Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
কামরাঙা বুটি, কলমিলতা পাড় বোনার শিল্পীরা ছাড়ছেন তাঁত
Tant Saree

পলিয়েস্টার বাংলা

বাংলার তাঁতির দশা বেশ করুণ। উপকরণ আর শ্রম মিলিয়ে হাতে-বোনা শাড়ির দাম অন্তত আটশো টাকা, যেখানে মেশিনে-বোনা শাড়ি সাড়ে তিনশো টাকায় মেলে।

A Photograph of a saree weaver

টানা আর পড়েন, দুটোতেই থাকে একশো কাউন্টের সুতির সুতো। ফাইল ছবি।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:২২
Share: Save:

গৌরাঙ্গ বসাকের ঘরখানি সাদামাটা। সিমেন্টের মেঝে, তক্তপোশের খাট। দুপুরেও টিউবলাইট না জ্বালালে ছায়া-ছায়া লাগে। সেই ঘরে বসে নিজের হাতে বোনা কাপড়খানি যখন খুলে ধরলেন, বাংলার সব উৎসব যেন হেসে উঠল এক সঙ্গে। স্বচ্ছ জলের মতো সাদা জমি, স্থির বিদ্যুতের মতো রাঙা পাড়, তা থেকে লাল-সোনালি শিখা উঠছে। দীপ্ত অথচ স্নিগ্ধ, যেন বাংলার মুখ। “এই হল ভেলভেট পাড়”, বললেন গৌরাঙ্গবাবু। “পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বুনেছি। অন্যরা এ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বড় কঠিন।” একটা শাড়ির সুতো তৈরি করতেই পাঁচ দিন লাগে। কোরা সুতোর জট ছাড়িয়ে, তিন দিন জলে চুবিয়ে, শুকিয়ে, ভাত-খই-চটকানো মাড় লাগিয়ে লাটাইয়ে জড়াতে হয়। তা থেকে চরকায় ঘুরিয়ে নলিতে বসাতে হয়, সেই নলি বসে তাঁতে। টানা আর পড়েন, দুটোতেই থাকে একশো কাউন্টের সুতির সুতো (গামছায় থাকে চল্লিশ কাউন্ট, মসলিনে চারশো-পাঁচশো কাউন্ট)। বর্ষায় সুতো নরম হয়, খরায় টান, সেই বুঝে তাঁতের ‘সেটিং’ হয়। এ বার হ্যাপা চুকল। ভেলভেট-পাড় শাড়ি বোনা বন্ধ করলেন গৌরাঙ্গবাবুও। এর কৌশল যদি বা ক’জন এখনও জানেন, নিয়মিত উৎপাদনের অভাবে তা হারানোর মুখে। ‘জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা’, হাসলেন গৌরাঙ্গবাবু।

বাংলার তাঁতির দশা এই হাসির মতোই করুণ। উপকরণ আর শ্রম মিলিয়ে হাতে-বোনা শাড়ির দাম অন্তত আটশো টাকা, যেখানে মেশিনে-বোনা শাড়ি সাড়ে তিনশো টাকায় মেলে। “বেসরকারি হিসাবে গত দশ বছরে শান্তিপুরে অন্তত পঞ্চাশ হাজার হস্তচালিত তাঁত বন্ধ হয়েছে”, বলছে তাঁতিদের পত্রিকা টানাপড়েন-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। ফুলিয়া, শান্তিপুর, সমুদ্রগড়ের তাঁতি পরিবারের তরুণরা দিনমজুরি করছেন কেরল-গুজরাতে। স্বরূপগঞ্জ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার রাস্তার ধারে স্তূপাকার ভাঙা তাঁত পড়ে, পাশ দিয়ে টোটো চালাচ্ছেন তাঁতিরা। ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ রাজ্যে পাওয়ারলুমের দাপট শুরুর পর হ্যান্ডলুম ঝুঁকতে শুরু করেছিল, কোভিড অতিমারি তার কোমর ভেঙে দিয়েছে।

চালকল আসতে ঢেঁকি সরে গিয়েছে, ট্র্যাক্টর আসতে হাল-বলদ। তেমনই পাওয়ারলুম (এক সঙ্গে দুটো শাড়ি বোনা হয়) বা র‌্যাপিয়র (এক সঙ্গে আটটি শাড়ি বোনে) হাতে-চালানো তাঁতকে কোণঠাসা করবে, এ কি অবধারিত নয়? এই ‘যুগের হাওয়া’ তত্ত্ব মানা যেত, যদি না তাতে থাকত প্রতারণার দুর্গন্ধ। কোন খাবার আমিষ, কোনটা নিরামিষ, তা জানানোর প্রতীক আবশ্যক করেছে সরকার। কিন্তু কোনটা হাতে-বোনা শাড়ি আর কোনটা মেশিনের, কোনটা খাঁটি সুতির আর কোনটায় মিশে আছে পলিয়েস্টার (বাম্পার) সুতো, বোঝার উপায় নেই। প্রতি সপ্তাহে দু’তিন ট্রাক পলিয়েস্টার সুতো ঢোকে ফুলিয়াতে। পাইকারি হাট-বাজার, বুটিক-শো’রুম তো বটেই, সরকারি দোকানেও পলিয়েস্টার-মেশানো, মেশিনে-বোনা শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ‘হ্যান্ডলুম’ বলে। ৩ জানুয়ারি, ২০২৩ পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের নিরোল থেকে ধনঞ্জয় গুঁই প্রমুখ চব্বিশ জন তাঁতি মুম্বইয়ের খাদি কমিশনারকে চিঠি লিখে আর্জি করেন, খাদি সংস্থায় পাওয়ারলুমের কাপড় বিক্রি বন্ধ করতে উদ্যোগ করা হোক। না হলে পথে বসবেন তাঁতিরা। তন্তুজের কলকাতার একটি দোকান থেকে ‘হ্যান্ডলুম’ মার্ক দেওয়া সুতির জামদানি কিনলেন এই প্রতিবেদক, পয়লা বৈশাখের দু’দিন আগে। শো-রুমের এক কর্মীই জানালেন, ওটি পাওয়ারলুমে তৈরি। মুম্বইয়ের জেজে স্কুল অব আর্ট-এর স্নাতকোত্তর, টেক্সটাইল ডিজ়াইন বিশেষজ্ঞ শ্যাম বিশ্বাস বলেন, “বেগমপুরি, তাঁত জামদানিতে আকছার পলিয়েস্টার মেশানো হচ্ছে, পাওয়ারলুমে বোনা হচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি, যদিও প্রায়ই হ্যান্ডলুম মার্ক লাগানো হয় সেগুলিতে।”

এক প্রবীণ তাঁতি বললেন, “শাড়ি বাঁধার ছিলাটায় (দড়ি) আগুন ধরিয়ে যদি দেখেন ছাই হল, তা হলে সুতি। যদি কালো আঠা হয়ে যায়, তা হলে পলিয়েস্টার।” এমন অগ্নিপরীক্ষা করতে হত না ক্রেতাকে, যদি ‘হ্যান্ডলুম মার্ক’-এর যথাযথ ব্যবহার হত। কেন এই চিহ্নের যথেচ্ছ অপব্যবহার থামানোর চেষ্টা নেই? রাজ্য সরকারের ‘ডিরেক্টর অব টেক্সটাইলস’ উদয় স্বরূপ বলেন, তাঁর দফতরের এনফোর্সমেন্ট শাখার আধিকারিকদের সরকার আয়োজিত নানা মেলায় গিয়ে দেখার কথা, হ্যান্ডলুম মার্ক-এর অপব্যবহার হচ্ছে কি না। কিন্তু যথেষ্ট কর্মীর অভাবে তা সব সময়ে সম্ভব হয় না। প্রশ্ন হল, ক্রেতাকে প্রতারণার ঢালাও সুযোগকে কি ‘বাজারের নিয়ম’ বলা চলে?

তেমনই, আইনের সুরক্ষা-প্রাচীর ফুঁড়ে ব্যবসায়ী-মহাজন রাস্তা তৈরি করলে তাকে কি ‘বাজারের গতি’ বলা চলে? ‘হ্যান্ডলুমস রিজ়ার্ভেশন অ্যাক্ট, ১৯৮৫’ অনুসারে অন্তত এগারোটি পণ্য পাওয়ারলুমে তৈরি নিষিদ্ধ। তালিকার শীর্ষে শাড়ি, তার পর ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, প্রভৃতি। অথচ, পাওয়ারলুমে শাড়ি তৈরি হচ্ছে আকছার। “আমরা দেখতে পাই, সরকারি ইনস্পেক্টর এলে দেখতে পান না”, অভিমান করে বললেন ফুলিয়ার এক সমবায় কর্তা। এক জেলা হ্যান্ডলুম অফিসার অবশ্য বললেন, সংগৃহীত নমুনাটির কতটা সুতি, কতটা পলিয়েস্টার, জানতে ল্যাবরেটরিতে পাঠানোই নিয়ম। অত ল্যাব নেই, অত কর্মীও নেই। তার উপর, গত ডিসেম্বর থেকে পাওয়ারলুম বসানোর খরচে, বিদ্যুতের বিলে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ফুলিয়ায় গিয়ে দেখা গেল, যে পাওয়ারলুমে সরকারি বরাতের স্কুল ইউনিফর্মের নীল কাপড় (তন্তুজ-সরবরাহিত সুতো, ৬৫ শতাংশ পলিয়েস্টার!) বোনা হচ্ছে, সেখানেই তৈরি হচ্ছে ‘বাম্পার’ সুতোর শাড়ি। পলিয়েস্টারের পরিবেশ-বৈরিতা, সহজদাহ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নেই, জানছে স্কুলপড়ুয়াও।

হাল-বলদ বা টাইপরাইটার উৎপাদিত পণ্যে কোনও মূল্য যোগ করত না। কিন্তু হস্তচালিত তাঁত বস্ত্রশিল্পের রূপকার। সূক্ষ্ম সুতির সুতো আর লোহাকাঠের তাঁত, এই দিয়ে বাংলার তাঁতিরা যা সৃষ্টি করেছেন, তা কেবল শিল্পের উদ্ভাবনী ক্ষমতায়, উৎকর্ষে অবিকল্প। ‘উবিগীত’ নামে বাংলাদেশের একটি সংস্থা ধলেশ্বরীর তীরের তাঁতিদের থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির আটত্রিশটিরও বেশি বুটির নাম পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে তিনপাতা, ঢেঁকিশাক, ভোমরা, কাঁকড়া, কামরাঙা, করলা, টিকলি, লাঙল, হারিকেন, লাটিম, পাখা, বীণবাঁশি। এপার বাংলায় মিলল পাড়ের নকশার নাম— কুঞ্জলতা, কলমিলতা, জোড়াপাতা, ধানগাছি, কাজললতা, তুলসীমঞ্চ। এখন সুরাত, কলকাতায় কম্পিউটারে নকশা তৈরি হচ্ছে, হ্যান্ডলুমের ঐতিহ্যবাহী নকশার মেধাস্বত্ব সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। তাঁতি আজ পাওয়ারলুমের ‘সুইচ অপারেটর’।

অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, সমস্যাটা কেবল তাঁতির রোজগারের নয়। কাটোয়ার তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছে, “সূক্ষ্ম জামদানি তৈরি করে যথেষ্ট রোজগার করছেন যে তাঁতি, তাঁর ছেলেমেয়েও আর তাঁত বুনতে চায় না। বরং কলকাতার শপিং মলে সিকিয়োরিটি বা সেল্‌স-এর কাজ করতে চায়।” যদি হাতের তাঁত আবার ‘কুল’ হয়ে ওঠে তরুণ প্রজন্মের কাছে, তা হলে হয়তো এরা ফিরতে পারে, মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে বিবি রাসেল বিশ্ববাজারে সমাদৃত করেছেন গামছাকে, একরঙা নরম সুতির শাড়ি ফ্যাশনেবল করেছেন ঢাকার তরুণীদের কাছে। তাঁর মতে, সব শ্রেণির মানুষের উপযোগী হ্যান্ডলুম উৎপাদন লাভজনক হতে পারে, যদি যথাযথ বিপণন ও প্রচার হয়।

তবে অধিকাংশ তাঁতির আশঙ্কা, ‘বিশ্ববাংলা’ নিগমের মতো কতিপয় সংস্থার হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে খাঁটি তাঁতের শাড়ি ক্রমশ অতি-ধনীর বিলাসবস্ত্র হয়ে উঠবে। সঙ্কীর্ণ সেই বাজার থেকে বাদ পড়বেন ফুলিয়া-শান্তিপুর-সমুদ্রগড়ের অধিকাংশ তাঁতশিল্পী। বাংলার পল্লিপ্রকৃতি, সমাজজীবন, ঘরকন্নার সঙ্গে বাঙালি মেয়ের আটপৌরে বসনের সংযোগ ক্রমে মিলিয়ে যাবে। নববর্ষে অভিজাত ক্লাবে বিতর্ক সভা হবে, ‘বাঙালি কি তার ঐতিহ্য হারিয়েছে?’ পাওয়ারলুমে বোনা পলিয়েস্টার জামদানি পরে শুনতে যাবে বঙ্গললনা।

অন্য বিষয়গুলি:

Tant Saree Weavers sarees
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE