E-Paper

কার লাভ হল এই পরিবর্তনে

এক দিকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ মিটিং-মিছিল, পদযাত্রা করার উপর নিয়মিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি দলের কার্যালয়গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

—ফাইল চিত্র।

আনন্দ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫০
Share
Save

জম্মু-কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের বৈধতা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে। বিষয়টি যে-হেতু সর্বোচ্চ আদালতের বিচারাধীন, সে ক্ষেত্রে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট তা জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামের দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়ে গেল। কেন্দ্রের তরফে প্রতিশ্রুতি ছিল, শীঘ্রই এই দু’টি অঞ্চল দু’টি পৃথক রাজ্যের মর্যাদা লাভ করবে। যদিও চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কেন্দ্রের তরফে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। তবে কি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার উদ্দেশ্যেই ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর উপর আঘাত হানা হল? এ প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে মানবাধিকার কর্মীদের একাংশ।

অপর দিকে, উঠছে নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গও। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা দাবি করছেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর জম্মু-কাশ্মীরের আমজনতার নিরাপত্তা, নাগরিক স্বাধীনতা তথা বাক্-স্বাধীনতার অধিকার অনেক বেশি মাত্রায় সুরক্ষিত। এমন ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পরবর্তী সময়ে জনজীবন নাকি অনেক স্বাভাবিক হয়েছে, পাথর ছোড়াও নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সিনেপ্লেক্স খোলা হয়েছে, ভ্রমণপিপাসুদেরও ঢল নেমেছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে, লগ্নিরও নাকি জোয়ার এসেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে পূর্বের কোনও তুলনাই চলে না। ‘দুর্নীতি’ নামক শব্দটিরও সেখানে কোনও অস্তিত্বই নেই। এমনকি ত্রিশ হাজার সরকারি পদে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

বস্তুত, এ কথা স্পষ্ট ভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকার মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট (১৯৯৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নিয়েছে। আবার, বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ও সুষ্ঠু ভাবে স্থানীয় সমস্যা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ মোতাবেক কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের সম্পর্ক স্থাপিত রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জন্য সংবিধানের বিশেষ ধারা প্রযুক্ত রয়েছে। সংবিধানের ৩৭১এ থেকে ৩৭১জে অনুচ্ছেদগুলি যার পরিচয় বহন করে। এই অনুচ্ছেদগুলি প্রত্যাহার করে নিয়ে কোনও রাজ্যের শাসনক্ষমতা সরাসরি কেন্দ্রের হাতে তুলে নেওয়ার অর্থ কি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত নয়? এই ধরনের মনোভাব চলতে থাকলে তো দেশের সার্বভৌমত্বই প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়াবে! সর্বোপরি প্রশ্ন তোলা দরকার যে, কোনও রাজ্যের জনগণ কী ভাবে পরিচালিত হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেন্দ্র কেড়ে নেবে কেন? ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণের ভাবনাই ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী।

অন্য দিকে, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রসঙ্গে সরকারি দাবিরও বহুলাংশে কোনও সত্যতা নেই। ২০১৯ সালের ৫ অগস্টের পরবর্তী সময়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভের আঁচ উপলব্ধি করে আগেভাগেই পাঁচ হাজারেরও অধিক মানুষকে গ্রেফতার করে আটক রাখা হয়। মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের গ্রেফতার বা নানা ভাবে হেনস্থা করার প্রক্রিয়া তো চলছেই। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করার পরও জঙ্গিদের হাতে পণ্ডিত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর বহু ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ থেকে ২০২২, এই সময়ের মধ্যেই ৭১ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে, যেখানে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩৫ জন অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম সংখ্যক সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল।

এক দিকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ মিটিং-মিছিল, পদযাত্রা করার উপর নিয়মিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি দলের কার্যালয়গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, মহিলা ও শিশুদের উপর অত্যাচারের হারও রীতিমতো বেড়ে চলেছে। আবার, ২৩.১ শতাংশ বেকারত্বের বোঝা নিয়ে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি বর্তমানে কার্যত ধুঁকছে, যা জাতীয় গড়ের প্রায় তিন গুণ। ৩০ হাজার (সঠিক সংখ্যাটি ২৯,২৯৫টি) সরকারি নিয়োগের আস্ফালন করা হলেও এখনও আরও ৫৪,৭১০টি সরকারি পদ ফাঁকা রয়েছে, সে বিষয়টি একেবারেই উচ্চারণ করছেন না কেন্দ্রীয় সরকার বা তার সাংসদরা।

আর দুর্নীতিমুক্ত রামরাজ্যের দাবি? তাও তো অসত্য। জম্মু ও কাশ্মীর সিলেকশন বোর্ডের বিরুদ্ধেই তো একটি কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের বরাত পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও জম্মুতে প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হলে অবশেষে বাধ্য হয়ে সেই চুক্তি বাতিল করা হয়। অন্য দিকে, প্রশাসনের বিরুদ্ধেই জম্মু-কাশ্মীর হাই কোর্টে সেখানকার মন্দিরগুলির জমি দখলের একাধিক মামলা রুজু করেছে বিভিন্ন মন্দির ট্রাস্ট। কোথাও মন্দিরের জমি দখল করে হাসপাতাল করতে দেওয়ার অভিযোগ, কোথাও আবার হেলিকপ্টার কোম্পানিকে মন্দিরের জমি ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রতিবাদ। এই হেলিকপ্টার কোম্পানিটি হিন্দু তীর্থযাত্রীদের আকাশপথে বিভিন্ন মন্দির ভ্রমণ করিয়ে থাকে।

৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পরবর্তী সময়ে জম্মু-কাশ্মীরের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। অন্য দিকে, হোটেলগুলির লিজ় না বাড়ানোর ফলে তাদের ব্যবসাও বন্ধ হতে বসেছে। সব মিলিয়ে নিউ নর্মাল-এর নামে জম্মু-কাশ্মীরে যা ঘটে চলেছে, তাতে মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Article 370 Jammu and Kashmir Narendra Modi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।