Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
তখনও দোলের রঙে মাতোয়ারা হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান, এখনও
Holi 2023

বসন্তের সুরে বহুত্বের স্বর

ভক্তের হোলি খেলার এক অন্য রূপ বর্তমান কালে দেখা যায় ওয়ারিশ আলি শাহের দরগায়, উত্তরপ্রদেশের বারাবঁকীর দেওয়া শরিফে।

A Photograph representing Holi

দোলে রঙের ব্যবহার যেন ঐশ্বর্য বা সমৃদ্ধি হিসেবে বিস্তার ঘটায়। ফাইল ছবি।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৩ ০৪:১৫
Share: Save:

মহারাষ্ট্রের ভক্ত চোখামেলা। জাতিতে ‘মাহার’ বা ‘মহর’। এই জাতি থেকেই উঠে এসেছিলেন বি আর অম্বেডকর। জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কাছে অস্পৃশ্য দলিত এই মাহার। ওঁদের কাজ মৃত গবাদি পশুর দেহ সরানো। এই জাতির মানুষদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু চোখামেলা যে পণ্ঢরপুরের বিঠোবা, অর্থাৎ বিষ্ণুর মহাভক্ত। তিনি মন্দিরের বাইরে থেকেই ঈশ্বরকে নামগান শোনান, পরে ঈশ্বরের ডাকেই গভীর রাতে মন্দিরে প্রবেশ করেন। কিন্তু এ দৃশ্য সয় না পুরোহিতদের। বেদম প্রহার। জনশ্রুতি, স্বয়ং ঈশ্বরের মূর্তি রক্তাক্ত হল! অথচ, এই মহারাষ্ট্রেই আঞ্চলিক ভাবে হোলি বা হোলাকা উৎসবে তথাকথিত অস্পৃশ্যদের স্পর্শ করতে হয় মরাঠি কোঙ্কণি ব্রাহ্মণদের। আবার ভাগলপুরে এই উৎসবে অগ্নি সংযোগের অধিকার ডোম জাতির মানুষদের।

তা যা-ই হোক, এ-হেন ভক্ত চোখামেলার ঘরে বসন্তোৎসবের আগে স্বয়ং বিঠোবা দেখা দিলেন। ঈশ্বর বিরক্ত খুবই, “এদের (জনতার) মামুলি হোলি খেলায় আমার প্রেম তৃপ্ত হয় না। তাই তোমার সঙ্গে হোলি খেলতে এলাম।” কিন্তু কী দিয়ে হোলি খেলা হবে! চোখামেলা চাইলেন, হৃদয়ের শোণিতে ঈশ্বরের চরণ রাঙিয়ে দিতে। তা-ই ঘটল। পাথর চাপা পড়ে মৃত্যু হল চোখার। কিন্তু জনশ্রুতি, দলে যাওয়া রুধিরাক্ত দেহটা থেকে তখনও শোনা যাচ্ছিল নামগান। আর সেই রাতেই পুরবাসী শুনলেন চোখার ভজন, “প্রভু, এত দিনে আমার হোলি খেলা সম্পূর্ণ হল।”

ভক্তের হোলি খেলার এক অন্য রূপ বর্তমান কালে দেখা যায় ওয়ারিশ আলি শাহের দরগায়, উত্তরপ্রদেশের বারাবঁকীর দেওয়া শরিফে। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সেখানে আরাধনা করে, ধ্বনিত হয়, ‘যা রব, তা-ই রাম’। তবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে হোলির সম্পর্কটি রাজ-আভিজাত্যে মোড়া। হুমায়ুনের রাজত্বকালে টানা ১৯ দিন ধরে চলেছে উৎসব। আর সেখানে নৃত্য-গীত পরিবেশন করেন দেশের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীরা। আবার পারস্য দেশের নওরোজ়ের সঙ্গে মিশিয়ে এ দেশের বসন্তোৎসবে নতুন মাত্রা আনলেন সম্রাট আকবর। মোগল চিত্রকর গোবর্ধনের ছবিতেও দেখা যাচ্ছে, জাহাঙ্গির গোলাপ জল ও আবির নিয়ে সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের রং খেলায় মাতোয়ারা। আইন-ই-আকবরি থেকেও জানা যায়, মোগল রাজসভা কেমন ভাবে বার বার রঙের বন্যায় রঙিন হয়েছে।

দলিত এবং ইসলামের সংস্কৃতির অনুষঙ্গ দিয়ে হোলির কথা শুরু করার একটাই কারণ। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, ভারতবর্ষের, হিন্দুর সংস্কৃতি যে বহুত্বেরই উদ্‌যাপন, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই দোলযাত্রা, হোলি এবং বসন্ত ঋতুটি। পাশাপাশি, এই ঋতুটিই বুঝিয়ে যায়, যে ‘আর্যামি’ নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার সংস্কারের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে অনার্যের নিঃশ্বাস।

এই আর্য-অনার্যের বিষয়টিতে যাওয়ার আগে ‘দোলযাত্রা’ শব্দটির দিকে তাকানো যেতে পারে। এটি দোল এবং যাত্রা, দু’টি শব্দের সমাহার। দোল, অর্থাৎ দোলন এবং যাত্রা, অর্থাৎ গমন। এই যাত্রা বিশেষ ব্যক্তির বা দেবতার এবং বহুজনের অনুগমন। কিন্তু কে বা কার দোলন? সূর্য। ভারতের প্রাচীন ঋষিরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় সূর্যের উত্তরায়ণ হত। এই সূত্রটি মাথায় রেখে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জানাচ্ছেন, একদা আমাদের আর্য সভ্যতা পঞ্জাবের দিকে ছিল। সেখানে খুবই ঠান্ডা। সূর্য উত্তর দিকে যত আসতে থাকে, তাপ ও আলো তত বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে জড়ত্বের অবসানে চাঞ্চল্যের সূত্রপাত ঘটে। ঘটনা হল, এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই ‘বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া’ আবির্ভূত হলেন চৈতন্যদেব। আর তাঁর সূত্রে দোল হয়ে উঠল এক সাম্যের উৎসব। “ফাল্গুনে আনন্দ বড় গোবিন্দের দোলে।/ কান্ত বিনু অভাগী দুলিবে কার কোলে” (লোচনদাস)। আর সে সঙ্গেই যেন মিলে-মিশে একাকার হয়ে যান সূর্য, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, চৈতন্যদেব আর আমরা, ‘অভাগী’ জনতার দল।

এ-হেন দোলযাত্রার আগের রাতে হয় বহ্ন্যুৎসব। তাতে খড়, বাঁশ দিয়ে তৈরি অবয়ব পোড়ানো হয়। এ যেন জীর্ণ বছরের প্রতীককে ভস্ম করা হচ্ছে। বাংলায় এটিই চাঁচর বা ভেড়া ঘর পোড়ানো। বৈদিক মতে, যা পুড়ছে, অর্থাৎ ভস্মীভূত বস্তুটি ভাদ্রপদা নক্ষত্রের প্রতীক। ঋগ্বেদের ভাদ্রপদার নাম ‘অজ এক-পাদ’, অর্থাৎ একপেয়ে ছাগল। মেণ্ঢাসুর নামেই সেটির পরিচিতি। লোকের ধারণা, মেণ্ঢাসুরের বাধায় সূর্যের আগমনে দেরি হচ্ছে। সুতরাং, জনসাধারণের সংগ্রামও এই অসুর-শক্তির বিরুদ্ধে। অবশেষে উত্তরায়ণের সূচনা যেন সূর্যের সঙ্গে মানুষের আত্ম-জয়ের উদ্‌যাপনের প্রতীক। তবে এই বহ্ন্যুৎসবের মধ্যে শাস্ত্রীয় কিছু ব্যাখ্যাও রয়েছে। হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা দেবতাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন যে, তিনি আগুনে দগ্ধ হবেন না। বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যা করতে তিনি তাঁকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেন এবং শেষে নিজেই পুড়ে যান। আসলে বরটির শর্ত ছিল, হোলিকাকে একা আগুনে প্রবেশ করতে হবে। বহ্ন্যুৎসব তাই এই হোলিকা দাহের প্রতীকও বটে। এই প্রতীকের মাধ্যমে ঘোষিত হয় পাপের বিরুদ্ধে পুণ্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয়ের ধারণাটি।

দোলে রঙের ব্যবহার এই ধারণাটিরই যেন ঐশ্বর্য বা সমৃদ্ধি হিসেবে বিস্তার ঘটায়। দোলযাত্রায় লাল রঙের ব্যবহার নিয়ে যোগেশচন্দ্র জানাচ্ছেন, “ঋগ্বেদে সবিতা হিরণ্য দ্যুতি, হিরণ্য— তাহার রথ হিরণ্ময়। শীতকালে বাল রবি হিরণ্ময় দেখায়, লোহিত বর্ণ দিয়া তাহা জ্ঞাপিত হয়। এই রূপে দোলৎসব ফাগুৎসব হইয়াছে।”

পাশাপাশি, অনার্য সংস্কৃতি থেকেও একটি ব্যাখ্যা হাজির করা যায়। ছোটনাগপুরে ওরাওঁদের মধ্যে প্রচলিত ‘ধুয়েত শিকার’ এবং ‘ফাগু সেন্ড্রা’। লাঙল দিয়ে মাটি চষা, এই হল ধুয়েত শিকার। আর ফাগু সেন্ড্রা হল শিকার উৎসব। আবার ভুটিয়াদের রোপাই উৎসবের প্রধান উপকরণ আবির। সর্বত্রই আবির প্রজনন শক্তির প্রতীক। প্রতীকটির সঙ্গে লগ্ন বিশ্বাস, সমৃদ্ধি আসবে সংসারে ও খেতে। আর্য সভ্যতায় অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সমৃদ্ধির এই উপকরণটি গৃহীত হয়েছে।

বস্তুত, বসন্ত সামগ্রিক ভাবে একটি সমৃদ্ধিরই ধারণা। ফের যেতে হয় অনার্য সংস্কৃতির কাছে। ওড়িশার কন্ধ জনজাতির মধ্যে ‘মেরিয়া সংহার’ নামে একটি রীতি রয়েছে। তা উপলক্ষে মদ্যপান, যথেচ্ছ যৌনতার একটি সম্পর্ক আছে। এর কারণ, জাতিটি বিশ্বাস করে, পৃথিবী মা শস্যের মধ্যে দিয়ে মানুষকে প্রাণশক্তি দিয়েছেন। তাঁরা ‘সংহার’-এর মাধ্যমে (প্রথমে নরবলি, পরে মহিষবলি) সেই প্রাণশক্তি ধরিত্রীকে অর্পণ করছে। সঙ্গে রয়েছে, জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির অভিপ্রায়ও। মেরিয়া সংহার রীতিতে পাশাপাশি, মানুষের ‘অবাধ কামচেষ্টা’র ইচ্ছাও প্রত্যক্ষ হতে পারে। (হিন্দু সমাজের গড়ন: নির্মলকুমার বসু)

এ সূত্রেই আসে বসন্তের একটি প্রাচীন উৎসবের কথা। কামশাস্ত্রে বলা হচ্ছে, বসন্তে ‘মদনোৎসব’ ছিল বিশেষ জনপ্রিয়। ভবভূতির মালতীমাধব নাটক জানাচ্ছে, উৎসবটি হত মদন উদ্যানে। সেখানে এক প্রান্তে থাকত কামদেবের মন্দির। নৃত্য-গীত, পুজো ইত্যাদি হত। হর্ষদেবের রত্নাবলী নাটকেও উৎসবটির বর্ণনা রয়েছে। ঘটনা হল, বসন্তের সখা কামদেব। আর এই কামদেবের পাঁচটি বাণ, পদ্ম, অশোক, আম, নবমল্লিকা, নীলপদ্ম। এদের নাম যথাক্রমে উন্মাদন, তাপন, শোষণ, স্তম্ভন ও সম্মোহন। বস্তুত, জনসাধারণের মধ্যে কাম ও যৌনাচার নিয়ে যেখানে ‘স্থূল ভাবনার’ আশঙ্কা, সেখানেই কামকে এ ভাবে এক স্নিগ্ধ রূপে হাজির করা হচ্ছে। এক কথায় পুরো বিষয়টিকে সংহত করার পরামর্শ দেওয়া যেন।

কিন্তু জনজীবনে এমন সংহত চিত্র ছিল না, অন্তত কলকাতায়! সাবেক কলকাতার মূল দোলযাত্রাটি হত লালদিঘিতে। গোবিন্দপুরের শেঠ পরিবার এটি খনন করিয়েছিল। সেখানকারই এক বারের ঘটনা। দিঘির জলে আবির গোলা হচ্ছে। ও-দিকে তখন জোব চার্নকের দল সুতানুটি ঘাটে বজরার চালাঘরে দিন কাটাচ্ছে। কোম্পানির কয়েক জন ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন লালদিঘির পাড়ে। আবির আর রঙের এমন রঙিন খেলায় তাঁরা যোগ দিতে চাইলেন। কিন্তু ফিরিঙ্গিদের মারধর করে ফিরিয়ে দিলেন হিন্দুরা। খবর শুনে রেগে লাল জোব চার্নক। ঘোড়ার চাবুক হাতে স্বয়ং হাজির তিনি। মার খেলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কর্মচারী অ্যান্টনি কবিয়ালের ঠাকুরদা। কষ্টে অপমানে তিনি আশ্রয় নিলেন কাঁচড়াপাড়ায়।

তবে সাহেবদের সঙ্গে হিন্দুর বৈরিতা দীর্ঘস্থায়ী হল না। বণিক ইংরেজের হাতে অর্থনীতির মানদণ্ড গেল। ১৭৮৭-তেই কোম্পানি বাহাদুর দোল উপলক্ষে পাঁচ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। বেলজিয়ান শিল্পী ফ্রান্স বালথাজ়ার সলভিন্সেরদ্য হিন্দুজ়-ও জানাচ্ছে, দোলের আমোদে কী ভাবে এক সুরে আনন্দে মেতেছে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান।

অর্থাৎ, বসন্তে সব সংস্কৃতির মেলবন্ধন যেমন আছে, তেমনই তা মানবমনের এক ধরনের আনন্দের কথাও বলে। আর সে কথায় প্রাণেরই আহ্বান: ‘বসন্তঃ প্রাণায়নো। গায়ত্রী বাসন্তী’ (শুক্লযজুর্বেদ)।

অন্য বিষয়গুলি:

Holi 2023 Unity Festival of Colours
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE