—প্রতীকী চিত্র।
অতীতে অ্যান্ড্রু ফ্রেজ়ারের সময়ে বাংলাকে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল, বঙ্গীয় অস্মিতার সঙ্গে আইরিশ স্বকীয়তার তুলনা টেনে। তাঁর মতো ঔপনিবেশিক শাসকের চোখে বাংলা ছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশের থেকে পৃথক, অনেক বেশি প্রতিবাদী। ব্রিটিশ শাসকদের প্রয়োজনেই, লর্ড কার্জ়ন নন, বরং ফ্রেজ়ার ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনায় বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই সময় থেকে ঔপনিবেশিক শাসক বাঙালি প্রতিবাদী সত্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে, যদিও এই প্রতিবাদী মানসিকতা বড় প্রাচীন।
অষ্টাদশ শতকের যুগসন্ধিকাল, বাংলার সমাজে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধিষ্ঠান। জাতপাতের মায়ানিগড় রক্ষার দায় নিয়ে জাতিচ্যুতির দণ্ড হাতে সমাজ শাসন করছেন তিনি। তাঁর স্বৈরাচারী সমাজপতিত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, তৎকালীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক। ন্যায়ধর্ম ও রাজধর্মের বিরোধে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বনের কাজ বাঙালি পণ্ডিতেরা অতীতে বহু বার করেছেন; আধুনিক বুদ্ধিজীবিত্বের বহু আগে থেকেই, রাষ্ট্রের ন্যায়গত অসংলগ্নতার বিরুদ্ধে, সমাজরক্ষার দায় হিসাবে। কিন্তু ন্যায়ের ঔজ্জ্বল্যের কাছে রাজসিকতা চিরকাল মাথা নুইয়েছে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কৃষ্ণচন্দ্রকেই মাথা নোয়াতে হয়েছিল কপর্দকহীন নৈয়ায়িক বুনো রামনাথের কাছে। রাজা ‘অনুপপত্তি’ বা অনটন দূর করার মানস প্রকাশ করেছিলেন, সনির্বন্ধে তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। কৃষ্ণচন্দ্র রাজমুকুট রামনাথের পায়ে রেখেছিলেন। যুগ বদলেছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় শিক্ষককে এখন রাজানুগ্রহ ভিক্ষা করতে হয়; পরিশেষে ভিক্ষাপাত্রও শূন্য থাকে। কৃষ্ণচন্দ্র রাজপুরুষ হলেও তাঁর পারম্পরিক সৌজন্য বঙ্গীয়, শিক্ষানুরাগীর সামনে মাথা নোয়াতে দ্বিধা করেননি।
বর্তমান রাজপুরুষ কি বঙ্গভূমির উপযোগী সৌজন্যবোধের অধিকারী? আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বাংলার নন, তাই সে দায়ও তাঁর নেই। বাঙালির ন্যায় রক্ষার ভার এখনকার কৃষ্ণচন্দ্র ও রামনাথদের হাতে। বাঙালি ঐতিহাসিক ভাবেই কেন্দ্রিকতাবিরোধী; সে তার সামূহিক আত্মকে ভারতীয়ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, আবার বৃহত্ত্বের মাঝে স্বকীয়তাকে বিলীন হতে দেয়নি। এই বঙ্গীয় অস্মিতা যতখানি রাজনৈতিক, তারও বেশি সাংস্কৃতিক। হর্ষের বিরোধাচারী শশাঙ্ক থেকে মোগল জয়তিলকবিমোচী প্রতাপাদিত্যের মতোই এই অস্মিতার অপর বাহকেরা হলেন বঙ্গীয় বিদ্বৎসমাজ।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্র ধরেই বলা যায়, সর্বভারতীয় আন্দোলনের মধ্যে থেকেও বঙ্গীয় অস্মিতার রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু। বিদেশি প্রশাসনের রক্তচক্ষুর সামনে ধূলিধূসরিত খড়ম তুলে-ধরা বিদ্যাসাগরের প্রজন্মগত দায় তাঁরা অস্বীকার করেননি।
স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাদ্গামী রাজ্য হিসাবেই যাত্রা শুরু করে। বিরূপ পরিস্থিতিতেও সে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছিল পূর্বায়ত্ত ন্যায়ধর্মের বলেই। সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপর স্থাপিত এই অস্মিতার কথা অনেকেই স্বীকার করেছেন; অন্তত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই। ২০২১-এর নির্বাচনী ফলাফলের পর ‘বাঙালি অস্মিতা’-র সামনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরাজয় আলোচনার বিষয় হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক, মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপের ঘটনাপরম্পরা বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির দখল নেওয়ার রাজনৈতিক লড়াই হিসাবেই ফিরে আসছে কি? শিক্ষা-সংস্কৃতির সর্বশেষ স্তম্ভটিকে ধ্বংস করাই কি তবে আগ্রাসী রাজধর্মের শেষ ইচ্ছা?
বলতে বাধা নেই, এই আক্রমণ শুধু বাঙালির শিক্ষার ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং বাঙালি স্বকীয়তা তথা অস্মিতার বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক যুগে বিভাজনের প্রক্রিয়াটি ছিল স্থানিক; সাংস্কৃতিক বিভাজনের পরিকল্পনা তখনও হয়নি। এখন বিতর্কের জায়গা নিয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ নিয়ে: এক পক্ষ ২০ জুন দিনটি চায়, দেশভাগের বেদনা লঘু করে সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বিভাজনকে মান্যতা দিতে চায়। অন্য পক্ষ, বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য হিসাবে দেখতে চায় পয়লা বৈশাখকে, নিঃসন্দেহে বাঙালি মানসের সঙ্গে যার যোগ।
বঙ্গদিবস সংক্রান্ত যাবতীয় ইতিহাস শুরুই হয়েছিল কেন্দ্রাতিগ প্রবণতার বিরোধ হিসাবে, সে ইতিহাস আমরা ভুলে গেলাম কী করে? সুভাষচন্দ্র ত্রিপুরী কংগ্রেসে গান্ধীপন্থীদের অযাচিত বিরোধের সম্মুখীন হন, ১৯৩৯-এ ২ এপ্রিলকে সর্ববঙ্গ দিবস ঘোষণা করে বাংলার কংগ্রেস নেতৃত্ব। রাজনৈতিক অতীতে বঙ্গদিবসের সঙ্গে যে বঙ্গীয় অস্মিতার কথাটি জুড়ে রয়েছে, তা ভুলে গিয়ে বিয়োগান্তক এক সময়কে নির্দেশ করে সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদসাধন কল্পনা মূঢ়তার পরিচয়, বা বঙ্গীয় অস্মিতার সাংস্কৃতিক মূলবিন্দুকে আঘাত করে বা ভুলিয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রাথমিক পদক্ষেপ। শিক্ষাকে ভুলিয়ে দিতে পারলে এই সাংস্কৃতিক অতীতচর্চা ভুলিয়ে দেওয়া সহজ হবে, উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় আগ্রাসন কি এরই গোড়ার ধাপ? যদি হয়ে থাকে, তবে তা আটকানোর দায় শিক্ষাজীবীদেরই।
বাংলায় শিক্ষাজগতে বিতর্ক-সংঘাত, রাজনীতি-যোগও বহু বার ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বঙ্গীয় স্বকীয়তা টিকে থেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে অবিভক্ত বাংলার দু’দিকের বিদ্বজ্জনদের বিতর্কের মধ্যেও বঙ্গীয় অস্মিতা অটুট ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিদারদের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেখে অনেক ইসলামি ঐক্যপন্থী নেতা আশা করেছিলেন, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তুল্য একটি কলেজ পেলেই পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার প্রসার হবে, সর্বভারতীয় মুসলিম জনসমাজে একত্রিত করা যাবে মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গকেও। সেই ইসলামি সাম্প্রদায়িক চেতনাকে সে দিন ছাড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালি মুসলমানের বঙ্গীয় অস্মিতা। বাংলার অভ্যন্তরীণ শিক্ষাবিতর্কে সে দিন তাঁরা অবাঙালি সাম্প্রদায়িকতাকে অনেকাংশে রুখে দিয়েছিলেন। আজও— বাংলার অভ্যন্তরীণ শিক্ষায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে, বঙ্গীয় অস্মিতা ভূলুণ্ঠিত করে কেন্দ্রাতিগ যূপকাষ্ঠে বাঙালি তার আত্মসম্মান বলি দেবে কি না ভেবে দেখুক। দলমত নির্বিশেষে, ন্যায়ধর্মকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে কি না দেখুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy