টনক: নির্বাচনী বন্ডের বিপুল দুর্নীতি বিষয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ‘সময় চাওয়া’র বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মিছিল, চেন্নাই, ৬ মার্চ। পিটিআই।
বহু-ব্যবহারে ‘ল্যান্ডমার্ক’ কথাটি যতই জীর্ণ হয়ে থাক না কেন, সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের কথা বলতে গিয়ে সবাই এই বিশেষণটিই ব্যবহার করছেন সঙ্গত কারণে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলল সুপ্রিম কোর্ট। পাঁচ জন বিচারকের পাঁচ জনই এককাট্টা হয়ে। সেই সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হল যে, নির্বাচনী বন্ড কে কিনল, কত টাকার, আর কারা সে বন্ড জমা করল তাদের অ্যাকাউন্টে— সব জানাতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি ছিল, দাতার নামধাম এবং কোন পার্টির তহবিলে দান যাচ্ছে, তা সবাই জেনে ফেললে দাতামশায় মুশকিলে পড়তে পারেন। তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার আছে ইত্যাদি। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এ সব যুক্তিতে কান দেয়নি। বিচারকদের পাল্টা বক্তব্য হল, ব্যবস্থাটি নির্মাণ করাই হয়েছে এমন ভাবে যে, দাতা ও গ্রহীতার নামধাম কিংবা দানের পরিমাণ কিছুই সাধারণ মানুষ জানবেন না। এই অস্বচ্ছতাই প্রকল্পটির মূল বৈশিষ্ট্য, যা গণতন্ত্রের মূল কাঠামোরই পরিপন্থী।
গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা যে একটি আবশ্যিক শর্ত, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। এর কাছে আর কোনও যুক্তি ধোপে টেকার কথা নয়। রাজনীতির কারবারীদের এ কথাটি বার বার মনে করিয়ে দিতেই হয়। এ তো আর সাধারণ দু’জন ব্যক্তির মধ্যে লেনদেনের ব্যাপার নয়! নির্বাচকদের পুরোপুরি জানার অধিকার আছে তাঁরা যাঁদের নির্বাচন করছেন (বা করছেন না), তাঁদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে রয়েছে কারা, কোন দল কত টাকা পাচ্ছে। স্টেট ব্যাঙ্ক প্রথমে তথ্য দিতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চাইল। কিন্তু আদালত কড়া হতেই দিন কয়েকের মধ্যে তথ্য তুলে দিল। জানা গেল, ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারির মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মোট ৬,৫০১৮ কোটি টাকা পেয়েছে, যার বেশির ভাগটি পেয়েছে শাসক দল বিজেপি।
তথ্য দিতে টালবাহানায় স্টেট ব্যাঙ্কের ভাবমূর্তির যে রকম ক্ষতি হল, অর্থনীতির উপরে তার সম্ভাব্য প্রভাবও কম নয়। স্টেট ব্যাঙ্কের এই প্রকাশ্য বেইজ্জতিতে কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করছেন। কিন্তু সমস্যাটি কোনও ব্যক্তিবিশেষের অশুভ শক্তির সঙ্গে আঁতাঁত হিসাবে দেখলে একেবারেই ভুল হবে। দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে মাথা তুলে কাজ করতে না দেওয়াটা এখন সরকারের অন্যতম লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে।
স্বচ্ছতা— এই শব্দটি কত ভাবে কত রকম অর্থ নিয়ে যে আমাদের সামনে মুহুর্মুহু এসে পড়ে, ভাবলে অবাক হতে হয়। শৌচালয় নির্মাণ প্রকল্পের নাম যখন ‘স্বচ্ছ ভারত’, এর আলঙ্কারিকতাটি জনমানসে অনুরণন ফেলবেই। মনে হতে পারে যে, এই সরকার যেন পরিবেশ কিংবা প্রশাসন, সর্বত্র অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে আপসহীন। নির্বাচনে লড়তে বিস্তর টাকা লাগে। নির্বাচন-পরবর্তী ঘোড়া কেনাবেচাতেও সম্ভবত কম লাগে না। সে টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে পার্টিকে ভাবতেও হয় বিস্তর। বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে টাকা তোলা তাই গণতন্ত্রের উদ্যাপনে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কোন পার্টি কোথা থেকে কত টাকা কী ভাবে তুলছে, তা বরাবরই সাধারণের অনুমানের বিষয় হয়ে থাকত। অনুমান করা যায়, বিস্তর হিসাববহির্ভূত বা কালো টাকা হাতবদল হত এবং হয়।
এখানে চমকদার বিষয়টি হল, সরকার মনে করল এতে ‘স্বচ্ছতা’ আনতে হবে। নির্বাচনে কালো টাকার আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি আর কালো টাকার কথায় ভারতীয় জনগণের আবেগ যত সহজে উস্কে দেওয়া যায়, শৌচালয়ে তেমন হয় না। বর্তমান শাসক দল তা বিলক্ষণ জেনেছে। বিমুদ্রাকরণের সময়ে কালো টাকা সব সাদা হবে, এই অলীক আশায় শারীরিক কষ্ট সয়েও নীরবে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন অগণিত মানুষ। তাই অরুণ জেটলি যখন ২০১৭-র বাজেট-বক্তৃতায় নির্বাচনী বন্ডের কথাটি পাড়লেন, অনেকে মনে করলেন, বেশ তো, সুটকেস ভরা নগদ টাকার বান্ডিলের হাতবদল হওয়া এ বার ঠেকানো গেল। সব লেনদেন হবে ব্যাঙ্কের মধ্যে দিয়ে। ঠিক যেমন বেশ কয়েক বছর ধরেই নানান সরকারি সামাজিক প্রকল্প বাবদে প্রাপ্য অর্থ প্রাপকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি চলে যায়। সেখানেও যুক্তিটি হল, এর ফলে অন্যদের দ্বারা টাকা আত্মসাৎ-এর প্রবণতা কমবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আর বাধ্যতামূলক ‘গ্রাহককে জানো’ মিলে স্বচ্ছতার বজ্র আঁটুনি!
‘বন্ড’ কথাটির মধ্যে যে ভারিক্কি ভাব আছে, তা মনে সম্ভ্রম জাগায়। কিন্তু সরকারি বন্ড বা কর্পোরেট বন্ড বলতে আমরা যে বস্তুটি বুঝি, তা থেকে নির্বাচনী বন্ড ঠিক কোথায় আলাদা, তা বুঝে নেওয়ার অবকাশ হয় না। যে কোনও বন্ডকেই বলা যেতে পারে এক ধরনের ‘প্রতিজ্ঞাপত্র’। নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে বন্ডের মালিককে দিতে সরকার বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই অর্থে নির্বাচনী বন্ড একটি প্রতিজ্ঞাপত্রই। অবশ্য ক্রেতার উদ্দেশ্যের দিক থেকে দেখতে গেলে তারা আলাদা। সরকারি বা কর্পোরেট বন্ড কেনার মূল উদ্দেশ্য তা থেকে সুদবাবদ আয় করা, নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে তা নয়। কিন্তু মূল পার্থক্যটি অন্যত্র, যার গুরুত্ব অপরিসীম। কেনার সময়েই সরকারি বা কর্পোরেট বন্ডের মালিক চিহ্নিত হয়ে যায়, এবং এই বন্ড সাধারণত হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে তা নয়। ‘ক’ বন্ড কিনে ‘খ’কে দিল, ‘খ’ ‘গ’কে, ‘গ’ সেটি ব্যাঙ্কে জমা করে টাকা তুলে নিল— এ রকম হতে কোনও বাধা নেই।
আর এই ব্যাপারটিই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কপালে ভাঁজ ফেলে দেয়। অবাধ হস্তান্তরযোগ্য প্রতিজ্ঞাপত্র প্রায় নগদের মতোই ব্যাপার। আমার হাতে যে একশো টাকার নোটটি আছে সেটি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটি প্রতিজ্ঞাপত্র, এবং সেখানে আমার নাম থাকে না। অতএব স্টেট ব্যাঙ্ক যদি এমন প্রতিজ্ঞাপত্র বাজারে ছাড়তে শুরু করে যা প্রায় নগদ টাকার মতোই, তা হলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অর্থ সৃষ্টির একচেটিয়া অধিকার প্রশ্নের মুখে পড়ে। অর্থনীতিতে মোট সৃষ্ট অর্থের পরিমাণের উপর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যাবে, যা অর্থনীতির পক্ষে বিপজ্জনক। এ ছাড়া ব্যাঙ্কের সাধারণ গ্রাহকদের জন্যে যেখানে ‘গ্রাহককে জানো’ একটি বাধ্যতা, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলিকে এ বাবদে ছাড় দেওয়ার যুক্তি নেই। তাই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক গোড়াতেই আপত্তি করেছিল। নির্বাচন কমিশনও করেছিল এর আগাগোড়া অস্বচ্ছতার কারণে। কিন্তু সরকার তথা শাসক দল পাত্তা দেয়নি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল তা এখন প্রকাশ্যে। ‘মত বিনিময়’ শেষে সহমত তৈরি হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রক যে প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়, জানা গেল, তা-ও অসত্য।
সংসদের ভিতরে একমাত্র যে দলটি এই বন্ডের বিরুদ্ধে নীতিগত আপত্তি তুলেছিল, সেটি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)। পরবর্তী কালে শীর্ষ আদালতে পিটিশনও দিয়েছিল তারা। অবশ্য প্রথম আদালতে যায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)। এই এডিআর-এর কথা এখানে বলতেই হয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আমদাবাদ)-এর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এই সংগঠনটির পত্তন করেন ১৯৯৯ সালে এক গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ মামলা দিয়ে। দিল্লি হাই কোর্টে সে মামলায় তাঁরা চেয়েছিলেন ভোটে দাঁড়ানো সব প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয় ও সম্পদের পরিমাণ, এবং অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত থাকার কোনও ইতিহাস আছে কি না, নির্বাচন কমিশনে জানাতে হবে। উদ্দেশ্য বিশ্বের এই বৃহত্তম গণতন্ত্রে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা। সেই মামলার ফলেই ২০০২-০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামা দিয়ে এগুলি জানাতেই হবে। তথ্য জানার অধিকার আইন আসে তার কিছু পরেই।
নির্বাচনে কর্পোরেট অর্থ সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রেই একটি প্রধান ভূমিকায়। এর কোনও কার্যকর বিকল্প এ-যাবৎ কাল আবিষ্কৃত হয়নি। তাই একে বন্ধ করার চিন্তা অবাস্তব। কিন্তু স্বচ্ছতার দাবি নিরন্তর চালিয়ে যেতেই হবে, আর যাঁরা এই লড়াই ধারাবাহিক ভাবে জারি রাখছেন বর্তমান ভারতে যাবতীয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও— তাঁদের কুর্নিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy