‘ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস’ ছবির একটি দৃশ্য। ফাইল চিত্র।
সুইডেনের রুবেন অস্টলুন্ড-এর পরিচালিত শেষ তিনটি ছবি— তিনটিই ব্যঙ্গধর্মী— বিশ্বসমাদৃত। এর মধ্যে সাম্প্রতিকতম ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস (২০২২) এ বছরই পাম ড’ওর পেয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে (উপরে, এই ছবির একটি দৃশ্য)। ‘বিষণ্ণতার ত্রিভুজ’-এর বিষয় বিলাসবহুল একটি ক্রুজ়-এ ভীষণ রকমের বিত্তশালী কিছু যাত্রীর ঔদ্ধত্য আর ভোগ; আর সমুদ্র মাঝে ক্রুজ়-এর বিপত্তির পর একটি দ্বীপে আশ্রিত ওই যাত্রীদের ক্ষোভ আর দুর্দশা। ছবির সবচেয়ে আলোচিত অংশটি ওই ক্রুজ়-এ, যেখানে অবিরাম খানাপিনা চলে, টেবিলে এসে উপস্থিত হয় আকাশছোঁয়া দামের একের পর বিজাতীয়, বিবর্ণ সব পদ। তারই মধ্যে মাঝসমুদ্রে বিপাকে পড়ে ওই জাহাজের টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়। এতে খেতে বসা যাত্রীদের হজম হওয়া না-হওয়া আহার্য বেরিয়ে আসতে থাকে উল্টো পথে। কিন্তু সিনেমার চোখ সেই অবস্থা থেকে মুখ তো ফেরায়ই না, বরং ক্যামেরায় ধরা থাকে সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ বমির দৃশ্য। ফলস্বরূপ দর্শকদের চূড়ান্ত অস্বস্তি। ছবিটি ফের উস্কে দিয়েছে বিতর্ক: সিনেমায় কুৎসিত, বিরাগজনক দৃশ্য— হিংসার, যৌনতার, নগ্নতার, শারীরিক প্রক্রিয়া বা পীড়নের— অপরিহার্য কি?
কিছু ক্ষেত্রে, যেমন পিয়ের পাওলো পাসোলিনির সাঁলো, অর দ্য ১২০ ডেজ় অব সোডম-এ (১৯৭৫), ফ্যাসিজ়ম-এর বিকৃতির চিহ্ন হিসাবে বিষ্ঠা-আহারের রাজনৈতিক ব্যবহার তো বহুলপ্রচারিত। যে অন্য দু’টি ছবির কথা এখানে বলতে হয়, তার প্রথমটি পিটার গ্রিনওয়ের দ্য কুক, দ্য থিফ, হিজ় ওয়াইফ অ্যান্ড হার লাভার (১৯৮৯), যেখানে ছবি জুড়ে অপরাধ, ভোজনবিলাস আর লালসার চড়তে থাকা পারদ একটি ফরাসি রেস্তরাঁয় নরমাংস ভক্ষণের ভয়াবহ দৃশ্যে পরিসমাপ্তি পায়। অন্যটি কাউন্টার-কালচারের বিতর্কিত ছবি মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিয়োনি-র জ়াবরিসকি পয়েন্ট (১৯৭০)। ছবির শেষ দৃশ্যে পাহাড়চূড়ার বিলাসবহুল অত্যাধুনিক অট্টালিকায় পুনরাবৃত্ত বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় অর্কেস্ট্রা, যেখানে পিঙ্ক ফ্লয়েড-এর সঙ্গীতের তালে তাল রেখে, স্লো-মোশনে, বোমার মতো ফাটতে ফাটতে হাওয়ায় উলটপালট খেতে থাকে দামি আহার্য, সাজানো ফল, কাটা আনাজ, স্টেকসদৃশ মেদবহুল মাংস, গেলাসে ভরা দামি সুরা। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
ভোগের মূল্য নির্ধারণে, সভ্যতার নিরীক্ষণে, অস্তিত্বের টানাপড়েনে মানুষের আতিশয্যের, চাহিদার বা লোভের সীমা, রাজনীতি আর সঙ্কট বোঝাতে খাদ্যবস্তু আর ক্ষুধা সিনেমায় বার বার ফিরে এসেছে। কেন? শুধুমাত্র সিনেমায় ন্যারেটিভের প্রয়োজনে? ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস-এর ক্ষেত্রে অস্টলুন্ড দর্শকদের মধ্যে বিবমিষার উদ্রেক করতে চান, সেই কারণেই এই দৃশ্যের দীর্ঘতা। কারণ? অস্টলুন্ড-এর মতে, সিনেমার পোড়খাওয়া দর্শকদের মধ্যেও একটা বিক্ষোভ, একটা অশান্তি তৈরি করা তাঁর লক্ষ্য। তার মানে কি কুৎসিত, বিরক্তিকর, বিবমিষা-উদ্রেককারী দৃশ্যের উত্থাপন না করলে আমরা কিছু জিনিস লক্ষ করি না? অর্থাৎ, ধাক্কা না খেলে আমাদের উঠে বসার অভ্যাসটা কি বিলুপ্ত?
কিন্তু, এই ধাক্কার জন্য কি জোরালো সিনেমার অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? ক্ষুধার পরিমাপে ভারতের স্থান বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে এসেছে ১০৭-এ। শুধু ওই হাঙ্গার ইনডেক্স নয়, রাইট টু ফুড থেকে রেশন, মাথাপিছু খাদ্যের জোগান, সবেতেই তড়িৎ-গতিতে পিছন দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। এটা ক্রমাগত পরিষ্কার যে, আমাদের অলক্ষ্যে ক্ষুধার একটা মানচিত্র তৈরি হয়েছে এ দেশে— দ্য জিয়োগ্রাফি অব হাঙ্গার। এটা কি ধাক্কা দেওয়ার মতো বিষয় নয়? সমস্যা অনেক প্রশস্ত, ক্ষুধার এই আগ্রাসন শিকড় বিছিয়েছে অনেক গভীরে। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার সূত্রে অমর্ত্য সেন বহু দিন ধরেই এ ব্যাপারে বলে আসছেন, যদিও এ সবে কর্ণপাত করার মতো সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই বর্তমান সরকারের নেই। এটা নতুন কথা নয়। তবে সরকারমাত্রেই এ ব্যাপারে কানে খাটো বা চোখে ঝাপসা, শুধুমাত্র বর্তমান সরকারকে দোষ দিয়ে বিশেষ কোনও লাভ নেই।
কিন্তু সমস্যাটা শুধু সরকারের নয়। আমাদের, অর্থাৎ মধ্যবিত্তের অবস্থানটাও একটু ভেবে দেখা দরকার। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারকে দোষারোপ করে, সমাজমাধ্যমে দু’চারটে ক্ষোভ ছুড়ে দিয়ে আমরা আবার যথাস্থানে ফিরে যাই— নিজেদের কোটরে। আর একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, ওই কোটর জুড়ে, তার দেওয়াল জুড়ে, তার দরজা-জানলা জুড়ে শুধুই খাবারের ছবি। লোলুপ মধ্যবিত্ত চোখে, মুখে, সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে খিদে নিয়ে তার আশপাশকে সাজিয়ে তুলছে খাবারের ছবিতে— উৎসবে, জন্মদিনে, এমনি দিনে, অমনি দিনে, বৃষ্টি হলে, বৃষ্টি না-হলে, শোকে, সাহচর্যে, প্রেমে-অপ্রেমে, ব্লগারের আপডেটে, সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্রের পাতা জুড়ে, ম্যাগাজ়িনের সংখ্যায়, রেস্তরাঁর মুখ ঢেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনে, সোশ্যাল মিডিয়ার ডিজিটাল জমি জুড়ে শুধুই খাবারের ছবি। সারা দিন, সারা রাত, সারা বছর শুধুমাত্র অতিভোজনের উল্লাস। ক্ষুধার তালিকায় ভারত ১০৭তম হতেই পারে, কিন্তু তাতে আমার কী? আমার আছে থালাভর্তি ভোগ, সবপেয়েছির বুফে।
তাঁর বিখ্যাত বই অন ফোটোগ্রাফি-তে আমেরিকান লেখিকা সুজ়ান সন্তাগ বলেছিলেন, ‘ফোটোগ্রাফি ফিডলস উইথ দ্য স্কেল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’— অর্থাৎ, চাইলে ফোটোগ্রাফি এ বিপুলা পৃথিবীর সমস্ত দ্রষ্টব্য (বা অদ্রষ্টব্য)-কে নিয়ে খেলা করতে পারে। অপটিক্স-এর কারসাজিতে অভাবকে আতিশয্য দিয়ে ঢাকতে পারে; সামান্যকে করে দিতে পারে মহান, শেষকে অশেষ প্রতিপন্ন করতে পারে। আমাদের অজানতেই আমরা, সুমহান মধ্যবিত্ত শ্রেণি, চার পাশকে ক্রমাগত মুড়ে ফেলেছি এ রকম স্বয়ংক্রিয় আতিশয্য দিয়ে, আর তাতে আমাদের দোসর স্মার্টফোন। এ যেন এক রকমের ‘প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন’— শুধু জমির জায়গায় আমরা সংগ্রহ করে চলেছি বাহুল্যের এক-একটা মুহূর্ত। আর এক-এক মুহূর্তের অ্যাকুমুলেশনের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন সেই অপ্রমেয় প্রাচুর্যের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষ, তাঁদের অভাব, তাঁদের ক্ষুধা। এতে আমাদের সামান্যতম লজ্জাবোধও আর কাজ করে না।
অথচ, এ রকম হওয়ার কথা কিন্তু ছিল না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের মধুবংশীর গলি-র ২৫ নম্বর থেকে সুকান্তের ‘হে মহাজীবন’ (‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’) বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রুটি দাও (‘হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি,/রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি’) তো বহুলপরিচিত, পঠিত। ৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে দু’দুটো ছবি আছে বাংলায়— আকালের সন্ধানে, অশনি সংকেত। মন্বন্তর নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, প্রবোধকুমার সান্যাল, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন সচেতন ভাবে, অকপটে। কে-ই বা ভুলতে পারে চিত্তপ্রসাদ, জয়নাল আবেদিন, সোমনাথ হোর, সুনীল জানাদের আঁকা ছবিগুলি? আছে পঞ্চমিত্রের ১৯৬০ সালের ছবি খিদে। উত্তমকুমারের তথাকথিত মেনস্ট্রিম সিনেমাতেও অনেক সময়ই ক্ষুধা একটা মোটিফ। আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, সুবিমল মিশ্রদের লেখা। মৃণাল সেনের কলকাতা ৭১। আর সবার উপরে আছে গুপী গাইন বাঘা বাইন। বলা ভাল, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছায়ায় রচিত ক্ষুধার রাজনীতি নিয়ে আশ্চর্য এই ফ্যান্টাসিতে আছে কঙ্কালসার সৈনিকদের পেট পুরে ভোজনের আশ্বাস পেয়ে যুদ্ধ ভুলে যাওয়ার মনভোলানো রূপক। আর আছে জেলে আটকে পড়া ভূতের বরপ্রদত্ত দুই বন্ধুর ভোজন দেখে বাইরে রক্ষীরূপী নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের নিঃশব্দ, বুভুক্ষু আর্তের অবিস্মরণীয় চাহনি।
কিন্তু নিয়োলিবারাল মধ্যবিত্ত সেই চাহনি থেকে, সেই আর্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে এখন সম্পূর্ণ ডুব দিয়েছে ফেনিল ফোটোগ্রাফিতে। গত কয়েক দশকে খাদ্য ও ক্ষুধার্তের মধ্যের দূরত্ব যতটা বেড়েছে, মধ্যবিত্তের আশেপাশে ভোগের মোটা প্রাচীর বেড়েছে তার দ্বিগুণ, বুভুক্ষুজন তলিয়ে গিয়েছে অপটিক্স-এর আড়ালে। বিষণ্ণতার ত্রিভুজ!
নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়। গণতন্ত্র তার স্বমহিমায় ভাস্বর হয়, অথবা নিষ্করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে পাহাড় থেকে সাগর অবধি বিস্তৃত এই জনপদের দিকে, বিভিন্ন দলের স্বার্থ এসে মিশে যায় রাজনীতির খিচুড়িতে, আর তাতে ঘি ঢেলে মিডিয়া আর মধ্যবিত্ত আবারও কব্জি ডুবিয়ে পেট পুরে খেতে বসবে। নিঃস্বদের জন্য থাকবে সার্ভে আর ডেটা। এই খাওয়া না-খাওয়ার পালা চলতেই থাকবে নিরন্তর। তার ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যের জন্ম হবে— সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে উপচে পড়া ভোজ্যের ঠিক পরের ছবিতেই থাকবে অপুষ্ট কিশোরের ছবি। আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে এগিয়ে যাব স্ক্রল করে।
আম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy