সবাই মিলে ভাল থাকার জন্য বিজ্ঞান। প্রতীকী ছবি।
কবীর সুমনের একটি গানে আছে ‘সবাই মিলে বেঁচে থাকা, ভরসা তাদের করুক তাড়া।’ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের থিম ঘোষণা করার পর এই কথাটিই প্রথম মনে এসেছিল। কারণ, এই বছরের থিম হল ‘গ্লোবাল সায়েন্স ফর গ্লোবাল ওয়েলবিয়িং’ অর্থাৎ ‘বিশ্বকল্যাণের লক্ষ্যে বিশ্ব (জুড়ে) বিজ্ঞান’। সহজ বাংলায় বললে সবাই মিলে ভাল থাকার জন্য বিজ্ঞান। গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানকে ‘দেশের কাজ’-এ লাগানোর কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। এ বার তাকে আর দেশে ধরে রাখা গেল না।
কিন্তু বিজ্ঞান তো কোনওদিনই দেশের সীমানায় আটকে ছিল না। বিজ্ঞানচর্চার ধারা বিজ্ঞানের নানা রকম আবিষ্কার তো চিরদিনই দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তা হলে আজ আলাদা করে এই শিরোনাম কেন? মন্ত্রিমশাইয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে চায়।
এই ভাবনার পিছনে সরকারের ঘোষিত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন নীতি ২০২০ (এসটিআইপি)-র একটা ভূমিকা রয়েছে। প্রতি আর্থিক বছরে মোট ব্যয়ের কতটা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে খরচ করা হবে, আর সেই সামগ্রিক বিনিয়োগ কোন খাতে কী ভাবে ব্যয় করা হবে, সেটা ঠিক করাই হল জাতীয় বিজ্ঞান-নীতি। অর্থাৎ, দেশ মৌলিক বিজ্ঞানের চর্চায় বেশি জোর দেবে না প্রযুক্তিতে, শিল্পায়নে বেশি খরচ করবে না পরিবেশ রক্ষায়, না কি দুটোকেই সমান গুরুত্ব দেবে— এই সব বিষয় বিজ্ঞান-নীতির অধীনে পড়ে যায়। বিজ্ঞান-নীতি প্রণয়ন একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া; ধাপে ধাপে ও বিভিন্ন সংস্থা ও উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই নীতি কোনও নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে বদলায় না; এক বার প্রণয়ন হওয়ার পর আবার দরকার পড়লে দীর্ঘ আলোচনার পরই এই নীতি বদলানো হয়। গত ৭৫ বছরে দেশ জুড়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞান নীতিরই ফলাফল। ২০২০ সালের আগে মোট চার বার জাতীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে; ক) সায়েন্টিফিক পলিসি রেজ়লিউশন, ১৯৫৮, খ) টেকনোলজি পলিসি স্টেটমেন্ট, ১৯৮৩, গ) সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি, ২০০৩, ঘ) সায়েন্স টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন পলিসি, ২০১৩। স্বভাবতই বিজ্ঞান-নীতির রূপায়ণের ক্ষেত্রে শাসক দলের পরোক্ষ একটা প্রভাব থেকেই যায়।
২০২০ সালে কোভিড-পর্বের মধ্যেই নতুন বিজ্ঞান-নীতির খসড়া শুরু হয়েছিল। প্রযুক্তিতে স্বয়ম্ভরতা অর্জন, বিজ্ঞানে দেশকে বিশ্বের প্রথম তিন শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে নিয়ে আসা, সর্বব্যাপী এবং ‘জনগণকেন্দ্রিক’ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন-বাস্তুতন্ত্রের মাধ্যমে দেশের মানবসম্পদকে শক্তিশালী করে তোলা ইত্যাদি হল এই নীতির ঘোষিত লক্ষ্য। লক্ষ্য— বিজ্ঞান গবেষণার সুফল যেন সমস্ত দেশবাসী সমান ভাবে পান এবং দেশের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেশীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমেই যেন হতে পারে। এক কথায় ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলা। কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানের পড়াশোনা, গবেষণা সব কিছুকে খুব বেশি মাত্রায় ‘প্রয়োগমুখী’ এবং ‘ফলাফল ভিত্তিক’ (লাভজনক?) করে তোলার নির্দেশ আসছে, বিজ্ঞান দিবসও আর এর বাইরে নেই।
গত কয়েক বছরের কোভিড-পর্ব আমাদের দেখিয়েছে বিশ্বজোড়া সমস্যা কেমন হতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী সমস্যা হল পরিবেশ, জল, বাতাস, মাটি— যা সকলের ভাল থাকার জন্য দরকার। কিন্তু পরিবেশ তো ঠিক এমন বিষয় বা সমস্যা নয়, যার হাতেগরম সমাধান সম্ভব। আর বিভিন্ন জায়গার সবুজ ধ্বংস করেইমারত গড়াকে যারা কৃতিত্ব হিসাবে দেখেন, পরিবেশ নিয়ে তাঁদের ভাবনার উপর ভরসা করা যায় না। সম্প্রতি এও জানা গিয়েছে যে, বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা কিছু নির্মাণ প্রকল্প সুপ্রিম কোর্ট থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে। তাই বিশ্ব জুড়ে মানুষের ভাল থাকার জন্য ঠিক কী ধরনের সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে হবে, বিজ্ঞান দিবসের থিম থেকে তা পরিষ্কার নয়।
তবে এহ বাহ্য। বিজ্ঞান দিবস পালনের মৌলিক উদ্দেশ্য (ছিল) সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ ঘটানো। কিন্তু এই বছরের থিমের পিছনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমূলক বিষয়ের প্রতি প্রশংসার মনোভাব গড়ে তোলার কথা স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। বিজ্ঞানকে কি একটা ‘চেতনা’ থেকে একেবারে ‘হাততালি পাওয়ার হাতিয়ার’-এ পরিণত করে ফেলা হচ্ছে?
আরও প্রশ্ন আছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কতকগুলো জিনিস ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলেছে। এক দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে মূলত প্রযুক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া, গবেষণাখাতে অনুদান ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া আর অন্য দিকে নানা ধরনের বুজরুকি ও অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির নাম করে গরু, গোবর ও গোমূত্রের মাহাত্ম্য প্রচার, গণেশের মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারি বা পুষ্পক রথকে বিমানের সঙ্গে তুলনা করা। তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন হল দেশের প্রযুক্তির পীঠস্থান আইআইটি খড়্গপুর -এর ক্যালেন্ডার; সেখানে প্রাচীন ভারতীয় ‘জ্ঞান-ব্যবস্থা’র গুণগান করতে গিয়ে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সবই যে আসলে প্রাচীন ভারত থেকে উদ্ভূত এমন দাবি করা হয়েছে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে অনুলোম-বিলোমের মিল রয়েছে, হাইজ়েনবার্গ যে রবীন্দ্রনাথকে প্রায় গুরু মেনেছিলেন, এই সব কথাও সেখানে সরব ঘোষণা হয়েছে। অর্থাৎ, ভারতীয় সংবিধানের ৫১এ (এইচ) ধারাকে নস্যাৎ করে জনগণের টাকায় চলা একটি বিজ্ঞানসংস্থা এই ধরনের অপবিজ্ঞানের প্রচার চালাচ্ছে! মনে করিয়ে দিই, ৫১এ ধারায় লেখা আছে, মানবিকতা, বিজ্ঞানচেতনা, অনুসন্ধিৎসা এবং সংস্কারমূলক (পরিবর্তন বা সংশোধন) মানসিকতা গড়ে তোলা ও চর্চা করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব। এটাও লেখা আছে যে, চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের বিষয়ে কোনও রকম বুজরুকির (জলপড়া-তাবিজ-মাদুলি ইত্যাদি) যাকে এক কথায় ‘ম্যাজিক রেমিডি’ বলা যায়, তার চর্চা এমনকি বিজ্ঞাপনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
যেমন, আয়ুর্বেদকে চিকিৎসার একটি শাখা হিসেবে পড়ানো হয়, সে এক রকম। কিন্তু সম্প্রতি এই শাখায় ‘চিকিৎসা-জ্যোতিষ’ (মেডিক্যাল অ্যাস্ট্রোলজি) নামক একটি বিষয় ঢোকাবার চেষ্টা হচ্ছে, যেখানে ১০ মাসের একটি কার্যক্রমের মাধ্যমে পেটের অসুখ, হার্টের অসুখ, যক্ষ্মা, জ্বর ইত্যাদি অসুখের সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্র-জন্মছকের যোগাযোগ এবং নিরাময়ের উপায় ‘শেখানো’ হয়েছে। ভারতীয় সমাজে মনুস্মৃতির প্রাসঙ্গিকতা গবেষণা প্রকল্পে ছাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। আমিষ ভোজন নিষিদ্ধ হয়েছে আইআইটি মান্ডি-র চত্বরে। আবার বেদ-পুরাণ-ভগবদ্গীতা বিষয়ক কুইজ় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হয়েছে আইআইইএসটি শিবপুরে। অর্থাৎ, এক দিকে বিজ্ঞানের হাতে বিশ্বসমস্যা সমাধানের গুরুদায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে আর অন্য দিকে তাকে বৈদিক যুগে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে মেলানো হচ্ছে যাবতীয় বুজরুকির সঙ্গে; সব মিলে খুবই গোলমেলে অবস্থান।
আমরা হাসছি, প্রতিবাদ করছি, ভাবছি এ ভাবেই এ সব কাজ বন্ধ হবে। কিন্তু হচ্ছে না, বরং সংখ্যায় বাড়ছে। ওজনেও বাড়ছে, কারণ ঘটনাগুলো ঘটছে বিজ্ঞানচর্চার খাসমহলগুলোতে। যে জন্য সাধারণ মানুষের মনে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে। একেবারে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রাচীন ভারতের নাম করে গণতান্ত্রিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদিকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুতরাং, এ সবের সঙ্গে লড়তেও হবে পরিকল্পনা মাফিক। একটি উপায় হল প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা নিয়ে স্পষ্ট ও প্রামাণ্য বিষয় তুলে ধরা। চিকিৎসা, প্রযুক্তি, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে বৈদিক যুগের অবদান নিয়ে ঠিকঠাক আলোচনা করা দরকার। তা ছাড়াও অপবিজ্ঞানের প্রচারমূলক ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা দরকার; প্রয়োজনে এই ধরনের ক্যালেন্ডার, পোস্টার, কার্যক্রম ইত্যাদিকে তুলে নিতে বাধ্য করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে আগে নিজেদের সজাগ থাকতে হবে। কবীর সুমনকে একটু বদলে নিয়ে বলি, সকলের ভালর জন্য “সবাই মিলে জেগে থাকা, ‘সায়েন্স’ তাদের করুক তাড়া !”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy