াইটা ছিল অহিংস, অসহযোগিতা-নির্ভর, শান্তিপূর্ণ। বস্তুত, অহিংসার মধ্যে যে বিপুল নৈতিক শক্তি আছে তাকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার কথা গান্ধীজি, শুধু ভারতবাসীকে নয়, সারা পৃথিবীকেই শিখিয়েছিলেন, তাই তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেই হবে।

ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলি থেকে প্যালেস্টাইনিরা কি শিখতে পারেন না? তাঁদের লড়াইটাও তো জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে।

অন্য বিষয়গুলি:

Israel Palestine Conflict Death palestine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy