Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
বাঙালি কতটা জানে তামিল ‘ক্লাসিক’ সাহিত্য-কে, এই ভারতকে
Tamil Classics

এই সব মণিমুক্তো

আশ্চর্য অন্যত্র। অরুলমোজলি দেখলেন, যুদ্ধে শেষ অবধি কোনও পক্ষই জেতেনি। দক্ষিণে অনুরাধাপুর থেকে উত্তরে সিঙ্গগিরি অবধি বাণিজ্যপথটা যেমন!

An image of the film

ধ্রুপদী: মণিরত্নমের পোন্নিয়ান সেলভান ১ ছবির দৃশ্য। ফাইল ছবি।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৩ ০৬:০১
Share: Save:

এত দিনে শ্রীলঙ্কা বুঝল, প্রজাকল্যাণ ও বাণিজ্যের সঙ্গে ধর্মের কোনও একমাত্রিক সম্পর্ক নেই। এখানকার বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের চোল আর পাণ্ড্য রাজাদের লড়াই লেগেই থাকত। কখনও এঁরা জিততেন, কখনও ওঁরা। তাঞ্জোরের শৈব রাজা সুন্দরচোল একদা এ দেশের অনেকটা জয় করে নিয়েছিলেন। এখন তিনি বৃদ্ধ, নিজের প্রতিনিধি হিসাবে ছোট রাজকুমার অরুলমোজলিকে এ দেশে পাঠিয়েছেন। বড় রাজকুমার কারিকালান এখন যুবরাজ, তিনি ভারতেই। শত্রু পাণ্ড্য রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত।

আশ্চর্য অন্যত্র। অরুলমোজলি দেখলেন, যুদ্ধে শেষ অবধি কোনও পক্ষই জেতেনি। দক্ষিণে অনুরাধাপুর থেকে উত্তরে সিঙ্গগিরি অবধি বাণিজ্যপথটা যেমন! অনুরাধাপুর থেকে ডাম্বুলা অবধি চোল সেনাদের অধিকারে। তার পর বাকিটা শ্রীলঙ্কার রাজাদের নিয়ন্ত্রণে। রাজকুমার অরুলমোজলি প্রথমেই এই রাস্তাটা নিষ্কণ্টক করলেন। সাধারণ জনগণ থেকে সার্থবাহ যে কেউ যখন তখন এই রাস্তা বেয়ে যেতে পারে। সেনারা বাধা দেবে না। শত্রু দেশে, যে বৌদ্ধ বিহারগুলি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলি ফের নতুন করে সারিয়ে দিলেন। কেন? দেশ থেকে আসা তাঁর বন্ধু বান্দিয়া দেবনকে সেটা বুঝিয়েও দিলেন, “রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে কখনও মিশিয়ো না বন্ধু। ধর্মের ভিত্তিতে এক পক্ষকে সমর্থন করলে অন্যরা ক্ষুব্ধ হয়, রাজধর্মের ব্যত্যয় ঘটে।” বান্দিয়া দেবন অবাক, কিন্তু শ্রীলঙ্কার রাজারা এত বিশাল বিশাল বিহার তৈরি করেন কেন? অরুলমোজলি ফের হাসলেন, “থাকতে থাকতে বুঝে যাবে। প্রথম দিকে রাজারা বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ভাবতেন, ধর্মের জন্যই এ সব বিহার তৈরি করতেন। পরের দিকে রাজারা ধর্মের চেয়েও আত্মপ্রচার বেশি চেয়েছেন, তাই এই সব পেল্লায় সৌধ বানিয়েছেন।”

গল্প এখানেই শেষ নয়। সেনাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও সামন্তরা গোপনে ঠিক করে, বৃদ্ধ সম্রাটের মৃত্যুর পর শান্তি-স্থিতি বজায় রাখতে চোল রাজ্যকে দু’ভাগ করতে হবে। ভেলার নদীর উত্তরে থাকবে কারিকালান, দক্ষিণে নাগাপট্টিনাম, কাঞ্চিপুরম ও শ্রীলঙ্কায় অরুলমোজলি। কিন্তু অরুলমোজলি ও তার দাদা কারিকালান দু’জনেই রাজ্যভাগে নারাজ। রগচটা যুবরাজ প্রথমেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, “দেশভাগ কেমন জানেন? বিবাহিতা স্ত্রীকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো। আপনার মতো তিন কাল পেরিয়ে আসা বুড়োরা এ সব ভেবে আনন্দিত হতে পারেন, আমি নই। দরকারে আমার ভাই গোটা রাজ্যের রাজা হবে।” আর অশক্ত, বৃদ্ধ সম্রাট সুন্দরচোল? তিনি চক্রান্তের কথা জানলেও সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভেবে সবাইকে ক্ষমা করেন। সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক জেনে তার ভাই কালান্তক তরবারির কোপে দাদাকে খতম করতে যায়। বিষণ্ণ সম্রাট শুধু বলেন,“এখানে রক্তারক্তি ঘটাবেন না। সেনাপতি বংশপরম্পরায় আমাদের সেবক, ওঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা আমার আছে।”

সাম্রাজ্য কি সত্যিই ভাগাভাগি হবে? জনতা উদ্বেল, রাজা অশক্ত ও বৃদ্ধ হলেও তাঁকে সবাই ভালবাসে। কাবেরী, ভাদাভার সব নদীতে যখন দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা আসে, সম্রাটের নির্দেশেই প্রজাদের সাহায্যের জন্য রাজকোষ অকাতরে খুলে দেওয়া হয়, ধর্মাধর্মের ভেদ থাকে না। বান্দিয়া দেবন এক দিন এক জ্যোতিষীকে বলেছিলেন, নরমুণ্ড গলায় কালামুখ বা কাপালিকদের দেখলে তাঁর বিরক্তি লাগে। তাঁর সাফ উত্তর, “কেন? তুমি-আমি তিলক কেটে ঘুরে বেড়াতে পারলে ওদেরও গলায় নরমুণ্ড ঝোলানোর অধিকার আছে।” এ দেশে বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালীর পাশাপাশি বৌদ্ধরাও নির্বিঘ্নে থাকেন, আরব, চিন দেশ থেকে বণিকরা আসেন। কিন্তু এই শান্তিভূমেও এখন সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে ঝড়ের গতিতে গুজব উড়ছে, কারা আসল চক্রান্তকারী না ভেবে জনতা যাকে পারে তাকে শেষ করে দিতে চায়। যে কোনও মুহূর্তে দাঙ্গা বাধতে পারে। অতএব প্রধানমন্ত্রী অনিরুদ্ধের গুপ্তচর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ সন্ন্যাসী, কেউ বা ডাকাতের বেশে। তাঁকে সব হালহকিকত জানতে হবে, দাঙ্গা বাধতে দেওয়া যাবে না।

তামিল লেখক কল্কির পাঁচ পর্বের ম্যাগনাম ওপাস পোন্নিয়ান সেলভান-এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে এই সব মণিমুক্তো। মণিরত্নমের সিনেমার কল্যাণে এখন উপন্যাসটার নাম প্রায় সকলেই জানেন। কেউ কেউ এও জানেন, এর আগে তামিল সিনেমায় এমজিআর থেকে কমল হাসন অনেকেই এই উপন্যাস সিনেমায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন, শেষ অবধি পারেননি। কী এমন আহামরি উপন্যাস, যা নিয়ে তিন প্রজন্মের সিনেমাওয়ালারা স্বপ্ন দেখেন? শুধুই ইতিহাসের চোল রাজত্ব নিয়ে তামিল অস্মিতা?

তামিল লেখক রামস্বামী কৃষ্ণমূর্তির শেষ উপন্যাস এটিই। রামস্বামী ১৯৪১ সালে কল্কি নামে এক পত্রিকা শুরু করেছিলেন, সেখানে ওই কল্কি নামেই রাজনীতি, সিনেমা, সঙ্গীত সমালোচনা থেকে ছোট গল্প, উপন্যাস লিখতেন। ওই পত্রিকাতেই ১৯৫০ থেকে ’৫৪ অবধি ধারাবাহিক ভাবে বেরোয় পোন্নিয়ান সেলভান। শুরু থেকেই এমন জনপ্রিয়তা পায় যে, পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। শুধু তামিল নয়, সদ্যস্বাধীন দেশে যে কোনও ভাষার পক্ষে ঈর্ষণীয় রেকর্ড!

বাঙালি অবশ্য মণিরত্নমের ছবির ঢের আগে থেকেই কল্কিকে চেনে। শিশিরকুমার দাশ ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে এই উপন্যাসকেই টেনে আনেন, “রাজরাজ চোল যেমন চোলবংশের প্রথম পুরুষ, কল্কিও সে রকম তামিল সাহিত্যে পথিকৃৎ। তাঁর সৌজন্যেই তামিলে কল্কিবংশ, মানে ঐতিহাসিক উপন্যাসের শুরু।” খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, কল্কি স্বাধীনতার আগে থেকেই তামিল সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। বাংলায় প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী যেমন! কল্কি নিজের কাগজ সম্পাদনার আগে এস এস ভাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাসন পরে জেমিনি স্টুডিয়ো তৈরি করেন, তাঁর হাত ধরেই চন্দ্রলেখা, নিশান ইত্যাদি হিট ছবির জন্ম। উদয়শঙ্করের কল্পনা-ও তৈরি জেমিনি স্টুডিয়োতেই। এ-হেন কল্কি স্কুলজীবনের শেষে, ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেলেও যান। মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে, গান্ধীর চিন্তাধারার প্রসারে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর সঙ্গে একটি কাগজ বার করতেন। ১৯৩৯ সালে ঘটালেন আর একটা ঘটনা, মাতৃভূমি নামে একটি তামিল ছবি। তামিলনাড়ুর এক ব্রাহ্মণের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। লোকটি লম্পট, হোটেলে খানা খায়, রক্ষিতাও আছে। মেয়েটি একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে বাবার কাছে চলে যায়। তার পরই পর্দায় আছড়ে পড়ে তামিলনাড়ুর এক গ্রাম, ওই ব্রাহ্মণের অনুপ্রেরণায় সেখানে সবাই চরকা কাটছে। মন্তাজে গান্ধীর মুখ। ভাসনের পরিবেশনায়, কল্কির লেখা কাহিনি নিয়ে ছবি। এবং মুক্তির পরেই সরকারি নির্দেশে নিষিদ্ধ! ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস বলছে, হলে মুক্তির পর ব্রিটিশ সরকার একটি ছবিকেই নিষিদ্ধ করেছিল, মাতৃভূমি

এমন ট্র্যাক রেকর্ড যাঁর, জীবনের শেষ উপন্যাসে তিনি কি ইতিহাসের আশ্রয়ে অন্য কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন পাঠককে? তামিল লেখকের সামনে তখন দেশভাগ, কাশ্মীরে পাক হানাদার, গান্ধীহত্যা, মাদ্রাজ প্রদেশ কেটে তেলুগুভাষী রাজ্যের জন্য পোট্টি শ্রীরামুলুর অনশন, অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। চোল রাজত্বের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দিয়ে তিনি কি নতুন দেশকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন? দেশে দাঙ্গা বাধতে না দেওয়ায় সচেষ্ট প্রধানমন্ত্রীর চরিত্র লিখতে বসে তাঁর সদ্যস্বাধীন দেশের কথাই ঠারেঠোরে বলছিলেন? সামন্তদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনেও তাদের ক্ষমা করে দেওয়া, রক্তপাত না-চাওয়া বৃদ্ধ সুন্দরচোলের মধ্যে কি বাঁকাচোরা ভাবে লুকিয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী?

শিশিরকুমার দাশেরা এ সব ইঙ্গিত দেননি। তাঁরা পোন্নিয়ান সেলভানকে বঙ্কিম, শরদিন্দুর লেখা ঐতিহাসিক রোম্যান্সের মতোই দেখছেন। অবশ্যই! মণিরত্নমের সিনেমাতেও নন্দিনী-কারিকালান, দেবন-কুন্দাবাই প্রেমেরই প্রাধান্য। সিনেমা আলাদা মাধ্যম। পথের পাঁচালী বা অপরাজিত ছবি করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়কে অনেক কিছু বাদ দিতে হয়, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায় বা রাণুদিকে জানতে গেলে বিভূতিভূষণের উপন্যাস পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্লাসিক সেটাই, যা যুগে যুগে নতুন আলোয়, সমসাময়িকতার পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় ধরা দেয়। এই উপন্যাসও সে রকম! একাধিক বার ইংরেজিতে অনূদিত, তামিলে কমিকসও হয়েছে। রাজপুত্র, রাজকন্যা, মূক ও বধির দুই যমজ বোন, সব মিলিয়ে গল্পের টান মারাত্মক! এখানেই ভারতীয় সাহিত্য! উনিশ শতকে অ্যান্টনি হোপ-র লেখা প্রিজ়নার অব জেন্ডা অবলম্বনে তো রাজপুতানায় দুই যমজ ভাইয়ের গল্পও বাংলায় শুনিয়েছিলেন শরদিন্দু— ঝিন্দের বন্দী! আর এখানে বাণী ও মন্দাকিনী, মূক বধির দুই যমজ বোন। ধীবরকন্যা তারা। প্রথম তারুণ্যে সেই মূক মন্দাকিনীর প্রেমে পড়েছিলেন সম্রাট সুন্দরচোল। তার পর তাকে আর খুঁজে পাননি। পরের প্রজন্মে তাঁর মেয়ে, রাজকন্যা কুন্দাবাই আবার রাজ্যহীন বান্দিয়া দেবনের প্রেমে। নতুন ভারতে কী আসে যায় বংশপরিচয়ে? সেনাপতির স্ত্রী নন্দিনীই কি খুন করেছে তার একদা প্রেমিক যুবরাজ কারিকালানকে? কে এই নন্দিনী? সে কি সুন্দরচোলের অবৈধ কন্যা? না কি পাণ্ড্য রাজার মেয়ে? মেয়েদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রেম-প্রতিশোধের মধ্য দিয়েই অযাচিত সব বাঁক নেয় উপন্যাস। সেখানেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারের নতুন প্রকরণ, টানা কয়েক প্রজন্মের আকর্ষণ এবং লেখকের সিদ্ধি। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা শুধু নেহরু-গান্ধী নামে নয়, সদ্যস্বাধীন দেশের সাহিত্যেও সে দিন প্রবল ভাবেই প্রতীয়মান ছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy