Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Society

অন্যের উপকার করব কেন

মূলধারার অর্থশাস্ত্র বলবে, নিজের ইউটিলিটি বৃদ্ধি অর্থাৎ স্বার্থসিদ্ধি করা ছাড়া ‘হোমো ইকনমিকাস’ বা ‘অর্থনৈতিক মানব’ আর কিছুই করে না।

Picture of Hands.

ব্যক্তিগত স্তরে অনেক অতিধনী মানুষই দানধ্যান করেন; অনেক কর্পোরেট সংস্থাও দান করে। প্রতীকী ছবি।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ ০৬:৩৮
Share: Save:

রাষ্ট্রপুঞ্জের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর সর্বময় কর্তা ডেভিড বেসলি সম্প্রতি বললেন, “ধনী দেশের হাতে কোটি কোটি ডলারের সম্পদ জমে আছে, অথচ বিশ্বের নানা প্রান্তে অভুক্ত শিশুর কান্না শোনা যায়, এ আমাদের সবার লজ্জা।” ব্যক্তিগত স্তরেও কথাটির যাথার্থ্য নিয়ে সন্দেহ নেই। কিছু মানুষ ফেলে-ছড়িয়ে, অবান্তর ব্যয় করে বাঁচেন, আর অনেক মানুষের পাতে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হয় না। প্রশ্ন হল, আমাদের উদ্বৃত্ত খাবার বা টাকাকড়ির সব না হলেও অন্তত কিছুটা আমরা অভুক্ত, গরিবদের হাতে তুলে দেব না কেন?

ব্যক্তিগত স্তরে অনেক অতিধনী মানুষই দানধ্যান করেন; অনেক কর্পোরেট সংস্থাও দান করে। এমনকি, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেও অনেকেই নিয়মিত দান করেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে কাজ করেন সাধ্যমতো। আমরা আদৌ কেন দান করি, অথবা করি না? পরহিতপরায়ণ কেন হই, বা কেন হই না? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলে নাগরিককে আরও অনেক দায়িত্বশীল, বিবেচক করে তোলার কাজটা রাষ্ট্রের পক্ষে সহজতর হতে পারে। যে কারণে, বা যে পরিস্থিতিতে, অথবা যে উদ্দীপকের উপস্থিতিতে মানুষ দানপরায়ণ হয়, তেমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাষ্ট্র নাগরিককে আলগোছে সে দিকে ঠেলে দিতে পারে— আচরণবাদী অর্থনীতির তাত্ত্বিক, নোবেলপ্রাপক রিচার্ড থেলার যার নাম দিয়েছেন ‘নাজ’।

মূলধারার অর্থশাস্ত্র বলবে, নিজের ইউটিলিটি বৃদ্ধি অর্থাৎ স্বার্থসিদ্ধি করা ছাড়া ‘হোমো ইকনমিকাস’ বা ‘অর্থনৈতিক মানব’ আর কিছুই করে না। কেউ বলতে পারেন যে, পরহিতৈষণার মধ্যে দিয়ে যে আনন্দ মেলে, তা ব্যক্তির নিজের ইউটিলিটি বৃদ্ধি করে। কিন্তু, সে ভাবে দেখলে অর্থশাস্ত্রের পরিসরে, অর্থনৈতিক মানব-এর পরিপ্রেক্ষিতে, ‘ইউটিলিটি’ কথাটা তার অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়। সৌভাগ্যের কথা, অর্থশাস্ত্রের কেতাবে যে ‘অর্থনৈতিক মানব’-এর কথা থাকে, বাস্তব দুনিয়ায় তার দেখা পাওয়া যায় না। ফলে, নিজের লাভের কথা না ভেবেই দান করেন অনেকে। তা ছাড়া আছে আত্মগরিমা, যাকে বলা হয় ‘ওয়ার্ম-গ্লো’— কিছু দান করার মধ্যে সমাজ ও নিজের চোখে মহৎ প্রতিপন্ন হওয়ার আনন্দ। আছে ফেয়ারনেস বা ন্যায্যতা, এবং এথিকস বা নীতির প্রতি আমাদের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসও।

কেউ আবার বলতে পারেন যে, বিশুদ্ধ পরহিতৈষণা হল সোনার পাথরবাটি— পুরোটাই আসলে বিনিময়। তুমি আমার জন্য কিছু করলে আমিও তোমার জন্য করব, এ-হেন একটা অলিখিত চুক্তি। যেন, সবাই মিলে একটা ‘গেম’ খেলছি, আর সে খেলায় পরহিতৈষণা হল এক ‘ইকুইলিব্রিয়ম’ বা স্থিতাবস্থা। আমি যাঁকে দিলাম, তিনিই আমাকে ফেরত না দিলেও, অন্য কোথাও, অন্য কেউ হবেন দাতা, আর সে দিন আমি গ্রহীতা। এর আদর্শ উদাহরণ হল আন্তঃপ্রজন্ম ব্যয়, যেখানে পিতা তাঁর সন্তানের জন্য ব্যয় করেন, এবং সেই সন্তান পিতা হয়ে পরের প্রজন্মের দায়িত্ব নেন। এ ভাবেই সমাজে গড়ে ওঠে এক ‘সোশাল নর্ম’ বা সামাজিক রীতি। আমরা বাসে বয়স্ক মানুষকে নিজের সিট ছেড়ে দিই। এক দিন আমারও বয়স হবে, সে দিন আমার জন্য অন্য কেউ সিট ছেড়ে দেবে, এই রীতির ভরসায়।

পরহিতের প্রশ্নে অবশ্যই আসবে অনুশাসন, বিশেষত ধর্মীয় আচরণের প্রতি অনুবর্তিতা। ধর্ম আমাদের দান করতে শেখায়, কখনও বা বাধ্য করে। সেই দানেও যে ফলের প্রত্যাশা থাকে না, তা নয়। যাঁরা ধর্মের নামে দানের প্রার্থনা করেন, তাঁরাও বলেন, “ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন, আপনার সন্তানের ভাল হবে।” আশা ও লোভের এই দান বা পরহিতের মধ্যে কিন্তু সাহায্যের বিনিময়ে সাহায্যের নিশ্চয়তা নেই। পুরোটাই প্রবাবিলিটি বা সম্ভাবনাতত্ত্বের গল্প— পরহিত বা দান করলে আমার সন্তানের হিত হতে পারে, হবেই তা তো নয়; আর হলেও তৎক্ষণাৎ তো আর হবে না! একই ভাবে, ধর্ম আমাদের ভয়ও দেখায়, অজানা আশঙ্কার।

তাহলে, দান বা পরহিতৈষণার দুটো পথ থাকতে পারে— এক, ব্যক্তিগত ভাল লাগা বা নীতিবোধের জায়গা; দুই, এক সামগ্রিক চিন্তাভাবনা যাকে ধারণ করে আছে পারস্পরিক সাহায্যের আশ্বাস বা ধর্মের বিশ্বাস। এই দুটোর মধ্যে কিন্তু একটা বিষয় মিশে আছে— আলোচ্য স্থান-কালের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত। পুরনো গ্রামীণ সভ্যতায় আর আজকের পশ্চিমি ভাবধারার নাগরিক সমাজে পরহিতের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘পাশে আছি’ এখন সমাজমাধ্যমে অতি-পরিচিত শব্দবন্ধ; দু’শো বছর আগের বাংলার কোনও গ্রামে কারও পাশে থাকার অনুভূতি বা উপলব্ধিটাই ছিল আলাদা।

অন্য বিষয়গুলি:

Society Inequality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy