বহুরূপ: সীতার সন্ধানে সুগ্রীবের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণের পরামর্শ, শিল্পীর চোখে। উইকিমিডিয়া কমনস।
বিশেষ অর্থে বাঙালিদের ও নির্বিশেষ অর্থে ভারতীয়দের রবীন্দ্রনাথ একটি সাধারণ অধিকার প্রদান করেছিলেন। সে অধিকার রামজন্মভূমির অধিকার নয়, রাম মনোভূমির অধিকার। এই অধিকার প্রদানের অর্থ রামের প্রতি অসম্মান প্রকাশ নয়, শুধু এটুকুই তিনি বলতে চেয়েছিলেন: কবিরা তাঁদের কল্পনায় যে রামকে গড়ে তোলেন সেই রামের অবস্থান কবির মনোভূমিতে, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার থেকেও তা সত্যতর। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষায়, “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।” এ কথা যখন কবি লিখছেন তখন তাঁর কল্পনারও অতীত যে রামচন্দ্রকে ঘিরে কোনও ভৌগোলিক বা স্থানিক অধিকারের লড়াই এক দিন এ ভূখণ্ডে রাজনৈতিক ভাবে প্রবল হয়ে উঠবে। বাল্মীকির মহাকাব্যের এই চরিত্রটিকে নিয়ে ভারতবর্ষীয় কবিদের নানা রামকথা রবীন্দ্রনাথকে যথাযথ ভাবেই বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল, ‘রাম’ চরিত্রটি বর্ণময়, একরঙা নয়। তাঁকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জনসমাজ আবেগ ও যুক্তিকে নানা ভাবে প্রকাশ করতে চায়। ভারতীয় রাম কোনও একমাত্রিক যুদ্ধজয়ী মিলিটারি মূর্তি নয়— তাঁকে নানা ভাবে গ্রহণ করা যায়, তাঁকে নানা ভাবে বিরুদ্ধ প্রশ্নও করা যায়, তাঁকে নানা ভাবে ভালবাসাও যায়।
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে কেন রবীন্দ্রনাথ রামের পক্ষে কবির মনোভূমিকে ঢের সত্য বলে স্বীকার করেছিলেন, তার কারণ তাঁর শৈশব যাপনের মধ্যেই নিহিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-তে আছে, ছেলেবেলায় তিন রকম রামায়ণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছে তিনি বাল্মীকি রামায়ণের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। সে খবর পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের মা। সেকালে বাঙালি বাড়িতে কৃত্তিবাসের জনপ্রিয়তা অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ’ পড়ে জীবন কাটায়। সেখানে বালক বয়সে তিনি পড়ছেন সংস্কৃত রামায়ণ। মা ছেলেকে বলেছিলেন, “আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।” রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ‘সেই’ রামায়ণেই আটকে থাকলেন না, “আমরা পণ্ডিতমহাশয়ের নিকট পাঠ সমাপন করিয়া কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত পড়িতে বসিতাম। রামচন্দ্র ও পাণ্ডবদিগের বিপদে কত অশ্রুপাত ও সৌভাগ্যে কী নিরতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি তাহা আজিও ভুলি নাই।” কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ নয়, নানা নতুন কাহিনি সংযোজিত হয়েছে। বাল্মীকির রাম যা করেছেন, কৃত্তিবাসের রাম সব সময় সে আচরণ করেননি। তাতে বালক রবির কোনও সঙ্কটই হয়নি। শুধু তাঁরই বা কেন, কোনও রাম-অভিলাষী পাঠকেরই সে বিষয়ে সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। বাঙালির যেমন কৃত্তিবাস তেমনই অবাঙালি সাধারণের তুলসীদাস। সেই তুলসীদাসের রামায়ণের মহিমাও বালক রবি টের পেয়েছিল। লিখেছিলেন, “আমার মনে পড়ে বাল্যকালে প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির দারোয়ানরা তুলসীদাসের রামায়ণ গান করত। তারা সেই গান থেকে যেন অমৃতলাভ করে সমস্ত দিনের ক্লান্তি দূর করত— তাদের অবসর সময়কে রসময় করে তুলত। তাদের ভিতর দিয়ে আমি সর্বপ্রথম তুলসীদাসের প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি।”
বালক রবির কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ার বই। পরে সন্দেশ পত্রিকায় ছেলেমেয়েদের জন্য রামকথার নানা কাহিনি পরিবেশনকালে এক অর্থে বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের পথেই খানিক হাঁটবেন উপেন্দ্রকিশোর। কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘লঙ্কাকাণ্ড’ পড়লে দেখা যাবে সেখানে যুদ্ধ খুব ‘সিরিয়াস’ বিষয় নয়, যুদ্ধের মধ্যে মজা-রঙ্গ হচ্ছে। আবার তরণীসেনের মতো চরিত্র এনে কৃত্তিবাস দেখাচ্ছেন, এ আসলে ভক্ত-ভগবানের লড়াই। কৃত্তিবাসের রাবণও প্রচ্ছন্ন রামভক্ত। কৃত্তিবাসী লঙ্কাকাণ্ডের মজাদার ঐতিহ্য ছিল বলেই সুকুমার রায় লক্ষ্মণের শক্তিশেল লিখতে পারেন, অবনীন্দ্রনাথ ও লীলা মজুমদার রামায়ণ নিয়ে রসিকতা করতে পারেন। এমনকি বিবেকানন্দও কৃত্তিবাসে মজেছিলেন, দস্যু রত্নাকরের কাহিনি তাঁর বক্তৃতায় উঠে এসেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রচনার শেষে তিনি লিখেছেন, “রামায়ণ কি না আর্য্যদের দক্ষিণি বুনো-বিজয়!!... কোন্ গুহকের, কোন্ বালির রাজ্য, রামচন্দ্র ছিনিয়ে নিলেন— তা বল না?... তুমি ইউরোপী, কোন্ দেশকে কবে ভাল করেছ?... যেখানে দুর্ব্বল জাতি পেয়েছ, তাদের সমূলে উৎসাদন করেছ...।” অর্থাৎ রামকে যুদ্ধবাজ বলা মানে পাশ্চাত্যের মডেলে রামকে দেখা। বাল্মীকি পড়া, কৃত্তিবাসে সিঞ্চিত, রামকৃষ্ণদেবের রামলালার প্রতি ভক্তির প্রভাবে পরিচালিত বিবেকানন্দ রামের উপর পাশ্চাত্যের যুদ্ধবাজ মডেল চাপাতে নারাজ। বিবেকানন্দ রামরথের ঘর্ঘর শব্দের পক্ষপাতী নন।
ছাপা বইয়ের জগতে যখন এই ভাবে রামকথার চলাচল, বাইরেও কিন্তু রামকথার চলাচল বন্ধ হয়নি। তুলসীদাসের ভক্তিবাদী রামকথা নিরক্ষর খেটে-খাওয়া মানুষদের মনে আনন্দের সঞ্চার করেছে। সারা দিনের খাটুনির পর তাঁরা শুধু রামায়ণ গানই করেন না, সেই রামকথা নিজের মতো ব্যাখ্যাও করতে চান। রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে লিখেছিলেন রক্তকরবী নাটক। সেখানে খনিশহরের শ্রমিকদের ধর্মকথা শোনানোর জন্য এক গোসাঁইকে নিয়োগ করা হয়েছিল। খনিশহরের অর্থনীতির চাকা যাতে মসৃণ ভাবে ঘোরে তারই জন্য সে শ্রমিকদের ‘বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত’ ধর্মকথা শোনাত। খনিশহরে মদের দোকান, অস্ত্রাগার আর মন্দির পাশাপাশি রয়েছে। সে নাটকে খনিশহরের প্রশাসন অর্থনৈতিক স্বার্থে বিশেষ ধর্মকে চাঙ্গা রাখতে চাইছে, সেই ধর্মের মাধ্যমে শ্রমিকদের মগজধোলাই করতে চাইছে। এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা-শোনা অবাঙালি দারোয়ানদের, খেটে-খাওয়া মানুষদের রামায়ণী গানের পার্থক্য দুস্তর। প্রথমত, দারোয়ানরা ইচ্ছেমতো রামগান করছেন, সেই রামগান তাঁদের গায়কিতে নানা অর্থে বিস্তার লাভ করছে। তাঁদের রামগান শোনানোর জন্য কোনও প্রশাসন-পোষিত গোসাঁইয়ের প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন-পোষিত ধর্মগীতি নয় বলেই স্বতঃস্ফূর্ত এ গানে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ পূরণ করা হচ্ছে না। প্রশাসনিক ধর্মপ্রচারকের নীরব শ্রোতা তাঁরা নন, ধর্মগীতির তাঁরা নিজেরাই গায়ক ও উপভোক্তা।
এ দিক থেকেই সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর ঢোঁড়াই চরিতমানস উপন্যাসে তুলসীদাসের রামায়ণকে খেটে-খাওয়া ঢোঁড়াইদের চিন্তার সঙ্গে বুনে দেন। চার পাশে যা ঘটে, ঢোঁড়াই তুলসীদাসের পদের সাহায্যে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়। সে ভাবে “চেরমেন সাহেব আর কলস্টর সাহেব ইচ্ছা করলে তাৎমা ধাঙড়দের অনেক কিছু ভাল করতে পারে।” তবে তাদের উপরে আছে রামজী— “রামজীর মর্জি ছাড়া তো কিছু হওয়ার উপায় নেই। কখন না কখন গরীবদের কথা তাঁর মনে পড়বেই। গই বহোর গরীব নেবাজু/ সরল সবল সাহিব রঘুরাজু।” সরল সবল প্রভু রঘুরাজ হারানো ধন ফিরিয়ে দেন আর গরিবকে পালন করেন— এই তুলসীদাসী বচন রবীন্দ্রনাথের শৈশবে দারোয়ানদের যে ভাবে ভরসা দিত সে ভাবেই সতীনাথের ঢোঁড়াইকেও ভরসা দিত। এই ভরসা ভক্তের আশ্রয়— বাস্তবের রাজনীতি এই আশ্রয় থেকে ক্রমে খেটে-খাওয়া তুলসীদাসী বচনে বিশ্বাসী মানুষদের বিচ্যুত করেছে। রামবিশ্বাসীদের রামের প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা উপর থেকে জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিতে চাইছে নির্দিষ্ট এক ভৌগোলিক মন্দিরের অবস্থাননির্ভর যুদ্ধবাজ পৌরুষময় রামের মূর্তি।
এই চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। দূরদর্শনের পর্দায় সকল ভারতীয় গত শতকের আশির দশকে যে রামায়ণ প্রতি রবিবার সব কাজ ফেলে দেখতেন, সেই রামায়ণ এই প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছিল যে, রাম-সম্বন্ধীয় ‘একটি আখ্যান’কে শ্রাব্য-দৃশ্য প্রচারের মাধ্যমে বড় করে তোলা সম্ভব। সেই পথেই নানা উপপথের সহায়তায় রামরথ, রামরাজ্য, রামমন্দিরের ক্রম রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশ। রামায়ণ প্রদর্শনের সময় প্রথমেই ভাবা যায়নি যে রামকথার নানা আখ্যানকে চাইলে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা যায়, কিন্তু ক্রমে তা বোঝা গেল, পরে সে চেষ্টা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কেন্দ্র দখল করল। রবীন্দ্রনাথ যাকে কবির মনোভূমি বলেছিলেন, ঢোঁড়াইরা তাঁদের মনোভূমিতে যে রামজির কাছে আশ্রয় পেত, সেই আশ্রয়ের জগৎ আর রামজন্মভূমির নামে রাষ্ট্র-পোষিত হিন্দুত্ববাদী উপসর্গের মাধ্যমে জনসাধারণকে করসেবক বানিয়ে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ হিসাবে উত্তেজিত করে ভুলিয়ে রাখার জগৎ এক নয়।
রামভক্তের মনের যে নিজস্ব জগৎ, সেই জগৎটিকেই রাজনৈতিক কৌশলে দখল করে রামজন্মভূমির নামে মাতিয়ে তোলার আধুনিক আয়োজন। এই আয়োজনের বিরুদ্ধতার একটা উপায় হতে পারে, ভারতের নানা ভাষায় নানা ভাবে যে রামমূর্তি কবিদের মনোভূমিতে আছে, সেই নানা রামের কথায় এক রকম রামকে প্রশ্ন করা। জন্মভূমির নির্মাণকে মনোভূমির বহুত্ব দিয়ে প্রশ্ন করা চাই। মনে রাখতে হবে এই নানা রকম রাম আসলে রামের যেমনটি হওয়া উচিত, রাম যেমন হলে ভাল হয়— এই ‘গণতান্ত্রিক’ বহুত্ব
তুলে ধরছে। রাম ভারতীয়দের কাছে এমন একটি ‘মূর্তি’ যা পরিবর্তমান ও বহু রকম— এক রামের কোনও ক্রিয়া অপছন্দ হলে তাকে অন্য রামমূর্তি দিয়ে প্রশ্ন করা চলে। রামজন্মভূমি আন্দোলন রামমনোভূমির এই গণতান্ত্রিক প্রশ্নশীলতার অধিকারকে হরণ করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy