শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মচারী নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি। ফাইল চিত্র।
গত কয়েক মাস রাজ্য-রাজনীতি সরগরম শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে। এর সূত্রপাত কিছু প্রার্থীর পরীক্ষা ঠিকঠাক দিয়ে ও উপযুক্ত ফলাফল পেয়েও বিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ার অভিযোগে কয়েক জন আইনজীবীর কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা। এই উদ্যোগে কোনও রাজনৈতিক দলের বাহবা নেওয়ার কোনও স্থান নেই। রাজ্যের তদন্তের উপর ভরসা না থাকায় বিচারক হাজির করলেন কেন্দ্রীয় সরকারের দল সিবিআই, ইডি। এ বার টিভির পর্দায় কোটি কোটি টাকার স্তূপ দেখা গেল, টাকা আদায় লেনদেনের রোমহর্ষক কাহিনি বেরোতে থাকল। জড়িয়ে গেলেন কয়েক জন তরুণী, যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেতা মন্ত্রীদের। গরম খবর করার জন্য যা যা মশলা দরকার— কামিনী, কাঞ্চন ও নেতা— সবই পাওয়া গেল। দৃশ্য সংবাদমাধ্যম তো বটেই, মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমও চায় খবর হবে থ্রিলারমাফিক— ঘটনাময়, রক্তাক্ত, হাঁ করে তাকিয়ে থাকার মতো। ফলে দেশে বছরে ষাট হাজার লোকের সাপের কামড়ে নীরব মৃত্যু খবর হয় না, কিন্তু কোটি টাকার স্তূপ দেখাতে পারলে দর্শক পর্দা থেকে নড়বে না। একটা রগরগে ইসু পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা। শাসক দলের বিরুদ্ধে হুঙ্কার থেকে কটু কথা এখন রোজকার পাওনা। কিন্তু বিষয়টি কি শুধু দুর্নীতির, না তার থেকেও বড়— একেবারে সরকারি ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাটাই নষ্ট হয়ে যাওয়া? দু’-পাঁচশো কোটি টাকা টিভিতে দেখতে অনেক হলেও আজকের অর্থনীতিতে তেমন কিছু নয়। তার থেকে অনেক বড় কথা সরকারি বিদ্যালয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ও সরকারি বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান একেবারে তলানিতে চলে যাওয়া। কিন্তু সংবাদমাধ্যম ঠিক করে দিয়েছে এই দুর্নীতিই রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র বিষয়।
এটি সর্বজনবিদিত যে, রাজনৈতিক দলগুলির অনেক শাখা সংগঠন থাকে এবং তাদের কাজ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষদের সমস্যা ও দাবিদাওয়ার বিষয় নিয়ে আন্দোলনে সরব হওয়া। এমনকি অবিশ্বাস্য হলেও এই কলকাতা মহানগরের কৃষকদের সমস্যার সমাধানে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের কৃষক সংগঠনের উত্তর কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতায় দু’টি শাখা রয়েছে, তার অনেক পদও রয়েছে। তা হলে কলকাতার অন্য সমস্যার খবর নিশ্চয়ই তাদের নখদর্পণে থাকার কথা। কিন্তু আশ্চর্য যে, অন্তত শিক্ষা নিয়ে এই মহানগরের খবর কোনও রাজনৈতিক দলই খুব একটা রাখে বলে মনে হয় না। সংবাদপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত যে, কলকাতা পুরসভায় ১১৩টি বিদ্যালয়ে কোনও ছাত্র নেই, বা এত কম ছাত্র যে, সেগুলি চলে না। এ খবর কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে নেই, ফলে এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কোনও আলোচনা, কর্মসূচি কিছুই নেই। তারা জানে না যে, শহরের বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। না কি এতে কারও বেতন বন্ধ হচ্ছে না, ফলে এ সব খবরের দরকার নেই? সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর হয়তো দু’-একটা প্রেস-বিবৃতি পাওয়া যেতে পারে। এখন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ঠিক করে দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম।
শিক্ষার সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গের নয়, সমস্যাটা জাতীয়। সরকারি বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদের বেসরকারি বিদ্যালয়ে চলে যাওয়া ঘটে চলেছে দেশ জুড়েই। ভারত সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সাল থেকে ২০১৯-২০’তে দেশে ৫১,১০৮টি সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে বেসরকারি বিদ্যালয় বেড়েছে ১১,৭৩৯টি। ২০১৬-র পর থেকেই নীতি আয়োগের পরামর্শ হল কম ছাত্রছাত্রীর বিদ্যালয়গুলিকে অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্তকরণ। কারণ কম ছাত্রছাত্রীর বিদ্যালয়ে উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামো প্রতিপালন করা সম্ভব নয়। দেশের কয়েকটি রাজ্য যেমন উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, রাজস্থান বিশেষ উদ্যোগ করে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেকে কমিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও তা ঘটছে— রাজ্য শিক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০২২-এ, তৃণমূল শাসনের সময়ে, ৭০১৮টি প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ৮২০৭টি বিদ্যালয়কে বন্ধ করার জন্য চিহ্নিত করেছে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দফতর, যার মধ্যে ৫৩১টি বিদ্যালয় কলকাতায়।
বিদ্যালয়গুলি বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ, ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে যায় না। কেন যায় না? একেবারে গোদা কারণ, সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয় না। এক তরুণ শিক্ষক বলছিলেন যে, তিনি রোজ একটি ভ্যানরিকশা করে বিদ্যালয়ে যান এবং সেই রিকশাচালকের পুত্র সেই বিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই ছেলেকে আর বিদ্যালয়ে দেখছেন না শিক্ষক, ফলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ছেলে আসছে না কেন। রিকশাচালক জানালেন যে, ছেলে টিউশনিতেই পড়ে, স্কুলে কিছু হয় না। শিক্ষক বললেন, অন্তত মিড-ডে মিলের খাবারটা তো গেলে পাবে। রিকশাচালক বললেন, স্যর, ছেলেকে আমি খাওয়াতে পারি, ওকে তো স্কুলে পাঠিয়েছিলাম পড়ার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়। সেই শিক্ষক আরও জানালেন যে, তাঁর বিদ্যালয়ে মাত্র ৪০ শতাংশ ছাত্র মিড-ডে মিল খায়, কিন্তু অর্থ আসে সবার জন্য। এই মিড-ডে মিল পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে বেশ রেষারেষি চলে, কারণটা বলার দরকার পড়ে না। ২০২২ সালের সমীক্ষায় অসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রথম’ জানাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে এবং সারা দেশে তারাই সবচেয়ে বেশি (৭৪ শতাংশ) প্রাইভেট টিউশন নেয়। এক কথায় সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সবচেয়ে ভাল বেতন পেয়েও বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন না, ফলে দরিদ্রতম ছাত্রছাত্রীদেরও টিউশনি নিতে হয়।
এ সব সমস্যা কি শিক্ষকেরা জানেন না? বিরোধী দলের শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা কি সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই অনাচার নিয়ে কোনও আওয়াজ তোলেন? পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার এই অবস্থা নিয়ে বামপন্থীরা কী ভাবেন দেখা যাক। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে আলোচিত ৩০টি বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল শিক্ষা। তাতে যথারীতি বেশ কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে এবং বিদ্যালয় বন্ধের বাজারে আরও বিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয় না, ছাত্রছাত্রী-সংখ্যা কমে যাচ্ছে, শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না, প্রাইভেট টিউশনের ভারে জর্জরিত দরিদ্র ছাত্রছাত্রীরা, এ সব কোনও কিছুই তাদের চোখে পড়েনি।
এখন রাজ্যের প্রায় একক বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির ২০২১-এর নির্বাচনী ইস্তাহার আরও চমকপ্রদ— বলা যায়, কৌতুকবহ। নির্বাচনী ইস্তাহার বা দলীয় ভাষায় ‘সঙ্কল্পপত্র ২০২১’-এ পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কিত অলঙ্কৃত শিরোনামে মহিলা, কৃষি ইত্যাদি নিয়ে ১৫টি বিষয়ে মতামত রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা বিষয়টাই নেই। এই সঙ্কল্পপত্র দেখে কেউ মনে করতেই পারেন যে, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি মনে করে না রাজ্যে শিক্ষা সম্পর্কিত কোনও সমস্যা আছে।
এক বিচারকের দুঃসাহসী রায় শিক্ষাক্ষেত্রের পচনকে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। অথচ, দীর্ঘ দিন চলে আসা এ ব্যাপারে কোনও বড় বা ছোট বিরোধী দলই আদৌ মাথা ঘামায়নি। সুতরাং জেলবন্দি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী অযোগ্য লোকেদের চাকরি দিয়ে খুব একটা অন্যায় বোধ হয় করেননি। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিয়ে যখন শিক্ষক থেকে রাজনৈতিক দলগুলির কোনও মাথাব্যথা নেই, তবে আর যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজন কোথায়? দুর্নীতি কোথায় নেই? অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়েই রাখা হয় যাতে শাসক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা সেগুলির মাধ্যমে হাজার রকমের সুযোগসুবিধা নিতে পারেন। বামপন্থীদের ক্যাডার বাহিনী ছিল তাঁদের নিয়োজিত সরকারি শিক্ষকেরা। তৃণমূল অন্য ঘরানার দল, তাদের কাছে এই শিক্ষকেরা অর্থ সংগ্রহের উৎস। দল চালাতে ক্যাডার ও অর্থ, দুটোই লাগে।
আজকের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির থ্রিলার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির আসলে সংবাদমাধ্যম-অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ইদানীং রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের— যাঁদের মধ্যে শিক্ষকেরাও আছেন— ডিএ বৃদ্ধির আন্দোলন, ধর্না সংবাদমাধ্যমের পাতা ও টিভির পর্দা গরম রাখছে। অর্থনৈতিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত ভবিষ্যতের এই গোষ্ঠীর আরও বেতন বৃদ্ধির জন্য রাজ্যের নব্বই শতাংশ লোকের কোনও মাথাব্যথা নেই, বরং এক রকমের বিরোধিতাই আছে। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলেরা। কারণ এখন সংবাদ, টিভি ও কাগজে শিরোনাম, টিভির পর্দা জুড়ে সচ্ছল মানুষদের ধর্নার পিকনিক। ফলে এটাই এখন কাগুজে বাঘদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy