—ফাইল চিত্র।
রেমাল-এর ঝাপটায় সুন্দরবনে প্রাণহানি হয়নি। আগাম সতর্কবার্তা থাকায় সরকারি তৎপরতায় সরিয়ে নেওয়া গিয়েছে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে। কিন্তু বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা যে এখনও নড়বড়ে, এই ঝড় তা ফের প্রমাণ করল। এ বারও বাঁধ ভেঙে ভেসে গেল বাদাবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
আমপানের পর সেচ দফতর ৩৭৮টি নদী-সংলগ্ন বিপন্ন বাঁধ চিহ্নিত করে। নদী বাঁধের (মোট দৈর্ঘ্য ১৮০০ কিমি) যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। হিসাব অনুযায়ী, কিলোমিটার প্রতি বাঁধ সংস্কারের খরচ প্রায় ১৪ কোটি টাকা। বাঁধের ভিত্তি পোক্ত করতে পারলে এই বিপুল খরচ কিছুটা কমানো সম্ভব। তাই প্রস্তাব করা হয় ম্যানগ্রোভ আবাদ বাড়ানোর। বলা হয়, বাঁধের বাইরের এবং ভিতরের অংশ বরাবর ম্যানগ্রোভের আচ্ছাদন তৈরি করলে স্রোতের অভিঘাত নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাড়বে বাঁধের স্থায়িত্ব। বাঁধ-প্রযুক্তির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ‘জৈব ঢাল’ ব্যবহার করলে বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে বলে মনে করেন অনেক পরিবেশবিদ এবং নীতিনির্ধারক।
ম্যানগ্রোভ দিয়ে ভূমিক্ষয় কতটা রোধ করা যায়, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে (বিশেষ করে কেওড়া প্রজাতির গাছকে) অন্তত দশ বছর বাড়তে দিলে বাঁধের ধস আটকানো সম্ভব। ম্যানগ্রোভ-বিরল অঞ্চলে, বিশেষত যেখানে নদীচরের অংশ বাটি আকারের, বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ম্যানগ্রোভ-ঘাটতি পূরণ করলে সুন্দরবনে বাঁধ বিপর্যয় কমানো সম্ভব।
পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর ২০২০ সালে একশো দিনের কাজের বরাদ্দকে কাজে লাগিয়ে ‘মিশন ম্যানগ্রোভ’ প্রকল্প চালু করে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্তর্গত সুন্দরবনের দশটি ব্লকের আটান্নটি গ্রাম পঞ্চায়তের ৪৫০০ হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়। মনে রাখতে হবে, তখন করোনার আবহ, গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে আসছেন। তাই ম্যানগ্রোভ রোপণ প্রকল্পে অনেকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয়েছিল। বিপর্যয় মোকাবিলার সঙ্গে সংযোগ করা গিয়েছিল জীবিকার।
তবে চারা পুঁতলেই তো কাজ শেষ হয় না। তাকে অন্তত কয়েক বছর বাড়ার সময় দিতে হলে, নদীর চরে মানুষের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুন্দরবন উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য, এলাকার কৃষিজীবীদের প্রায় অর্ধেক ভূমিহীন। এঁদের একটা বড় অংশ আয় করেন নদীতে মাছ ধরে, মীন সংগ্রহ করে। ম্যানগ্রোভ বাঁচাতে গেলে এঁদের রোজগার ব্যাহত হবে। মিশন ম্যানগ্রোভ প্রকল্পে লাগানো চারাগুলি কতটা অক্ষত আছে, সমীক্ষা করতে গিয়ে বন দফতর দেখেছে যে গড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ চারা বেঁচে আছে। চারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ক্যানিং ২ নং ব্লকে, যা সুন্দরবনের অতি দরিদ্র অঞ্চলগুলির অন্যতম। হতে পারে, ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ করতে গেলে যতটা সময় নদীতে মাছ বা মীন সংগ্রহ বন্ধ রাখতে হত, অভাবের তাড়নায় তা সম্ভব হয়নি ।
ম্যানগ্রোভ চারা লাগানোর সময় যে টাকা দেওয়া হয়, তা এককালীন। বছরে ত্রিশ শতাংশ ম্যানগ্রোভ প্রতিস্থাপন করলেও তা থেকে কত জনের নিয়মিত আয়ের সংস্থান করা সম্ভব? ২০২১ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের একশো দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে। এর ফলে এক দিকে যেমন ম্যানগ্রোভ তহবিলে টান পড়েছে, অন্য দিকে তেমনই গ্রামীণ রোজগার কমে যাওয়ায় বাড়ছে ধার-দেনা। পরিণামে সুন্দরবনের জল-জঙ্গল সম্পদের উপর মানুষের চাপ বাড়তে পারে, নষ্ট হতে পারে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, দুর্বলতর হতে পারে বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষমতা।
নদীবাঁধ সুরক্ষিত করা ছাড়াও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অন্য বাস্তুতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আছে। ম্যানগ্রোভ বিস্তার হলে মাছ, কাঁকড়ার আনাগোনা বাড়ে। বৃদ্ধি পায় মধু উৎপাদন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে বায়ুমণ্ডল থেকে অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় দশগুণ বেশি কার্বন শুষে নিতে পারে ম্যানগ্রোভ। বেসরকারি উদ্যোগে ম্যানগ্রোভ আবাদ করে, কার্বন ক্রেডিট আদায় করার প্রক্রিয়াও সম্প্রতি চালু হয়েছে। ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের জন্যে যাঁদের জীবিকা ব্যাহত হয়, তাঁদের এই দীর্ঘমেয়াদি সুফলের আর্থিক অংশীদার করা যেতে পারে। বিনিময়ে তাঁদের নিযুক্ত করা যেতে পারে ম্যানগ্রোভ তদারকির কাজে। ম্যানগ্রোভ সুরক্ষিত রাখতে হলে, ম্যানগ্রোভ থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলির আর্থিক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি প্রয়োজন, অরণ্য সুরক্ষা সমিতির মতো সহভাগী প্রতিষ্ঠানের পুনর্বিন্যাস। অরণ্য সুরক্ষা সমিতি গঠন করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিকল্প জীবিকা তৈরি, যাতে রোজগারের জন্য ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করতে এলাকার মানুষ বাধ্য না হন। ম্যানগ্রোভ রক্ষণাবেক্ষণ থেকে সরাসরি আয়ের ব্যবস্থা করলে সংরক্ষণ প্রকল্পে গ্রামের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবে সমিতি। বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সমিতি আরও কার্যকর হতে পারবে।
সুন্দরবনে বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থার সঙ্গে স্থানীয় জীবিকার যোগস্থাপন না করলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে না। মনোজ বসুর জলজঙ্গল উপন্যাসে মধুসূদন রায় বাদাবন কেটে বসত গড়তে চেয়েছিলেন। প্রকৃতির কাছে হার মানতে হয় তাকে। মধুসূদন রায়কে স্বীকার করতে হয়, “…জলে আর জঙ্গলে, জঙ্গলে আর পশুপাখি-কীটপতঙ্গে ভারি মিতালি— শত শত বৎসরের দিনরাত্রির প্রতিমুহূর্তে তাদের উদ্দাম কথাবার্তা ও মেলামেশা চলছে।” তার মনে প্রশ্ন জাগে, “মৃত্তিকার আদিমতম সন্তান, মানুষের প্রথম আশ্রয়দাতা বনের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কিসের?” ম্যানগ্রোভ আবাদ এবং বাঁধ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই বিরোধাভাসের নিষ্পত্তি এখন সুন্দরবনের লক্ষ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy