স্বতন্ত্র: সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজস্ব মর্যাদা অর্জন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসু
ভারতের অন্য লোকেরা বলে বাঙালি ভোট নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে আর রাজনীতিতে এতই ব্যস্ত থাকে যে, অর্থনীতির জন্যে কোনও সময়ই নেই। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, রাজনীতি আমাদের মধ্যে অনেকখানি মজ্জাগত। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির দেশপ্রেম, উৎসাহ, সাহস ও বলিদান সত্যিই অতুলনীয়। কিন্তু স্বাধীন ভারতে বাঙালিরা কোনও রকম প্রতিদান বা যথার্থ মর্যাদা তো পায়ইনি বরং নিজস্ব অস্তিত্বও তারা এখন হারাতে চলেছে।
১৮৮৫’তে জাতীয় কংগ্রেস স্থাপনের পরে প্রথম ২০ বছরে সভাপতির পদে ১৬ জন ভারতীয়ের মধ্যে ৭ জন বাঙালি। নবগঠিত কাউন্সিলেও বেশ ক’জন বাঙালি সুবক্তা পথ দেখালেন, যেমন প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বনার্জী), সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, লালমোহন ঘোষ, কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ।
এর পর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে জুড়ে প্রতিবাদকে এক গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়া হল। বাংলার এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন থেকে ভারতবর্ষ পেল দু’টি নতুন রাজনৈতিক শব্দ ও হাতিয়ার: স্বদেশি আর বয়কট বা বিদেশি সামগ্রী বর্জন। ‘লাল-বাল-পাল’ ও অরবিন্দ ঘোষ— চার প্রধান চরমপন্থীর মধ্যে দু’জন বঙ্গসন্তান। চরমপন্থীদের একটি মূল বক্তব্য ছিল: বয়কট আর স্বদেশি যখন বাংলায় সফল হয়েছে, তখন এই জনপ্রতিরোধ বিভিন্ন প্রদেশে ছড়াতে হবে। বাংলার দুঃসাহস আর আন্দোলনের রাজনীতিকে অন্য অঞ্চলে রফতানি করতে নরমপন্থীরা একেবারেই রাজি ছিলেন না। চরমপন্থার হাত ধরেই এল স্বদেশি বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদ বা সশস্ত্র রাজনীতি। স্বদেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শ অনেক দিন আগেই এখান থেকে উধাও হয়েছে, কিন্তু তার বোমা আর বন্দুক বাংলায় এখনও বিরাজমান। যাঁরা আসার জন্যে মরিয়া, তাঁরা হিংসার রাজনীতিকে আরও বাড়াবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
১৯১৯-এ গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের রাজনীতি যতই অহিংসা-ভিত্তিক আর জনমুখী হতে থাকল, অন্যান্য প্রদেশের প্রচুর মানুষও তাতে যোগ দিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে বাংলার ভূমিকা ক্রমশ কমতে থাকল। চিত্তরঞ্জন দাশ অবশ্য নিজের মতামত জাহির করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। ১৯২২ সালে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে তিনি সভাপতি ছিলেন, কিন্তু যখন তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হল না, তিনি দল ছাড়লেন ও মোতিলাল নেহরুর সঙ্গে স্বরাজ্য পার্টি গড়লেন। ১৯২৫-এ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর বাংলায় দলাদলি যেই বাড়ল, জাতীয় স্তরের নেতাদের প্রভাব, শক্তি ও আধিপত্য ততই বৃদ্ধি পেল। কেন্দ্রীয় নেতারাও তাঁদের চাল খেললেন। কংগ্রেসের কোনও হাই কমান্ডই কখনও বাংলার বিশেষ চরিত্র বুঝতে পারেননি, বোঝার খুব চেষ্টাও করেননি, বরং বিভাজনের সুযোগ পেলে তিক্ততা বাড়িয়েছেন, বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উস্কেছেন, নিজেদের কর্তৃত্ব আরও মজবুত করেছেন। কংগ্রেসের রাজনীতির ইতিহাস থেকে উপলব্ধি করতে হবে যে, এখনকার ভারতীয় জনতা পার্টির হাই কমান্ডের প্রভুত্বব্যঞ্জক চরিত্র বাংলার পক্ষে কত ক্ষতিকারক। সহাবস্থান বা সহনশীলতা কাকে বলে, তাঁরা জানেনই না। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্যে তাঁরা বাংলার কাউকে কোনও সম্মান বা প্রাধান্য দিলেনই না। যাঁদের প্রচার সম্পূর্ণত দুই নেতা-কেন্দ্রিক, তাঁদের শাসনব্যবস্থাও হবে তথৈবচ। যাঁকেই তাঁরা রাজ্যের নেতা করবেন তাঁকে আজ্ঞাধীন অধস্তন হয়েই থাকতে হবে। বাংলার মানুষকে তাই এখনই ঠিক করতে হবে তাঁরা রাজ্যকে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত করতে রাজি আছেন কি না।
জনবিন্যাসের কারণেই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতা অপরিহার্য। এই মৈত্রীর উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর দূরদৃষ্টির অপূর্ব প্রমাণ ১৯২৩-এর বেঙ্গল প্যাক্ট, যা নিয়ে বেশ কিছু হিন্দু নেতা আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই সহমর্মিতা অন্যরা ধরে রাখতে পারেনি, তাই দেশভাগ, দাঙ্গা, খুনোখুনি। লক্ষণীয়, স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে অবধি বাংলার বিভাজন হবে কি না কেউ স্থির করতে পারেনি। এটাও মনে করতে হবে যে, বাঙালি মুসলমানরা উত্তর ভারতের বা পাকিস্তানের সহধর্মীদের থেকে অনেকটাই পৃথক। দুই বাংলাতেই বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন তাঁরা প্রথমে বাঙালি, তার পর বাকি সব। পৃথিবীর আর কোন জাতির লোক কাঁটাওয়ালা মাছ মুখে পুরে কথা বলতে বলতে খুবই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে এক গুচ্ছ বিপজ্জনক কাঁটা বার করতে পারে? আমরা অবশ্যই স্বীকার করি যে, এই দু’টি এখন পৃথক রাষ্ট্র। কিন্তু গুজরাতের মাঝামাঝি যদি একটি আন্তর্জাতিক সীমানা টেনে দেওয়া হত, তবে কি মোদী-শাহ ও-পারে চলে যাওয়া বডোদরা সুরাত বা ভারুচের মানুষকে এই ভাষায় গালি, হুমকি দিতে পারতেন?
শুরুতে বলেছিলাম ভারতের স্বাধীনতার জন্য বাংলার ত্যাগ স্বীকার আর যন্ত্রণার তুলনায় ১৯৪৭-এর পর সে প্রায় কিছুই পায়নি। দু’বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসভাকে জানিয়েছে যে ৫৮৫ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে আন্দামানের সেলুলার কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল তার ৩৯৮ জন ছিলেন বাংলার। উপমহাদেশের বাকি সব প্রদেশ মিলে ১৮৭। যা-ই হোক, আমরা ঘুরে দেখি যে সুভাষচন্দ্রই শেষ বাঙালি, যিনি সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কৌশলের উচিত জবাব দিতে পেরেছিলেন। বিধানচন্দ্র অবশ্য নিজের কায়দায় বেশ কিছুটা মাথা উঁচু রেখে কাজ করতে পেরেছিলেন। জ্যোতি বসু যত দাপটে রাজ্য চালিয়েছেন, তা কিন্তু নিজের দলের কেন্দ্রীয় কর্তাদের সঙ্গে মোটেই দেখাতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রী পদের কাছে পৌঁছে দলের পলিটবুরোর কাছে হেরে যান তিনি। লোকসভার স্পিকারের পদে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রতিটি পদক্ষেপ এত দক্ষতার সঙ্গে করার পরেও তাঁর দল তাঁকে বহিষ্কার করল। তবুও, এটুকু আমরা বলতে পারি যে, ভারতের মোট ১৭ জন স্পিকারের মধ্যে অন্তত এক জন বাঙালি। দক্ষতা ও যোগ্যতা সত্ত্বেও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে কংগ্রেস হাই কমান্ড রীতিমতো আতঙ্কিত ছিল। দিল্লিতে থাকাকালীন চোখের সামনে দেখলাম কী অসামান্য ধীশক্তি ও রণকৌশল অবলম্বন করে তিনি নিজের দলকে প্রায় বাধ্য করলেন তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্যে মনোনীত করতে। তার পরেও অনেক বিচক্ষণ পদক্ষেপ করেছিলেন বলে জিততে পেরেছিলেন। ভারতের ১৪ জন রাষ্ট্রপতির মাঝে এক জন বাঙালি তো আছেন।
কিন্তু এত সব দেখার পর এখন বাংলার অনেক মানুষের ভয় হল, যা-ও বা আছে তা-ও বোধ হয় যেতে চলেছে। আমরা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার বা ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় তুলবই না। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে খাল কেটে কুমির আনছে কি না, সেই সব বিতর্কে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ঘটনা হল, যাঁরা হিন্দিরাজের পথ প্রশস্ত করছেন, বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাধিকার বা সার্বভৌমত্বের মূল্যনির্ণয় করার ক্ষমতাই তাঁদের নেই। অতএব বাংলার সভ্যতা ও ভাষাকে উত্তর ভারতীয় সমসত্তাবাদ বা হোমোজেনাইজ়েশন কতখানি পরিপাক করতে পারবে, বিস্তর সন্দেহ আছে। এখানকার পুরনো বা নবাগত হিন্দিবাদীরা তাঁদের ত্রুটিযুক্ত হিন্দিতে সর্বভারতীয় নেতাদের সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করতে পারেন। তাঁরা এক শ্রেণির মানুষের সামনে হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্বের গুণগান গাইতে পারেন, বিকাশ-পরিবর্তনের স্বপ্নও দেখতে পারেন। কিন্তু ‘আসল পরিবর্তন’ আনবে যে দল, তাদের শাসিত একটা রাজ্যেও কোনও অর্থনৈতিক উন্নতির উদাহরণ দেখাতে পারবেন না।
সেই ১৩৫২ সনে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই এই রাজ্য তার একটি পৃথক চরিত্রে বিশ্বাস করেছে, যা অনেক ব্যাপারেই কিছুটা আলাদা। যাঁরা হিন্দুত্ব নিয়ে বড়াই করছেন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন এখানকার দেবদেবী ও উৎসব খুবই বাঙালি। দুর্গা একমাত্র বাংলায় সপরিবারে আসেন আর একই সঙ্গে যত্নশীল মা বলে পূজিত হন এবং আদরের মেয়ে হিসেবে আদৃত হন। দেশের বৃহৎ অংশে প্রচলিত নবরাত্রির ব্রত এবং গোঁড়া নিরামিষ খাদ্য থেকে বাঙালি প্রচুর দূরত্ব বজায় রাখে। সারা দেশে যখন দীপাবলি, তখন অমাবস্যার অন্ধকারে বাঙালি পুজো করে ডাকিনী যোগিনী সমেত কালীর। আমাদের বিশ্বকর্মা এক সুন্দর যুবক, সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো নয়। এখানে দোল এক দিন আগে, অন্যান্য তিথিও আগে-পরে। অতএব আমরা রাম বা হনুমান পুজো করব কি না আমরাই ঠিক করতে চাই। আমরা মাছ-মাংস খেতে ভালবাসি আর এ ব্যাপারে কোনও জ্ঞান শুনতে রাজি নই। আমাদের মহর্ষি আর তাঁদের আদর্শ যাঁরা বোঝেন না, তাঁদের গ্রহণ করা মুশকিল। যাঁরা হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্বের প্রচারে উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁরা কি বুঝতে পারছেন না বাংলার সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বকেই বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছেন?
এ বারকার আসল খেলা শুধু রাজনৈতিক নয়, প্রধান লড়াই হিন্দি-হিন্দুত্ব বনাম বাঙালিত্বের। দোহাই, এই সত্যটি অস্বীকার করবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy