—ফাইল চিত্র।
যখন বোমাটোমা চলছিল, আপনি ছিলেন?” সাংবাদিকটির প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি বলে, “ছিলাম না মানে! আমার পায়ের কাছেই তো একটা ফাটল।”
সত্তর দশকের গোড়ার দিক, চাকরির আবেদনপত্র জোগাড় করতে গিয়ে লম্বা লাইনে ঘণ্টা তিনেক দাঁড়ানোর পরে সেটাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টায় যখন বোমা ফাটানো শুরু হল, সে মুহূর্তের কথা বলছিল মেয়েটি।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়নি, দুটো টিউশন করে, দুটো ছোট বাচ্চাকে পড়িয়ে যেটুকু রোজগার মেয়েটির। যে বাড়িতে ভাড়া থাকে তাতে একটাই ঘর, ঠাসাঠাসি করে শোয় বোন আর মায়ের সঙ্গে। একফালি বারান্দায় কোনও ক্রমে রান্না হয়, সংসারের পুরো খরচটা চালানোর জন্যে মেয়েটির মা আবার একটি সচ্ছল পরিবারে সারা দিন এক বৃদ্ধার দেখভাল করেন, সঙ্গে রান্নাও। মা এক দিন কাঁদতে কাঁদতে দুই মেয়েকে বলেন, “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে... আমার কষ্ট হয়... আমি কত মাছ-মাংস রেঁধে আসি আর তোদের পাতে তরকারিও দিতে পারি না।”
মৃণাল সেনের ছবি কোরাস (ছবিতে একটি দৃশ্য) দেখতে গিয়ে খেয়াল হয়, মাঝে পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৪-এ, আজও যেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, একই রকম বিপন্নতায়। ছবির যে অংশটুকু বললাম, ও-রকম আরও ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘটনা আছে ফিল্মটিতে, ফিরে দেখতে গিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়— ওই সময়টা যেন টুকরো-টুকরো হয়ে ধূসর দৃশ্যের জন্ম দেয়... ক্ষুধা, অনাহার, দারিদ্র, বেকারত্ব, শ্রমিক ছাঁটাই, বেআইনি জমি দখল, বঞ্চনা, সর্বোপরি দুর্নীতি... শোষণের নানা অনুষঙ্গ, সাদাকালো কোলাজে।
পরিচয়লিপির ফাঁকে ফাঁকে রুগ্ণ কঙ্কালসার আবালবৃদ্ধবনিতার স্থিরচিত্র পেশ করতে থাকেন মৃণালবাবু, আর ছবির শুরুতে এক কথোয়াল গায়: “লীলাচ্ছলে ভগবান মর্তে নেমে আসে/ আর দেশের কান্ডারি রূপে মহিমা প্রকাশে/ কত তন্ত্র কত মন্ত্র কত ভগবান/ অভাব রচেন যিনি তিনি শক্তিমান।”
এমনই এক শক্তিমানের দেখা মেলে দুর্গের মতো এক সুরক্ষিত কর্মশালায় (ধরে নিন, এ কালের এক বিরাট কর্পোরেট সংস্থায়), তিনি বলেন, আমরা এক বিরাট কাজে নেমেছি, মহৎ কাজ। ভয়াবহ বেকার সমস্যা চারিদিকে, চাকরি নেই, এমতাবস্থায় একশোটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি, একশোটা সোনার খনি। তাই বলে চাকরি তো আর হরির লুটের বাতাসা নয়, সবাইকে দেওয়া যাবে না, বেছে বুঝে দিতে হবে। সেই চাকরির আবেদনপত্র পাওয়ার জন্য যখন বাইরে অপেক্ষারত প্রার্থীরা খেপে ওঠে, তখন কঠোর হয়ে ওঠে ওই সর্বময় কর্তাটির মুখ, চেঁচিয়ে ওঠেন: সিকিয়োরিটি... ভারী সম্মিলিত বুটের শব্দ ভেসে আসে অনেক ক্ষণ ধরে। ওই গা-শিউরানো বুটের শব্দ প্রায় ধুয়োর মতো বিভিন্ন দৃশ্যে ফিরিয়ে আনেন মৃণাল সেন, তত দিনে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিটি নিরাপত্তা-প্রধানকে পরামর্শ দিয়েছেন: আবেদনকারীদের প্রত্যেককে ‘ওয়াচ’-‘শ্যাডো’-‘হ্যারাস’ করতে, নাশকতা কিংবা অন্তর্ঘাতের রাজনীতি করার অভিযোগে ‘সন্ত্রস্ত’ করে তুলতে।
কৌতুকের বাতাবরণে মুড়ে এ ছবির অন্তঃকরণটিকে তিক্ত করে রাখেন মৃণাল সেন। কখনও বিদ্রুপ-উপহাস, কখনও অদ্ভুতত্ব বা অসম্ভাব্যতা, একটা মজাদার ভঙ্গি থেকে ধীরে ধীরে রাগত মেজাজে সরে আসেন। আস্তে আস্তে আমরা টের পেতে থাকি মৃণালবাবুর ছবিটি আদতে বিপজ্জনক ও বিরুদ্ধবাদী, ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে, ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করে।
আজ মৃণালবাবুর বয়স যখন ১০১ পূর্ণ হচ্ছে, অর্ধশতক আগের এই পুরনো ছবিটির কথাই মনে এল। সেই সত্তর দশক থেকে এই নতুন শতকের তৃতীয় দশকে এসেও আর্থিক অসাম্যের জেরে দারিদ্রের উচ্চাবচতা, আর্থিক অসচ্ছলতা লেগেই থাকে। মাঝে কেটে গেল তো অনেক বছর, গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, তবু অর্থনৈতিক পরাধীনতা ঘুচছে না, সামাজিক শোষণ বা বঞ্চনার অনড় পাথরটা নড়ছে না, রাষ্ট্রের পীড়ন বেড়েই চলছে।
ক’দিন আগেই পড়েছি “গত এক দশকে প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ভারতে খবর এক প্রকারই হতে হবে, তা হল কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার পক্ষ যা রচনা করবে বা যা দেবে।... পরিবেশটাই এমন যে তুমি প্রশ্ন তুললেই তুমি দেশদ্রোহী।” (ঈশানী দত্ত রায়, ‘কলমকে ভয় করে বলেই’, আবাপ, ২৪-৪) পড়েছি: “তবে কি আমরা সাংবাদিকরা নির্ভয়ে আর জনগণের কথা লিখব না? শাসকের মুখের সামনে তুলে ধরব না আয়না?” (দেবমাল্য বাগচী, ‘সাংবাদিক মানেই অপরাধী?’, আবাপ, ৮-৫) শুরুতেই যে সাংবাদিকটির প্রসঙ্গ এল, কোরাস ছবিতে সে-ও ঘুরে ঘুরে মানুষের দৈনন্দিন বিপন্নতার বয়ান তুলে আনে, সেইটেই তার প্রতিবাদ অথবা অন্তর্ঘাত। আর এক পোড়-খাওয়া শ্রমিক ছিল ছবিটিতে, খালি পেটে সে লড়াই করছিল অন্যায় ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে। এক দিন রাতের অন্ধকারে রাস্তার মদের বোতল ছুড়ে মেরেছিল কর্তৃপক্ষের কর্তার গাড়িতে, বেধড়ক ঠেঙানি খেয়ে রক্তাক্ত মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে গেয়েছিল, “হাম ভুখসে মরনেওয়ালে, কেয়া মওতসে ডরনেওয়ালে... আজ়াদি কা ডঙ্কা বাজাও।”
কোরাস করার বেশ কিছু পরে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে গিয়ে বলেন মৃণাল সেন, “শাসন করার অধিকার— এ ব্যাপারটা পুরো ধুয়ে-মুছে ফেলা দরকার। সে যে কোনও স্তরেই হোক না কেন, নৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক।”
পুনশ্চ: ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে মুক্তি পায় কোরাস। ঠিক ছ’মাস পর ১৯৭৫-এর জুনে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy