অস্থির: তিস্তা শেতলবাদকে গ্রেফতার করার পর রাস্তায় প্রতিবাদীদের বিক্ষোভ, মুম্বই, ২৭ জুন। ছবি: রয়টার্স।
এ যেন আচমকা শিলাবৃষ্টি! অথবা যেন সাইরেন না বাজিয়েই ইউক্রেনের কোনও শহরের শিশু হাসপাতালে বর্ষিত হচ্ছে উচ্চশক্তিসম্পন্ন রুশ কামানের গোলা! কে বাঁচল, কে মরল, তাতে কী আসে যায়? শুধু ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের দাবিটিকে দমিয়ে দেওয়াই তো একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। রাশিয়ার নয়া জ়ার পুতিনের অস্তিত্বের প্রশ্নও বটে।
একই সমস্যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও। পুতিন বা মোদী, এঁরা নিছক রাষ্ট্রনেতা নন। এঁরা হলেন সেই শ্রেণির নেতা যাঁদের আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃৎ ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন ‘সুলতানবাদী’ বা ‘সুলটানিস্ট’। সুলতান তাঁর হাতের ছাপ রেখে যাবেন শুধু সরকার পরিচালনায় নয়, জীবনের সর্বত্র। তাই তো মোদীর শ্মশ্রু-আচ্ছাদিত মুখ আপনাকে লক্ষ করে সব জায়গা থেকে— ভ্যাকসিন শংসাপত্র, গ্যাস সিলিন্ডারের বিজ্ঞাপন, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, কোথায় নয়? এখন সুলতানকে বলতেও হয় না তিনি কী চান। ‘বান্দারা’ সব জানে। তারা বোঝে সব ইঙ্গিতের গূঢ়ার্থ।
তাঁর রাজ্য গুজরাতের দাঙ্গা ঘটেছিল বিশ বছর আগে। দাঙ্গায় মৃত্যু হয়েছিল সহস্রাধিক মানুষের, যাঁদের অধিকাংশই মুসলমান। এত দিন ধরে সেই নিহতদের বিপন্ন আত্মীয়স্বজনদের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের জন্য লড়েছেন সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকারের সেনানী তিস্তা শেতলবাদ। যত ভাবে তিস্তার বদনাম করা যায় সবই এত কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে গেছে মোদী প্রশাসন। কিন্তু এই বার প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে যেন বাজল, যাকে বলে কুকুরের হুইসল। তিস্তা নাকি ২০০২ সালের গুজরাত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘অপদস্থ’ করার এক ‘বিশাল ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত ছিলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা জেলবন্দি। জামিনের আবেদন আসতেই সরকারপক্ষ জানাল, ষড়যন্ত্রের মামলা তদন্তাধীন তাই আবেদন খারিজ। তবে নাকি জানা গেছে, আসামির সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ ছিল প্রয়াত কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেলের, যিনি ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীর নিকটতম সচিব। নয়া অভিযোগ, মোদীর ভাবচ্ছবি কর্দমলিপ্ত করবার জন্য নাকি পটেলের কাছ থেকে তিস্তা নিয়েছিলেন তিরিশ লক্ষ টাকা। এই সব কথার প্রতিবাদ শোনা গেছে শুধু কংগ্রেস দল থেকেই নয়, পটেলের পরিবার থেকেও। তবে তাতে কী আসে যায় সুলতানের? বরং এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, পটেল এবং সনিয়া গান্ধী তো অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ, ১০ জনপথ ঠিকানায় নতুন অভিযোগপত্র এল বলে।
ঠিক একই ভাবে মোদী প্রশাসন সমালোচকদের বিরুদ্ধে হারেরেরে বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নূপুর শর্মা মামলাকে কেন্দ্র করে। তদানীন্তন বিজেপি প্রতিনিধি নূপুরের কুরুচিজনক ইসলামবিরোধিতা ফাঁস হয়েছিল এক সত্য-যাচাই চ্যানেলের মাধ্যমে। তার জন্য শুধু ইসলামি দুনিয়াই ক্ষিপ্ত হয়নি; অবাক ও আহত হয়েছিলেন আমেরিকান ও পশ্চিম ইউরোপের গণতান্ত্রিক মানুষও। সাধারণ দেশনেতারা এর ফলে হয়তো বিব্রত হতেন। কিন্তু মোদী তো সাধারণ দেশনেতা নন। তিনি হলেন সুলতান। সেই ফ্যাক্ট চেকিং চ্যানেলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জ়ুবের সঙ্গে সঙ্গে হলেন জেলবন্দি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ধোপে টিকছিল না। টেকার কথাও নয়। কারণ, কোথাও অপরাধ ঘটলে তা করেছেন নূপুর, অথচ জেলে ঘুরে আসতে হল জ়ুবেরকে, যিনি ওই তথাকথিত অপরাধের প্রমাণ হাজির করেছেন। জ়ুবের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জামিন পেলেন ঠিকই, তবে মনে হয় দেশের উচ্চতম নেতৃত্ব বেশ শঙ্কিত ছিলেন তাঁকে নিয়ে, যদিও তাঁদের শঙ্কিত হওয়া উচিত ছিল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি ইত্যাদি নানাবিধ ‘হিন্দুত্ব-নিরপেক্ষ’ কারণে। সেই ২০১৮ সালে জ়ুবেরের করা এক টুইটের ‘অপরাধে’— তাও আবার আশির দশকের এক ফিল্ম পোস্টারকে কেন্দ্র করে তিনি অভিযুক্ত। নিত্যনতুন অভিযোগ জমা পড়ছে বিভিন্ন জেলা আদালতে। গাজিয়াবাদ, লখিমপুর খেরি, হাথরস— উত্তরপ্রদেশের অসংখ্য জেলা থেকে। সুপ্রিম কোর্টের দুই মহামান্য বিচারপতি, চন্দ্রচূড় ও বোপান্না বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এক পাপচক্র তৈরি হয়েছে নিত্যনতুন অভিযোগ তৈরি করে নাগরিককে আটক রাখতে। কৌঁসুলি বৃন্দা গ্রোভার আদালতকে অবহিত করেন যে, উত্তরপ্রদেশে জনসাধারণকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হচ্ছে, জ়ুবেরের বিরুদ্ধে এফআইআর করলে পুরস্কার দেওয়া হবে নগদ পনেরো হাজার টাকা।
মোদীর প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে (২০১৪-১৯) তিনি ছিলেন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ধুরন্ধর নেতা। বর্তমান দ্বিতীয় পর্বে তিনি ও তাঁর চেলারা বেপরোয়া। কখনও ক্লাসঘরে হিজাব পরা বন্ধ। কখনও লাউডস্পিকারে আজান বেআইনি। তা ছাড়া আরও অনেক কাণ্ড বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। যেমন, মিলিটারিতে মাত্র চার বছর মেয়াদে চাকরির জন্য ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প। শোনা যাচ্ছে, এর উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর বেতন ও পেনশনের বোঝা কমানো, কিন্তু এটা যদি সত্যি হত তবে শুরু হত সেনাবাহিনীর পেনশন নীতির খোলনলচে বদলের প্রক্রিয়া। তার কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু চার বছর বাদে দেশে অস্ত্র-ব্যবহারে প্রশিক্ষিত হাজারে হাজারে কর্মহীন যুবকের ঘুরে বেড়ানো কি এক ‘শুটজটাফ’ (এস-এস) নির্মাণের অশুভ সঙ্কেত বহনকারী নয়? এবং সত্যই যা যৌক্তিক ব্যাখ্যার অতীত, তা হল নূপুর শর্মাকে সমর্থন করার বদলা হিসেবে দুই তথাকথিত আতঙ্কবাদী হত্যা করল উদয়পুর শহরের এক হিন্দু দর্জিকে। হত্যাকারী পাকড়াও হলে শোনা গেল তারা এক পাক আতঙ্কবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অব্যবহিত পরে জানা গেল, মূল হত্যাকারী নাকি রাজস্থান বিজেপির সদস্য। ফোনে ফোনে ঘুরতে লাগল তার এবং রাজ্য বিজেপি মহারথীদের ছবি। এই নৃশংস হত্যার হিন্দু প্রতিক্রিয়া, যা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের স্বাভাবিক রীতি, তা কিন্তু দেখা গেল না। যেন দাঙ্গা সৃষ্টি করবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে প্ল্যান বাতিল। কেন? কে জানে।
এও জানা নেই, কেন নতুন করে কংগ্রেসের উপর মোদী আক্রমণ শুরু করেছেন। সনিয়ার অসুস্থতার খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপর আক্রমণ থেকে সরকার কিছুটা নিরস্ত হয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় তাঁর নতুন করে ডাক পড়ল ইডি দফতরে। সেই সঙ্গে পরলোক থেকে আহমেদ পটেলকে তলব। তার পর শোনা যাচ্ছে প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সঙ্গে নাকি পাকিস্তানি গুপ্তচরদের যোগ ছিল, এবং ২০০৭ সালে উপরাষ্ট্রপতি পদে তাঁর মনোনয়ন প্রাপ্তিতে নাকি সনিয়ার বিশেষ ভূমিকা ছিল। অর্থাৎ, আসন্ন গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আক্রমণ যদি কংগ্রেসমুখী হয় তবে পরিণামে উঠতি দল আম আদমি পার্টির ভোট কাটবে। লাভ হবে বিজেপির। অর্থাৎ, মোদী আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু অসংশয়ী নন।
এ দিকে কোভিড-বিধ্বস্ত ভারতে দৈন্যের করুণ ছবি প্রকট। ২০২০ সালে অর্থনীতি যে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল, তা তার অগ্রগমনের বেগ অনেক নীচে নামিয়ে দিয়েছে। অন্য দিকে, ২০১৪ সাল থেকে ডলারের বিচারে ভারতীয় টাকার মূল্য পড়েছে ২৫ শতাংশ। অতিমারির সময়ে যাঁদের চাকরি গেছে তাঁদের চাকরি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ অবিশ্বাস্য গতিতে পাল্টাচ্ছে কাজের ধরন। প্রয়োজন হচ্ছে নতুন দক্ষতার, যার অভাব সর্বত্র। সঙ্গে আছে মূল্যবৃদ্ধি, যা বেকারত্বের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৈরি করেছে এক শ্বাসরোধী পরিবেশ।
কিন্তু এ সব নিয়ে চিন্তিত নন মোদী। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বিদায় নিতে হল। কারণ, তিনি কোভিডকালে দেশের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মোদী হচ্ছেন— আবার ওয়েবারের কথা ধার করে বলতে হয়— এক জন ক্যারিসমাটিক নেতা। অর্থাৎ, অনন্যসাধারণ। সেই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বদের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার দরকার হয় না। মানুষের পেটে ভাত নেই— তার জন্য মোদী কেন দায়ী হবেন? চিন সেই যে লাদাখে বসে আছে, ১৬ দফা আলোচনার পরেও তারা নড়ছে না— সে জন্য মোদী কেন দায়ী হবেন?
তিনি তো নেতা নন, তিনি হলেন ‘ভারত-ভাগ্যবিধাতা’। এই বিশ্বাসটিই হল যাকে লোকে বলে ‘মোদী ম্যাজিক’। এই ম্যাজিক তো আর ভগবৎ-দত্ত নয়। চেষ্টা করে একে আঁকড়ে রাখতে হয়। সমালোচকদের জেলে পোরা হচ্ছে সেই চেষ্টার অঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy