সূর্যে আছে প্রচুর হিলিয়াম, কিন্তু আশ্চর্য, পৃথিবীতে হিলিয়াম প্রায় পাওয়াই যায় না। ছবি: সংগৃহীত।
ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার বিজ্ঞানীরা এক জোটে এমন এক আবিষ্কার করেছেন, যা হিলিয়াম সন্ধানে খুবই কাজে লাগবে। পৃথিবীতে সমুদ্রের উপরে প্রথম স্থলভাগ ভারতেই ভেসে ওঠে সিংভূম অঞ্চলে— অধুনা ঝাড়খণ্ডে— সেখানে প্রচুর পরিমাণে হিলিয়ামের হদিস পাওয়া গিয়েছে। সূর্য থেকে ছিটকে আসা অংশ থেকেই গ্রহগুলির সৃষ্টি। খুব স্বাভাবিক যে, পৃথিবীতে সূর্যের কিছু কিছু সৌর পদার্থ থেকেই যাবে। সূর্যে আছে প্রচুর হিলিয়াম, কিন্তু আশ্চর্য, পৃথিবীতে হিলিয়াম প্রায় পাওয়াই যায় না। তবে, এটাও স্বাভাবিক যে, যখন সূর্য থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, তবে থেকেই হিলিয়াম পৃথিবীতে মাটির নীচে বন্দি হয়ে আছে।
বর্তমানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক প্রিয়দর্শী চৌধুরী ও তাঁর সতীর্থরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সত্যিই সূর্যের হিলিয়ামের ভান্ডার রয়েছে পৃথিবীতে। সিংভূম জেলায় বেশ কিছু পাথর আছে, যার বয়স তিন হাজার কোটি বছরের বেশি। পাথরগুলির নাম স্যান্ডস্টোন। এদের বয়স মাপা যায় পাথরগুলির মধ্যে ইউরেনিয়াম বা সীসা মেপে। চৌধুরী এবং সতীর্থরা বয়স মেপে জানিয়েছেন, পৃথিবী শীতল হতে আরম্ভ করার পর এই অংশই প্রথম জলের উপরে জেগে উঠেছিল। এই আবিষ্কারের ফলাফল প্রবন্ধ হিসাবে ছাপিয়েছেন প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস পত্রিকায়। ওই পাথরগুলির মধ্যে হিলিয়াম বন্দি হয়ে আছে, যাকে সৌর হিলিয়াম বলা যেতে পারে। প্রচণ্ড চাপে পাথরগুলিতে ফাটল ধরেছে, এবং হিলিয়াম নিজগুণে এই চির ফাটল থেকেই বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। আমি এবং দেবাশিস ঘোষ, চিরঞ্জীব বর্মন, হীরক চৌধুরীরা এর হদিস পেয়েছিলাম, এবং সেই গবেষণার কথা খ্যাতনামা জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছিল।
এই হিলিয়াম গ্যাসের উৎস কোথায়? ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম থেকে তেজস্ক্রিয়তার জন্যে হিলিয়াম বেরিয়ে আসছে। তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া থেকে তার উৎস, কিন্তু হিলিয়াম কোনও পদার্থের সঙ্গেই সংযোগ করে না, আর এই হালকা গ্যাস তাই সহজেই বেরিয়ে আসে। সেই জন্যই রকেটের চুল্লির পদার্থগুলি জ্বলে যাওয়ার পর ফাঁকা জায়গায় হিলিয়াম দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের সুরক্ষার জন্যও হিলিয়াম প্রয়োজন।
এই আবিষ্কারের এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। এত দিন আমেরিকা ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে হিলিয়াম রফতানি করেছিল। কিন্তু, তারা জানিয়েছে, অতঃপর আর করবে না। ফলে হিলিয়ামের দাম বেড়েই চলেছে। হিলিয়ামের প্রয়োজন বহু কারণে— ম্যাগনেটিক রেজ়োন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই)-এর জন্য; রকেট উৎক্ষেপণের সময়; পারমাণবিক চুল্লিতে; সুপার কন্ডাক্টিভ সাইক্লোটনের ক্ষেত্রে; ‘অতি-শীতল’ প্রযুক্তিতে। ভারতে হিলিয়াম কিনতে ফি বছর ৫৫,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়। আমেরিকা রফতানি বন্ধ করায় তা আরও বাড়া স্বাভাবিক।
ভারতে যে হিলিয়ামের উৎস আছে, তার ইতিহাস খুবই আকর্ষণীয় এবং মজাদার। ১৯৫৬ সাল নাগাদ বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিশ্বভারতীর ঝুটঝামেলা থেকে রেহাই পেতে তিনি বেরিয়ে পড়তেন আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে কিছু মজার জায়গা আছে কি না দেখার জন্য। এ ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে তিনি বক্রেশ্বর গ্রামে এসে দেখেন যে, একটি কুণ্ডে প্রায় ফুটন্ত জল, আর তার থেকে বেরিয়ে আসছে এক প্রাকৃতিক গ্যাস। গোটা জায়গাটাই বিশেষ রহস্যপূর্ণ। কাপালিকরা ওখানে আখড়া করেছে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে এই বিস্ময়কর জায়গাটি আকর্ষিত করেছিল। তাঁর অঙ্কের মাথা পরিষ্কার, কিন্তু পদার্থবিদ্যার ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করার আগেই তিনি মোটামুটি বোঝার চেষ্টা করতেন যে, ব্যাপারটা কী? এই ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বোঝা গেল যে, এই গ্যাস হিলিয়াম। অধ্যাপক বসু তাঁর প্রিয় ছাত্র শ্যামাদাস চট্টোপাধ্যায়কে বিষয়টি দেখতে বললেন। কিছু দিনের মধ্যেই শ্যামাদাসবাবু আবিষ্কার করেন যে, এই ধোঁয়াশা গ্যাস হল হিলিয়াম। গ্যাসের ১.৮% হল হিলিয়াম, পৃথিবীর অন্যতম বেশি মাপের।
শ্যামাদাসবাবুর ধারণা যে, বক্রেশ্বর এবং তার কাছাকাছি তাঁতলুই অঞ্চলে (ঝাড়খণ্ড) রয়েছে হিলিয়ামের এক সমুদ্র। পৃথিবী কিনা সূর্যের এক খাবলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে, কাজেই খুবই স্বাভাবিক যে, সূর্যের আদি গুণগুলি এই পৃথিবীতে এসে পড়েছে, যেমন ধরুন সিংভূমে। আমি যখন শুনেছিলাম শ্যামাদাস বাবুর কাছে, তখন কিন্তু জানা ছিল না পৃথিবীর উৎস সূর্য থেকে। প্রিয়দর্শী চৌধুরী এবং তাঁর সতীর্থরা প্রথম আবিষ্কার করলেন যে, এই স্থলভাগটি পৃথিবী একটু ঠান্ডা হলে প্রথম পৃথিবীর বুকে ভেসে ওঠে, এই ভারতেই।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ভুবনেশ্বর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy