জন এলিয়েট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ফাইল ছবি।
তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর ঠিক মাঝের বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সমাজ, শিক্ষা, দেশ। পরাধীনতার গ্লানির যে একমাত্র রুপোলি রেখা, সেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় নতুন প্রজন্ম ভাবতে শুরু করল নতুন ভাবে। সুদূর মহারাষ্ট্রে এই সময় অন্ত্যজ ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন কমবয়সি এক দম্পতি— জ্যোতিবা ও সাবিত্রী ফুলে। পারিবারিক নিয়ম মেনে ১৭ বছরের জ্যোতিবার সঙ্গে বিয়ে হয় ১১ বছরের সাবিত্রীর। স্ত্রীকে গোপনে অক্ষরশিক্ষা দিতে শুরু করেন জ্যোতিবা। পুণের মেয়েরা আসে না জ্যোতিবার স্কুলে, তাই সাবিত্রীবাই ১৩ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক বাড়ি যেতে শুরু করলেন। জ্যোতিবার স্কুলের পাশাপাশি শুরু হয় সাবিত্রীর স্কুলও। বন্ধু তত্ত্বসাহেব শিন্দের ভিডেওয়াড়ার বাড়িতে শুরু হয় মেয়েদের স্কুল। তখন ১৮৪৯ সাল।
এই স্কুলের কারণে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয় জ্যোতিবাকে। সাবিত্রীকে তাঁর বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু সাবিত্রী ফিরে আসেন। দু’জনে আশ্রয় নেন বন্ধু উসমান শেখের বাড়িতে। চলতে থাকে ভিডেওয়াড়ার স্কুল। দূরদর্শী জ্যোতিবা সাবিত্রীকে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চান। তাই আহমেদনগরে যান সাবিত্রী, শিখে আসেন ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষকতা। সেটা ছিল ১৮৫০ সাল, কাদম্বিনী-চন্দ্রমুখীদের জন্মেরও দশ বছর আগে।
সে সময় বাংলার বুকেও গড়ে উঠছে মেয়েদের শিক্ষা-আন্দোলন। বিদ্যাসাগর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মেয়েদের শিক্ষিত করার। তার জন্য চলছে অর্থ সংগ্রহ। উত্তরপাড়া হিতকারী সভার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ইংরেজ সরকারকে প্রস্তাব দিচ্ছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার। বারাসতে প্যারীচরণ সরকার প্রতিষ্ঠা করছেন স্কুল, ১৮৪৭ সালে। সেই সকল স্কুলের বয়সই ১৭৫ পেরিয়েছে। কিন্তু যে সহোদরার গল্প বলতে এই ইতিহাস কথন, তার সূচনা হয় ঠিক এই সময়।
জন এলিয়েট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (ছবি) ১৮৪৮ সালে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের পদাধিকারী হয়ে যোগ দেন। এ দেশের শিক্ষার অবস্থান, মেয়েদের শিক্ষার অবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের স্কুল— হিন্দু ফিমেল স্কুল— প্রতিষ্ঠার। ১৮৪৯ সালে কর্নওয়ালিস স্কোয়্যারের পাশে অধুনা ১৮১ নম্বর বিধান সরণিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার আগে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বাড়িতে শুরু হয় এই যাত্রা। ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮০, তার মধ্যে ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও রামগোপাল ঘোষের কন্যারা।
বেথুন সাহেবের স্মৃতির টানে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়োর কথা মনে পড়ার কিছু স্মৃতিগত কারণ থেকে যায় হয়তো। ডিরোজ়িয়ো যেমন মারা যান কলেরা আক্রান্ত হয়ে, অনেকটা একই ভাবে ১৮৫১ সালে জেলা পরিদর্শন করতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চলে যান বেথুনও। তাঁর মৃত্যুর পর, ১৮৫৬ সালে সরকার অধিগ্রহণ করে এই স্কুল। স্কুলের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় বেথুন স্কুল। আলোকবর্তিকা নিবিয়ে যায় না, ঝোড়ো দুঃস্বপ্ন থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁরই পরিচালনায় শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ায় বেথুন স্কুল। ধর্মীয় সমাজরক্ষকদের সমালোচনার ফলে ছাত্রী-সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২০-তে। এই সময় অন্যান্য স্কুল, যেগুলির অর্থাভাব ছিল— যেমন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়— যুক্ত হয় বেথুন স্কুলের সঙ্গে। ছাত্রী হয়ে পড়তে আসেন কাদম্বিনী বসু। ইতিহাস তার স্বর্ণাভ মোড় নেয়।
ঠিক এই সময় কী করছেন জ্যোতিবা-সাবিত্রী ফুলে? কেমন আছে তাঁদের প্রতিষ্ঠান? সিপাই বিদ্রোহের পরবর্তী সময়টা ভাল যায় না মহারাষ্ট্রের এই শিক্ষা-আন্দোলনের।সরকারি অনুদান প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। বরোদার মহারাজা ও অন্য হিতৈষীদের আনুকূল্যই ছিল একমাত্র ভরসা। তবুও আলোকবর্তিকা নেবে না। একই সঙ্গে চলতে থাকে অন্যান্যসামাজিক পদক্ষেপ— বিধবা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারচেষ্টা করেন সাবিত্রী, যাতে সামাজিক লজ্জায় বিধবা ও তাঁদের সন্তানের জীবন দুর্বিষহ না হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতব্দীর মধ্যভাগে এ-হেন পদক্ষেপের জন্য কম মূল্য দিতে হয়নি জ্যোতিবা-সাবিত্রীকে।
পরের পঞ্চাশ বছর বেথুনে নারীশিক্ষা পার করে নতুন নতুন পাকদণ্ডী, অনেক শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। কাদম্বিনী, অবলা বসুরা ডাক্তারি পড়তে সফল হন, চন্দ্রমুখী বসু স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করে প্রথম ভারতীয় মহিলা অধ্যক্ষা হন। জ্যোতিবা-সাবিত্রীর প্রতিষ্ঠান কিন্তু এতটা আকাশ পায় না। যদিও প্রতিষ্ঠানটি তখন সব রকমেরই মান্যতা পেয়েছে, কিন্তু জ্যোতিবার অসুস্থতা ও ১৮৯০ সালে মৃত্যু বড় ধাক্কা হয়ে আসে। দত্তক পুত্র ও তার অধিকার নিয়েও শুরু হয় আইনি জটিলতা।
বেথুন স্কুলকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আজ সে প্রতিষ্ঠানের বয়স ১৭৫ বছর। বেথুন সাহেবের স্বপ্ন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিশ্রমকে বুকে করে সেই বিশাল হলঘর, প্রার্থনার চাতাল নিয়ে সে অটুট। নারীশিক্ষার অনেক না-বলা ইতিহাস সেখানে কথা বলে, প্রায় সব সময়। তার সহোদরা, সেই সুদূর পুণেতে ভাঙাচোরা ভুলে যাওয়া শরীরে মেখে রাখে দীর্ঘশ্বাস।
এ ইতিহাস গর্বের, আনন্দের, উদ্যাপনের, আবার হারিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া বিষাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy