নদীখাত।
কালিম্পঙের ডালিমকোটের জঙ্গলের এক ঝর্না থেকে মাল নদীর জন্ম। তার পর বুড়িখোলা জঙ্গল, মিশন হিল চা বাগান ও মাল চা বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা। তেশিমিলা গ্রামের কাছে নেওড়া নদীর সঙ্গে মিশে যাওয়া। বছরে অধিকাংশ দিন জল নেই। হঠাৎ কখনও-সখনও প্রবল বেগে জল নেমে আসে। এমন ‘হড়পা বান’ গত এক-দুই বছরে মাল নদীতে তিন বার এসেছিল। পাহাড়ি নদীর ঢাল বেশি হওয়ায়, উপরের অববাহিকাতে একটু বৃষ্টি হলেই নদীর পথ ধরে জল নামে। অববাহিকা সঙ্কীর্ণ, তাই জলের বেগ হয় প্রবল। তেমনই হড়পা বানে বিজয়া দশমীতে ভেসে গেলেন অতগুলো মানুষ।
সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে যে, ‘বৃষ্টি তত্ত্ব’ প্রশাসন মানতে চাইছে না। অথচ, বৃষ্টির ভূমিকা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াও কঠিন। হিমালয় থেকে নেমে-আসা ভারতের অন্যান্য নদীতেও হড়পা বানের প্রবণতা বেড়েছে। এর জন্য অনেকটাই দায়ী বিশ্ব উষ্ণায়ন। পাহাড়ে অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বিগত দুই দশকে বেড়েছে অনেকটাই। গড় বৃষ্টিপাত দিয়ে তা ধরা যায় না— জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে ‘মাইক্রো ক্লাইমেট’ এলাকা। খুব ছোট এলাকায় প্রবল বৃষ্টি হতে পারে। পরিবেশকর্মীরা দাবি করছেন, দুর্ঘটনার আগে এই রকম বৃষ্টি পাহাড়ে হয়েছিল। তাই নদীতে জলের পরিমাণ বেড়েছিল।
তার উপর ছিল নদীর বুকে বোল্ডার দিয়ে তৈরি অস্থায়ী বাঁধ, যা গতিপথ বদলে দিয়েছিল মাল নদীর। কারা প্রকাশ্য দিবালোকে পাথর ফেলে নদীর পথ আটকাল? সেচ দফতর দায় ঝেড়ে ফেলেছে, অন্য কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। কৃত্রিম ভাবে পাথর ফেলে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তার গঠনে পরিবর্তন আনে, বদলে যায় নদীর পথ ও চরিত্র। একে নদী-বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যানথ্রপজেনিক রিভার মেটামর্ফসিস’। নদীর গতিপথে বদল কার্যত নদীর ‘ব্যক্তিগত জীবন’-এ হস্তক্ষেপ করার শামিল, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, কেউ বলতে পারে না। এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি জানিয়েছে, কেউ কোনও ভাবে নদীর গতিপথ পাল্টাতে পারবে না।
পাহাড়ি নদীগুলো আজকাল লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বুকের বালি-পাথরের জন্য। স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা দাবি করছেন, মাল নদী থেকে বালি তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কিছু দিন আগে একটা বালি-কাঁকর বোঝাই লরি হঠাৎ করে হড়পা বানে ভেসে যায় মাল নদীর বুকেই। বালি তোলার জন্য নদীর গতিপথকে ঘুরিয়ে দেয় চোরাকারবারিরা, যাতে নদীর একটা অংশকে শুকনো করে ফেলা যায়। মাল নদীর মূল ধারা এক দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর একটি সঙ্কীর্ণ ধারা তার পাশ দিয়ে বইছিল। মাঝে ছিল একটি অস্থায়ী চর। কম স্রোতের এলাকা থেকে বালি-পাথর তোলার কাজ শুরু হয়েছিল ‘মাইনর মিনারেলস অ্যাক্ট’-কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, বলছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা।
মাল নদীর বান বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। উত্তরাখণ্ডের স্মৃতি এখনও অমলিন। হিমালয় জুড়ে একের পর এক নদীতে হড়পা বান দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্র বা রাজ্য কী করতে পারে? প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে থেকে হিমালয় থেকে নেমে-আসা নদীগুলোকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন আছে। কেন্দ্র ও রাজ্য এক সঙ্গে বসে এত দিনেও একটি ‘হিমালয় নীতি’ নির্মাণ করেনি কেন, প্রশ্ন সেটাই। ভারত হিমালয়ের দান। হিমালয় থেকে নেমে আসা ছোট-বড় নদীগুলি এ দেশের শরীর বা ভূপ্রকৃতি নির্মাণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও হিমালয়ের নদীগুলোর ব্যবহার নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও নীতি গড়ে ওঠেনি। যার ফলে এই সব নদী ক্রমশ অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে পড়ছে। পাশাপাশি, সঙ্কটে ফেলছে মানুষকেও।
অনেকেই আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। কারণ, উন্নয়নের নামে দার্জিলিং হিমালয়কে গর্ত করে যে ভাবে টানেল বানানো হয়েছে, যে ভাবে গাছ কাটা হয়েছে, বেড়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার, তা প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করতে পারে। ভয় হয় যখন দেখি, কী ভাবে পাহাড়ি এলাকায় নির্মাণ হয়েছে বড় বাঁধ, একের পর এক পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল হোটেল, পাহাড়ি নদীর বুকে গড়ে উঠেছে পাথর খাদান। এ সবই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় আনতে পারে, অতীতের অভিজ্ঞতা জুড়ে দিলে তা বুঝতে সময় লাগে না।
এর প্রতিরোধের উপায়ের কতটুকু আর মানুষের হাতে আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবু বিপন্নতা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। হড়পা বান কী ভাবে কমানো যায়, সেই পথ খোঁজা দরকার। ‘ফ্লাড মনিটরিং সিস্টেম’ আরও জোরদার করতে হবে। যে কোনও নির্মাণে প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। পাহাড়ি নদীর উপত্যকাগুলোতে আরও বেশি করে মাটি ও বৃষ্টির জলকে আটকে রাখার উপযুক্ত গাছ লাগানো প্রয়োজন। নদীখাতকে সব সময় প্রশস্ত ও দখলমুক্ত রাখতে হবে বন্যার জল চলাচলের জন্য। তাতে খানিকটা হলেও বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচা যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy