উৎখাত: কলকাতার নিউ মার্কেট চত্বরে হকারদের বিক্ষোভ প্রদর্শন। ছবিঃ স্বাতী চক্রবর্তী।
গত কয়েক দিন ধরে কলকাতায় ও অন্যান্য কিছু শহরে ‘বেআইনি দখলদার’ উচ্ছেদ অভিযান চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর হুকুম। কিন্তু, অভিযান শুরু হতেই সেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আগামী এক মাসের জন্য ‘বেআইনি দখলদার’-বিরোধী অভিযান থমকে গেল। আগামী এক মাস হকারেরা নিজেদের মতো করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবেন, প্রশাসন পুর প্রতিনিধি আর হকার সংগঠনগুলির নেতাদের সহযোগিতায় একটি ‘সার্ভে’ করে নির্ণয় করবে, কারা আইন মেনে হকারি করেন, কারা আইন ভেঙে। যাঁরা ফুটপাতের তিন ভাগের এক ভাগ নিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁরা থাকবেন, আর যাঁরা রাস্তা জুড়ে পসরা নিয়ে বসে আছেন, তাঁদের সরানো হবে। প্রশাসন তাঁদের জন্য অন্যত্র জায়গা দেখবে। প্রথমে কিছু উচ্ছেদ করে সবাইকে বার্তা দিয়ে বলা হল যে, উচ্ছেদ স্থগিত রেখে হিসেবনিকেশ করা হবে, শাসিতের সম্মতি আদায় করা হবে। আধিপত্য ও নেতৃত্বের মধ্যে একটা ফারাক আছে। দ্বিতীয়টি কাম্য। উচ্ছেদ আধিপত্য-গামী। এই উচ্ছেদের নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট এবং জরুরি রাজনৈতিক বার্তা আছে।
কলকাতা শহরের সমাজ এবং অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে হকার। দেশভাগের আগের কলকাতায়ও হকার ছিল। মহাফেজখানায় কিছু ইউনিয়নের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯২৪ সাল নাগাদ এক দিকে দেশবন্ধুর সমর্থকরা, অন্য দিকে সুরাবর্দির সহকারীরা দু’টি ইউনিয়ন বানিয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতাপূর্ব কলকাতায় হকারেরা আজকের মতো সংগঠিত ছিলেন না। হকারদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যক মানুষই ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আসা হিন্দি ও উর্দুভাষী। দেশভাগের পর সারা রাজ্য জুড়ে জবরদখল শুরু হয়। সেটা ছিল উদ্বাস্তুদের বাঁচার লড়াই। ১৯৫০-৬০’এর দশক জুড়ে কলকাতার ফুটপাত সংগঠিত ভাবে ‘বেদখল’ হয়। এই উদ্বাস্তু হকারদের অনেকেই ছিলেন উচ্চবর্ণের শিক্ষিত মানুষ। বাঙালি ও হিন্দু। এই দুই দশকে কলকাতায় হকারদের চরিত্র বদলে যায়। হিন্দি-উর্দুভাষী হকারেরা তুলনামূলক ভাবে সংখ্যায় কমে যায়, আর মুসলমান হকারেরা সরতে সরতে কেবলমাত্র কিছু মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে ভিড় করেন। ১৯৪৬, ১৯৫০, ১৯৬৪-র দাঙ্গার ইতিহাস, ফুটপাতের ইতিহাস আর উদ্বাস্তু-ইতিহাস এক সুতোয় গাঁথা। একটার কথায় অন্যটা চলে আসে।
১৯৭০-এর দশকে ফুটপাত হকারদের মধ্যে আরও কিছু পরিবর্তন আসে। প্রথম প্রজন্মের উচ্চবর্ণের উদ্বাস্তু হকারেরা ধীরে ধীরে অন্য কাজে চলে যান। দাদা হকারি করে ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। পাশ করে ভাই স্কুলে চাকরি পান, কয়েক বছর পর দাদার জন্য আস্ত একটা দোকান ভাড়া নিয়ে ফেলেন। গাড়িয়াহাটে কান পাতলে আজও এই সব গল্প শোনা যায়। এই দশক জুড়ে কলকাতায় হকারি করতে নামেন হাজার হাজার নমশূদ্র উদ্বাস্তু আর দুই চব্বিশ পরগনা থেকে আসা পরিযায়ী মানুষ। এঁদের সবাই প্রায় কৃষক বা কৃষিশ্রমিক ছিলেন। উল্লেখ্য, পাঁচ দশক জুড়ে হকারি করার পরও এঁরা হকারই থেকে গেলেন।
১৯৮০-৯০’এর দশকে শহরে আরও হকার বাড়ল। সমস্ত বড় রাস্তার মোড়, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, ট্রাম, ট্রেন-কামরার ভিতর— সব জায়গায় হকার। কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষ সস্তায় হকারের থেকে পণ্য কেনেন। বস্তির মানুষ যে সমস্ত সামগ্রী তৈরি করেন, সেগুলো আসে হকারদের হাতে।
১৯৯৬-৯৭ সালে যখন সিপিএমের নেতৃত্বে হকার উচ্ছেদ (অপারেশন সানশাইন) হয়, তখন দেখা যায় হাওড়াহাটের বিকিকিনিতে টান পড়েছে। দেখা যায়, হকারদের সঙ্গে অন্য পেশায় যুক্ত বস্তিবাসী মানুষও অভুক্ত। সেই সময় প্রায় সমস্ত ছোট হকার ইউনিয়ন একত্র হয়ে ‘হকার সংগ্রাম কমিটি’ বানায়। এই ছোট ইউনিয়নগুলি দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় স্বাধীন ভাবেই কাজ করত। পাড়ার কংগ্রেস নেতা বা ক্লাবের দাদাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হত। অবশ্যই তোলা আদায় হত। কিন্তু, ইউনিয়নগুলি শাসক দলের শাখা হিসাবে কাজ করত না। ছোট বাম দলগুলিরও ইউনিয়ন ছিল। কিন্তু, সিপিএমের হকার ইউনিয়ন কোনও দিনই শক্তিশালী ছিল না। অপারেশন সানশাইন এই সব ইউনিয়নকে একত্র হতে সাহায্য করে। হকার সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে একজোট হয়ে হকারেরা হৃত জমি পুনরুদ্ধার করেন। অপারেশন সানশাইন এ-কথা প্রমাণ করেছিল যে, উচ্ছেদের প্রতিকার ‘পুনর্বাসন’ নয়। পুনর্বাসন হল উন্নয়ন সংলাপের সবচেয়ে বড় ধাপ্পাবাজি। যত বার হকার উচ্ছেদ হয়েছে, ঠিক তত বার দেখা গিয়েছে পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত জায়গাগুলি অনেক নিকৃষ্ট মানের। ফলত, যত বার হকার উচ্ছেদ হয়, ঠিক তত বারই হকারেরা স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করেন, অথবা হকারি ছেড়ে অর্থনৈতিক ভাবে আরও দুর্বল পেশায় নিযুক্ত হন।
অপারেশন সানশাইন-এর সময় বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় কাপড় বেচে হকারদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করেন। মিছিলে হেঁটে হকারদের পক্ষে জনমত সংগঠিত করেন। স্মর্তব্য, এর কিছু দিন পরেই তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। কলকাতার হকার, বস্তিবাসী মানুষ, রেললাইনের ধারের আর খালপাড়ের তথাকথিত দখলদারেরা নতুন দলকে আশীর্বাদ করেন। ১৯৯৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূল কলকাতা থেকে চারটি আসনে জয়ী হয়। ২০০০-এ সিপিএমের হাত থেকে কর্পোরেশন ছিনিয়ে নেয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় আন্দোলন পর্যন্ত তৃণমূল মূলত একটা শহুরে দল ছিল।
বস্তুত, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তৃণমূল গ্রামের ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই সমস্ত আন্দোলনের পিঠে ভর করে মমতা ২০১১ সালে ক্ষমতায় এলেন। এই জয় একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক চুক্তির অঙ্গ— প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে একটি চুক্তি— ‘দিদি আমাদের বড় পুঁজিপতিদের হাত থেকে রক্ষা করবেন।’ এটা কোনও আদর্শগত চুক্তি নয়। কেবলমাত্র কাজ চালানোর চুক্তি। ভোট, তোলা আর জীবন-জীবিকার চুক্তি। এই চুক্তির উপর তৃণমূলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এলে হকার-সহ তামাম প্রান্তিক মানুষ ভাবলেন, আর বুঝি উচ্ছেদ হবে না। মমতা তাঁদের ভাষায় কথা বলেন। কতকটা তাঁদেরই মতো সাদামাঠা। তিনি যেন সাধারণ হয়েও অসাধারণ। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় প্রান্তিক মানুষজন ভাবলেন এ বারে সরকার বন্ধুর মতো। এর ফলে হকারদের সংগঠনগুলি খানিক ঝিমিয়ে পড়ল। আসলে উচ্ছেদ আর নিরাপত্তাহীনতা অনেক সময় একতার একটি মূল শর্ত। উচ্ছেদ রুখতে গিয়ে মানুষের একটা রাজনৈতিক বোধ তৈরি হয়। নিরাপত্তাবোধ অনেক সময় আন্দোলন-নির্ভর সংগঠনগুলিকে সরকারমুখী করে তোলে। তারা তখন শাসক দলের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন সব গ্রাসের উদাহরণ পাওয়া যাবে। উচ্ছেদ হয়তো আপাতত বন্ধ হবে। কিন্তু, এই সহযোজন কি রোখা যাবে?
অনেক হকার সংগঠনই রাস্তার উপরে নতুন হকার বসার বিরোধী। তা হলে, নতুন হকার বসবে কোথায়? ফুটপাত তো কবেই ভরে গেছে। আজকের উচ্ছেদ হকারদের মধ্যে একটা বিভেদকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। ফুটপাতের হকার আর রাস্তার হকার দু’টি আলাদা গোষ্ঠী। রাস্তার হকারেরা তৃণমূলের আমলে, বিশেষ করে অতিমারির পরে, ডালা সাজিয়েছেন। তাঁরা আজ সংখ্যায় অজস্র। ফুটপাত হকারদের তুলনায় তাঁদের সরকারের সঙ্গে দরাদরির ক্ষমতা কম। কেন্দ্রীয় হকার আইন তাঁদের স্বীকার করে না। তাই, নতুন হকারেরা সম্পূর্ণ ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসে সমর্পিত। অন্য দিকে, পুরনো হকার সংগঠনগুলি নবাগতদের ভয় পায়। কারণ, যদি কোনও দিন উচ্ছেদ নেমে আসে, তা হলে এই নবাগতরাই হবেন পুরনো ও সংগঠিত ফুটপাত হকারদের উত্তরসূরি। যে কোনও বুদ্ধিমান প্রশাসক এই দুই গোষ্ঠীর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাকে হাতিয়ার করবেন।
ক্ষমতায় আসার পর মমতার সরকার ধীরে ধীরে গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক মানুষের জন্য কিছু কল্যাণ প্রকল্প চালু করল। কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রকল্পগুলি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে তৃণমূলের ভোটও সংহত হয়েছে। উচ্ছেদ এড়িয়ে চলা আর অল্প অল্প করে সরকারি সাহায্য প্রান্তিক মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মহিলাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্য দিকে, বড় শিল্প-বাণিজ্য প্রায় লাটে উঠেছে। শিল্প টানতে গেলে ‘আইনের শাসন’ কায়েম করা জরুরি। আবার, আমাদের মতো রাজ্যে আইনের কড়া নজরদারি প্রান্তিক মানুষের ভাত-কাপড়ের সমস্যা ডেকে আনে। তার প্রভাব পড়ে ভোটে। কাজেই, এ এক বিপজ্জনক খেলা, ভারসাম্যের রাজনীতিও বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy