Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Labour Market

শ্রমের নতুন বাজার

সারা বিশ্বে কাজের বাজার দ্রুত বদলাচ্ছে। কাজের জোগান, চাহিদা, কাজের চরিত্রে পরিবর্তন, মজুরি, সবই সরে যাচ্ছে প্রচলিত ধারণা থেকে।

Food Delivery Agent.

নিয়োগ বাড়ছে সেই সব কাজে যেগুলির চরিত্র অস্থায়ী। ফাইল চিত্র।

অশোক ঘোষ
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৩ ০৫:৩৫
Share: Save:

খুব গরম। রোদ এড়াতে দুপুরে ঘরে থাকুন, ঘন ঘন জল খান, এ সব পরামর্শ হয়তো অনেকের কাজে লাগে। অমিত দত্তের এ সবশুনে হাসি পায়। একটি খাবার ডেলিভারি সংস্থার কর্মী অমিত, অর্ডার এলেই বাইকে সুখাদ্যের ব্যাগ চাপিয়ে পথে বেরোতে হয় তাঁকে। চল্লিশ বছর পেরিয়েও মাস পয়লা বেতন আসেনি জীবনে। কমিশন-নির্ভর জীবিকায় রোজগার মাসে হাজার পনেরো টাকা। গরমে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও ছুটি নেওয়া যাবে না, কমিশন কাটা যাবে। কাজের শর্ত নিয়ে দরদস্তুর করতে গেলে চাকরি চলে যাবে। ডেলিভারি-পিছু কমিশনের টাকার অঙ্ক মাঝে-মাঝেই কমিয়ে দেয় নানা কোম্পানি, তখন কিছু দিন প্রতিবাদ, ধর্মঘট চলে। তার পর মাথা নিচু করে সকলে ফিরে আসে কাজে। মে দিবস অমিতের মতো কর্মীদের জীবনে স্রেফ আরও একটি কাজের দিন।

সারা বিশ্বে কাজের বাজার দ্রুত বদলাচ্ছে। কাজের জোগান, চাহিদা, কাজের চরিত্রে পরিবর্তন, মজুরি, সবই সরে যাচ্ছে প্রচলিত ধারণা থেকে। ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, আবার নানা ধরনের কাজে উপযুক্ত কর্মীর খোঁজ চলছে, নিয়োগ হচ্ছে। এই টানাপড়েনে শ্রমের সমস্যার স্বরূপটি তেমন ঠাহর করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। কাজ হারানো আর পাওয়ার মাঝে কিছুটা সময়ের ব্যবধান, অনিশ্চয়তা, অপে‍ক্ষা, এটাই যেন নিয়ম হয়ে উঠছে। আবার, কাজ থাকলেও তার সময়ের সীমা বাঁধা নেই, মজুরি নির্দিষ্ট নেই, সুযোগ-সুবিধাও নেই। এ কি আগের চাইতে ভাল, না খারাপ?

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র তথ্য বলছে, নিয়োগ বাড়ছে সেই সব কাজে যেগুলির চরিত্র অস্থায়ী। অর্থাৎ যেখানে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি-সহ নানাবিধ সুযোগসুবিধা দিতে বাধ্য নন নিয়োগকর্তারা। ফলে গড় মজুরি কমে যাচ্ছে দ্রুত, এমনি যখন নিয়োগকর্তার লাভের হার বেড়েছে, তখনও। এটা আরও সম্ভব হচ্ছে ‘ভার্চুয়াল’ পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়। আইএলও-র হিসাবে, বর্তমানে সারা বিশ্বে‍ প্রায় ২০০ কোটি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে। তাদের সমস্যা কাজের অভাব অতটা নয়, যতটা মজুরিতে পতনের সঙ্কট। যা বৈষম্যকে আরও প্রকট করছে, দারিদ্রকে দীর্ঘায়িত করছে‍।

শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায় করার দায়িত্ব ছিল ট্রেড ইউনিয়নের। কিন্তু শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ ও ইচ্ছা, দুটোই কমে যাচ্ছে। একই ছাদের তলায় বহু শ্রমিক নিয়ে উৎপাদনের রীতি আজ প্রায় বিলীন। শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার চেষ্টা প্রতিহত হচ্ছে ছাঁটাইয়ের ঝুঁকির জন্য। রয়েছে ‘গিগ অর্থনীতি’-র আকর্ষণও। কর্মরত কর্মীটি ভাবছেন, একটু ভাল মজুরি পেলে অন্য কোম্পানিতে চলে যাবেন। একই সংস্থায় আরও বেশি সুযোগের জন্য আন্দোলন করার দরকার কী? বরং বেশি কাজ করে বেশি উৎসাহ ভাতা বা ‘ইনসেন্টিভ’ চান তাঁরা। এ ভাবে যথাসম্ভব রোজগারের চেষ্টায় কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

ভারতে নীতি আয়োগ জানাচ্ছে, অর্থনীতিতে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে মিলিত মূল্যযোগ ৮০ শতাংশ, যদিও সেখানে কাজ করে কর্মরত বাহিনীর ৫৪.৪ শতাংশ। এখানেই প্রতিনিয়ত পুরনো ধরনের কাজ মিলিয়ে যাচ্ছে, নতুন কাজ তৈরি হচ্ছে। কাজের চাহিদা হচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়া, সমাজমাধ্যম, স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে। এ ছাড়া অ্যাপ-নির্ভর ডেলিভারি, বিবিধ পরিষেবা, বিনোদন, রিপেয়ারিং, মেনটেন্যান্স ইত্যাদি কাজের প্রসার হয়েছে। অটো, টোটো, অ্যাপ ক্যাব-এর মতো পরিবহণ শিল্পে ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে চালক ও সারাই কর্মীর চাহিদা প্রচুর। এমনকি শৌচাগার পরিষ্কার করার কাজও একটি পৃথক নিয়োগক্ষেত্র হয়ে উঠছে‍। এই সব ‘নতুন’ কাজে শ্রমিক সুরক্ষার আইনের প্রয়োগ নেই, নেই বিধিসম্মত কাজের পরিস্থিতি পরিবেশ, নেই আট ঘণ্টার মেয়াদের আশ্বাস। এই নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিক কখনও মালিকদের মুখোমুখি হয় না। আবার এই কাজগুলির ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে, তার ফলেও শ্রমের‍ চরিত্র, শ্রমের চাহিদার ধরন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে‍।

ট্রেড ইউনিয়নগুলি যে গিগ অর্থনীতির কর্মী, তথা বৃহত্তর অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের অধিকার ও স্বার্থের সুরক্ষায় যথেষ্ট সক্রিয় হয়নি, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, বা অস্থায়ী কর্মীদের জন্য সরকারের আইন নেই, এমন নয়। সুপ্রিম কোর্ট-সহ নানা আদালত অস্থায়ী কর্মীদের রোজগারের সুরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নানা রায়ও দিয়েছে। কিন্তু সে সবের প্রচার নেই, প্রয়োগের তো প্রশ্নই নেই। ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষের জীবনে নেই আট ঘণ্টা কর্মদিবসের সীমা, সামাজিক সুরক্ষার বিধি, নেই আইনের সুযোগ সুবিধা, নেই সপ্তাহে অন্তত এক দিনের ছুটি। মাতৃত্বকালীন ছুটি বা পেনশন-প্রভিডেন্ট ফান্ড তো দূরের কথা। মে দিবস এই সব প্রশ্ন ওঠাবে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Work money
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy