Advertisement
E-Paper

বাঙালি চেতনা ও মননশীলতা দিয়ে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত

তবে, এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়েই পুরোটা ধরা যাবে না। এবং এখানেই এই সব সম্পর্কের বিশেষত্ব।

সুমন ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২১ ০৬:৩৭
Share
Save

২০১৮ সালের এক বিকেলে নন্দন প্রেক্ষাগৃহে দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং-এর পর প্রশ্নোত্তর পর্বে আমার বাঁ দিকে বসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আর ওঁর পাশে অমর্ত্য সেন। প্রচুর মিডিয়া ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমাবেশ। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া জরুরি বলে মনে হল আমার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বয়সের দিক থেকে অমর্ত্য সেনের থেকে দু’বছরের ছোট। অথচ, আমার সম্বোধনে উনি ‘কাকু’ আর অমর্ত্য ‘দা’। এটা যে অ্যাকাডেমিক ট্র্যাডিশন— এই যে সিনিয়র বাঙালি অ্যাকাডেমিশিয়ানদের ‘দা’ বলে সম্বোধন করাটা, সে তিনি নোবেল লরিয়েটই হন, আর চল্লিশ বছরের সিনিয়র হন, এটা যদি না বলে দেওয়া হয়, তা হলে হয়তো অনেকেই ভাববেন যে, এ ছেলের স্পর্ধা তো কম নয়। মজার কথা হল, তার ঠিক পরেই অমর্ত্যদা মাইকে বললেন যে, “শান্তিনিকেতনি প্রথা যদি মেনে চলি, তা হলে ‘দা’টা ‘দাদামশাই’ও হতে পারে।” দর্শকও তাঁর তাৎক্ষণিক রসবোধে তালি দিয়ে ওঠেন। আমার লেখাটা শুরু করার আগে এই ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ জরুরি মনে হল। যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের কাছেও যাতে আমার স্পর্ধার অবকাশ না থাকে।

নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমার দুই পেশার— অর্থনীতি ও চলচ্চিত্র— দুটো ক্ষেত্রেই এই দু’জন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশতে পেরেছি। অনেক কিছু দেখেছি, দেখতে দেখতে শিখেছি। অমর্ত্যদার কাজের প্রতি সৌমিত্রকাকুর যে শ্রদ্ধা, সেটা তিনি আমার কাছে বহু বার উল্লেখ করেছেন। কোনও এক ইন্টারভিউতে নাকি তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সৌমিত্রকাকু তার প্রতিবাদে বলেন, “অমর্ত্য সেনের মতো বাঙালি থাকতে আমাকে এই সম্মান দেওয়াতে নিজেকে খুব লজ্জিত বোধ করছি।” যখন নন্দনের ওই স্ক্রিনিং-এর আগে আমি সৌমিত্রকাকুকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানাই এবং বলি যে, উদ্যোক্তারা আপনাকে চিফ গেস্ট হতে বলেছেন, উনি আমাকে বলেন, “সুমন, আমাকে কি কিছু বলতে হবে? ওই ভদ্রলোকের সামনে আমার কিছু বলতে কী রকম বাধবে।” আমি হেসে বলি, আপনি আসুন না। অপর দিকে, অমর্ত্যদার সঙ্গে যখন সৌমিত্রকাকুর ব্যাপারে কথা হয়েছে, আমি এটা অনুভব করেছি যে, অভিনেতা হিসেবে শ্রদ্ধা ছাড়াও কাকুর প্রতি ওঁর একটা ভ্রাতৃত্ববোধ আছে। নন্দনের সেই অনুষ্ঠানে যখন দু’জনের দেখা হয়, সেখানে সৌমিত্রকাকুকে দেখেছি অমর্ত্যদার সামনে কী রকম বাধ্য ছেলের মতো হয়ে যেতে। অমর্ত্যদাও তাঁকে দেখে ভারী খুশি হলেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “সম্বিৎ কেমন আছে?” সৌমিত্রকাকু বললেন, “দাদা তো আর নেই। দু’বছর হল।” সৌমিত্রকাকুর দাদা সম্বিৎ, অমর্ত্যদার সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। তাঁরা এক সঙ্গে একটা পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। তাই সৌমিত্রকাকু অমর্ত্যদার কাছে ছোট ভাইয়ের মতো। এত দিনে বুঝতে পারি তাঁর ভ্রাতৃত্ববোধের কারণ।

তবে, এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়েই পুরোটা ধরা যাবে না। এবং এখানেই এই সব সম্পর্কের বিশেষত্ব। ভেবে দেখেছি, এই দুই বাঙালির মধ্যে অদ্ভুত মিল। প্রথমত, এঁরা দু’জনেই রবীন্দ্র-চেতনায় উজ্জ্বল। এঁরা দু’জনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগ্য উত্তরসূরি, তা বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। তাঁর দর্শন, ধ্যানধারণা দু’জনকেই ভীষণ প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয়ত, এঁরা দু’জনেই একই ইতিহাসের ভিতর দিয়ে গিয়েছেন। বাঙালির ইতিহাসের অন্তত দুটো এমন ঘটনার কথা আমি জানি, যা দু’জনকেই খুব প্রভাবিত করেছিল।

এক, ১৯৪৬-এর ‘বেঙ্গল রায়টস’। এবং দুই, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর। অমর্ত্যদা তাঁর নোবেল লেকচারে প্রথম বিষয়টির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন— “শিশু বয়সে আমাকে সেই নির্মম হিংসার কিছু দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। ঢাকায় এক বিকেলে, এক জন পুরুষ সদর দরজা দিয়ে মর্মান্তিক চিৎকার করতে করতে ঢুকে আসেন। তাঁর শরীর দিয়ে প্রচণ্ড রক্তপাত হচ্ছিল। সেই আহত মানুষটি, যাঁর পিঠে ছুরি মারা হয়, ছিলেন এক মুসলিম দিনমজুর, নাম কাদের মিয়াঁ। এক প্রতিবেশীর বাড়িতে তিনি কোনও কাজ করতে এসেছিলেন সামান্য কিছু টাকার জন্য, আর আমাদের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার রাস্তায় জনাকয়েক সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতী তাঁকে ছুরিকাঘাত করে... এই অভিজ্ঞতা আমাকে বিধ্বস্ত করে দেয়, আর আচমকা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করা ব্যক্তি-পরিচয় এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যে যে তীব্র বিভাজনের মানসিকতা প্রোথিত থাকতে পারে, তার বিপদ সম্পর্কে আমাকে সচেতন করে তোলে।”

সৌমিত্রও কত বার বলেছেন সেই ১৯৪৬-এর ‘ক্যালকাটা কিলিংস’-এর কথা। খুব গভীর ভাবে তাঁকে নাড়া দিয়েছিল সেই ঘটনা। দাগটা এতটাই গভীর ছিল যে, এঁদের পরবর্তী জীবনে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব হওয়াটা ছিল এঁদের প্রথম কাজ। পরবর্তী কালে দু’জনেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বার বার রুখে দাঁড়িয়েছেন।

আর বাংলার মন্বন্তর? অমর্ত্য লিখেছেন, “১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষে কুড়ি থেকে তিরিশ লক্ষ মানুষ মারা যান, তখন আমি শান্তিনিকেতনে। এখনও সেই স্মৃতি আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। এর আগাগোড়া শ্রেণি-নির্ভর চরিত্র আমাকে সে দিনও আশ্চর্য করেছিল।” সৌমিত্র আমায় বলেছিলেন যে দুর্ভিক্ষে তাঁর বাড়ির সামনে “মা, ফ্যান দিবি, একটু ফ্যান”— এই ডাকটা, সামান্য একটু ভাতের ফ্যান চাওয়ার করুণ আকুতি তাঁকে এখনও পীড়া দেয়। তার বহু বছর পরে অমর্ত্যদা তাঁর পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন্‌স বইটা লেখেন। দুর্ভিক্ষ আটকাতে তাঁর গবেষণা সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেয়।

অন্য দিকে, বিশ্বের চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত ছবিটি যখন সাড়া জাগাচ্ছে, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন বেয়ার’ সম্মান পায়, সেই ছবির মুখ্য চরিত্রে সৌমিত্রর কী মননশীল অভিনয়! দুই পৃথক ও নিজস্ব কর্মজগতে বিচরণ করলেও এঁরা চিন্তায়, ভাবনায় কোথাও যেন এক। এক সময় যে চেতনা ও মননশীলতার জন্য বাঙালি অগ্রগণ্য ছিল, সেই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে আমরা এঁদের পাই।

আর এই জন্যই মনে হয়, এই দু’জনের সম্বন্ধে এই মুহূর্তে ভাবাটা জরুরি। যখন বাংলার ঐতিহাসিক আইকনদের নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তখন এই দু’জন বোধ হয় সাম্প্রতিক কালের বাংলার অন্যতম প্রধান আইকন। বাঙালি হিসেবে যদি আন্তর্জাতিক মানের সাড়া-জাগানো মানুষ এখনও থেকে থাকেন, তা অমর্ত্য সেন ও সদ্যপ্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে যে বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, তা আমরা যেন না ভুলে যাই।

অর্থনীতি বিভাগ, ফ্লরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটি

soumitra chatterjee Amartya Sen

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy