Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
‘তোর অতিথ গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন’
Teachers

প্রাণ জাগানিয়া

জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যুকাল, মানুষ শেখে। সে জন্য মানবজীবনে অনেক কিসিমের শিক্ষক। কেউ শেখান ভবের নিয়মনীতি, কেউ ভাবের আজব কারবার।

বন্ধু: ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি প্রয়াত শিক্ষক স্যমন্তক দাস

বন্ধু: ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি প্রয়াত শিক্ষক স্যমন্তক দাস

অভীক মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৯
Share: Save:

জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যুকাল, মানুষ শেখে। সে জন্য মানবজীবনে অনেক কিসিমের শিক্ষক। কেউ শেখান ভবের নিয়মনীতি, কেউ ভাবের আজব কারবার। এই যে তরুণ ফল-বিক্রেতা সেলিম সযত্নে সমীরণবাবুকে মিষ্টি আম কী ভাবে চিনতে হয় সেটা শেখাচ্ছিল, সে-ও কি এক অর্থে শিক্ষক নয়? “গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?/ তোর অতিথ গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন।/ কারে প্রণাম করবি মন?/ গুরু যে তোর বরণডালা,/ গুরু যে তোর মরণ-জ্বালা,/ গুরু যে তোর হৃদয়-ব্যথা/ যে ঝরায় দু’নয়ন/ কারে প্রণাম করবি মন?”

শিক্ষক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেছিলাম, স্যর, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, কেমব্রিজ স্কুল, সাবঅল্টার্ন স্কুল— এই স্কুলের বাংলা কী হবে? বললেন, “ঘরানা করতে পারো। মার্গসঙ্গীতের ব্যাপারটা মাথায় রেখো।” চমকে উঠি। বিদ্যা, বিদ্যাচর্চা, অর্থাৎ প্রথাগত শিক্ষায় লাগে শিক্ষক। এই ‘স্কুল’-এর অন্দরেও তাঁর ছায়া। ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রশিক্ষণে তাঁরই অমলিন স্বীকৃতি। অন্য দিকে, বাউল-ফকির-দরবেশি ঐতিহ্যে গুরু সর্বোচ্চ। গুরুই ঈশ্বরপ্রতিম। “তাই লালন শাহ দরবেশে বলে-/ গুরু বিনা ধন নাই সংসারে।/ সে যে কাঙ্গালের কান্ডারি গুরু,/ ধনী মানী সে করে না পার/ গুরু বিনে বন্ধু নাইরে আর।” দূর থেকে শোনা যায় মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর কণ্ঠ: “আমাদের কী ধরনের পদ্ধতি জানো? বাঘ যেমন বাচ্চাদের শিকার শেখায়। নিজে শিকার করে, বাচ্চারা তা দেখে শেখে। নিজে শিকার না করে সে যদি তাদের শিকার শেখার ক্লাস খুলত, বাচ্চারা তো শিখতই না, সে নিজে আর বাচ্চারা সকলেই না খেতে পেয়ে মারা যেত। যিনি শেখাবেন আর যে শিখবে দু’জনের মধ্যে মনে-মনে সম্বন্ধ স্থাপন করা খুব দরকার। এ তো হাত দিয়ে হাতের কাজ শেখানো নয়— প্রাণ দিয়ে প্রাণ জাগানো।”

লক্ষ করি, ‘শিক্ষকসমাজ’ নিয়ে চেনাশোনা প্রায় সকলেই সমালোচনামুখর, কিন্তু নিজের শিক্ষক-শিক্ষিকা বিষয়ে খুব স্পর্শকাতর, উচ্ছ্বাসপ্রবণ। সেই অধিকারবোধ এতই তীব্র যে, তাঁরা ব্যক্তিগত শিক্ষাগুরুকে নিয়ে কোনও নেতি-বাক্য সহ্য করতে পারেন না। প্রায় প্রত্যেকের জীবনে, কোনও না কোনও ক্ষেত্রের শিক্ষকের বিপুল প্রভাব কাজ করে। তাঁরা তা স্বীকারও করেন। ঠিক জানা নেই, পৃথিবীর অন্য কোথাও ‘শিক্ষক দিবস’ নিয়ে এত জনচাঞ্চল্য আছে কি না! বাঙালি ঐতিহ্যের গভীরে গুরু-শিষ্য পরম্পরার এক জাদুপরশ। এই জাতিগত মগ্নচৈতন্যে সম্ভবত আমরা ধারণ করি শিক্ষকের স্বীকৃতি।

প্রশ্নটা থেকেই যায়। প্রকৃত ‘শিক্ষক’ হওয়া বলতে কী বোঝায়? আদর্শ ‘শিক্ষার্থী’ তথা ‘শিষ্য’ হতেই বা কী গুণ লাগে? এ সব উত্তর স্মৃতিকথনের মধ্যে, দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে, কথা-উপকথায় ধরা থাকে। সোক্রাতেস-প্লাতো-আরিস্ততল, বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, পৌরাণিক দ্রোণাচার্য, মাস্টারদা সূর্য সেন, অদ্বৈতাচার্য, মীরাবাই, বিশপ টুটু— ভুবনজোড়া আসনখানি! এই যে রবিশঙ্কর বলছেন কী সাবলীল মুগ্ধতায় গুরু আলাউদ্দিন খাঁর কথা: “তিনি গভীর থেকে গভীরতর জ্ঞানের কথা কী অনায়াসে বেমালুম বলতে পারতেন ভাবলে অবাক লাগে। অবাক লাগত তখনও যখন সে সব কথা সামনে বসে শুনতাম। ঠিক যেমনটি শোনা যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন তাঁর শিষ্যবর্গের কাছে।”

আর রামকিঙ্কর জানাচ্ছেন, “আমার শিল্পচর্চায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল, আবার ছিলও না।... তিনি কখনও কারও কাজে ইন্টারফিয়ার করতেন না। অন্যদের করাটাও পছন্দ করতেন না। এমনকী নন্দলালবাবুকেও বলতেন, সকলকে নিজের মতন করে কাজটা করতে দিয়ো। আশ্রমটা তো ওদেরই। এখানে ওরা স্বাধীনভাবে কাজ করবে, আনন্দ পাবে।”

এই রবীন্দ্রনাথই শান্তিদেব ঘোষকে লেখেন একটি চিঠিতে: “আশ্রমের সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চলে যাবি এ সম্বন্ধে আমার বলার কিছু নেই। আমি আশীর্ব্বাদ করেই বিদায় দেব।... সিনেমা প্রভৃতির সংস্পর্শে কোন গুরুতর লোভেও যদি নিজেকে অশুচি করিস তাহলে আমার প্রতি ও আশ্রমের প্রতি অসম্মানের কলঙ্ক দেওয়া হবে।... আমার গানের সঞ্চয় তোর কাছে আছে— বিশুদ্ধভাবে সে গানের প্রচার করা তোর কর্তব্য হবে।... আমি তোর পিতার পিতৃতুল্য আশাকরি আমার উপদেশ মনে রাখবি। আর কোনো ব্যর্থ বাক্য বলতে ইচ্ছে করিনে।...” এই সমতার অনুভব, শিষ্যের প্রতি অনিঃশেষ স্নেহার্দ্র শাসন-তর্জন, শাস্ত্রকাররা যাকে বলেছেন পুত্রাধিক স্নেহে প্রতিপালনের তুল্য অভিভাবকতা— সে তো আদর্শ গুরুর কাছেই মেলে। এই গুরুর থাকে অকল্পনীয় ক্ষমতা।

সচেতন শিষ্য বলে, “...খুব সচেতনভাবে উৎপলদার প্রভাবকে এড়াতে হয়েছে। হজম করেছি, কিন্তু নকল করিনি।” কে বলছেন? উৎপল দত্তের শিষ্য রবি ঘোষ। একই সুরে শাঁওলী মিত্র বলছেন, “নকল করা যায়। কিন্তু তা ‘সত্য’ হয়ে ওঠে না।” শিক্ষার্থী জানে, এই নিজস্ব সত্যসন্ধানের পথ দেখিয়ে দেন গুরুই। শিক্ষা কোনও দানসামগ্রী নয়, সব উচ্চতা ভেঙে গুরু সহযাত্রী হিসেবে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যান নতুন নতুন উচ্চতায়। ‘গুরু বিনা জ্ঞান নেহি পাওয়ে’। শিক্ষার্থী সে জন্য শিক্ষকের প্রতিটি পদক্ষেপ জরিপ করে। শোষণ করে নেয় জীবন পাথেয়। দান্তে যেমন ‘দিভাইনা কোম্মাদিয়া’য় ভার্জিলকে দেখেছিলেন পথপ্রদর্শক হিসেবে।

সুকুমারী ভট্টাচার্য সুনীতিকুমারের সম্পর্কে জানান, “অসামান্য মেধার অধিকারী ছিলেন জন্মস্বত্বে, কিন্তু তারই সঙ্গে দেখেছি পরিশ্রম করবার অনন্যসাধারণ ক্ষমতা।... জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেল্টিক শিখেছিলেন কেন?’ উত্তর দিলেন, ‘স্বান্তঃ সুখায়।’ বারে বারে এ উত্তর শুনেছি, ভেবেছি, সে কেমন অন্তর যা বিশ্বের প্রায় সর্ববিধ জ্ঞাতব্যে এমন আগ্রহী।” একই সুরে উচ্ছ্বসিত সুশোভন সরকার শুনিয়েছেন তাঁর সমুজ্জ্বল শিক্ষক কুরুভিল্লা জ়াকারিয়া বলেছিলেন, “দ্য গ্রেট টিচার ইনফ্লুয়েন্সেস হিজ় পিউপিলস নট থ্রু দেয়ার মেমরি, বাট থ্রু দেয়ার জাজমেন্টস।” পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, প্রকৃত শিক্ষক দেন বিশ্ববীক্ষা। শঙ্খ ঘোষ বলতেন, “ছাত্রদের ভুল শেখাবে না কখনো। যার উত্তর জানো না, অকপটে স্বীকার করবে। পরের দিন দেখে বলবে। সপ্রতিভতা দেখিয়ে কোনো ভ্রান্ত তথ্য দেবে না। বোর্ডে যদি কিছু লেখো, রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু সাল হলেও, এক বার কোনো মান্য আকরগ্রন্থ দেখে রাখবে, নিজের প্রতিভার ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ভালো নয়।” এ ভাবেই শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে আসে দায়বদ্ধতার প্রেরণা, দার্ঢ্যের প্রেরণা। পাশাপাশি, শিক্ষককে এ কথাও মানতে হয় যে, ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন বা উত্তর থেকে তিনি অনবরত শেখেন, যত বড় বিদ্যারত্নই তিনি হোন না কেন।

১৯২৪ সালে জাপানে শিক্ষকদের এক সভায় একটি ভাষণ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রবন্ধাকারে ভাষণটি প্রকাশিত হয় ‘দ্য স্কুলমাস্টার’ শিরোনামে। আমাদের দেশের বিদ্যালয়শিক্ষার বীভৎস রূপটি সেখানে তুলে ধরেন তিনি। শিক্ষা, শিক্ষার্থী আর শিক্ষক— এই তিনকে বিশ্লেষণ করে নিজের শান্তিনিকেতন শিক্ষালয়ের মূল উদ্দেশ্যকে উপস্থাপন করেন। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও শিক্ষায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর, প্রথাগত শিক্ষককে তিনি দেখতেন স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে, যার উদ্দেশ্য বিস্ময় আর জীবনস্পন্দন থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে নিষ্প্রাণ জেলখানায় নিষেধমূলক উপদেশের শিকলে বেঁধে ফেলা। সেখানে আছে, ‘বাঁধাধরা দিনপঞ্জির নিরর্থক যন্ত্রণা’। আর আছে ‘বৎসরান্তে পরীক্ষা-নামক এক ভীতিপ্রদ বিচারের’, যা প্রশ্ন করতে, আবিষ্কার করতে শেখায় না, কেবল ‘অনুগত হতে শেখায়’। “ক্রমে এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হতে থাকে, তখন বিবেকের জায়গা নেয় পুলিশ। আমরা জেলখানার জন্য বন্দি জুটিয়ে আনি, পাগলা গারদের জন্য রোগী: আমরা শিশুদের মনগুলিকে সে ভাবে ফাটকে সীমাবদ্ধ করে তুলছি তাদের অন্তর্লীন ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত ক’রে...।”

নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি চেয়েছিলেন তিনটি অভিমুখের অনুশীলন— মনের মুক্তি, হৃদয়ের মুক্তি আর চিন্তাশক্তির মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাস্বপ্ন ভিন্ন এক সৃষ্টিশীল স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেয়। উৎসাহিত করে বিকল্প কোনও গুরু-শিষ্য পরম্পরার। হয়তো লালনের ‘কান্ডারি’ আর ‘বন্ধু’ গুরু কোথাও মিলে যান রবীন্দ্রনাথের মুক্তিসন্ধানী শিক্ষকের সঙ্গে। ওই প্রবন্ধের শেষ তিনটি পঙ্‌ক্তির দিকে নজর দিতে বলব। আজকের ভারতবর্ষ, আগামীর ভারতবর্ষ, আবহমানের ভারতবর্ষের শিক্ষাকল্পনা আর শিক্ষাপ্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে এই উক্তিকে বিচার করতে হবে। এ মুহূর্তে ভয়াবহ সব মনুবাদী অভিমুখের হিংস্র শ্বদন্ত শিক্ষায় ছায়া ফেলছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করেছেন। আমরা কি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণে সক্ষম? পারব তাঁর শরিক হতে?

“ঈশ্বর এক স্রষ্টা, তাঁর সন্তান হিসেবে নারীপুরুষনির্বিশেষে আমাদেরও সৃষ্টিলীলায় মেতে উঠতে হবে। কিন্তু সেটি ইস্কুলমাস্টারের, শিক্ষাপ্রশাসনের, অধিকাংশ রাষ্ট্রশক্তির অভিপ্রায়বিরোধী। তাঁরা প্রত্যেকে চান, নিজেদের জন্য যেমন অনুশাসন তাঁরা নির্ধারণ করেছেন, শিশুকে সেই অনুশাসনের কাঠামোয় বড়ো করতে।” বোঝাই যাচ্ছে, শুধু শিশুশিক্ষার সঙ্কীর্ণ পরিসরে এই কথাগুলি সীমাবদ্ধ নেই, তা মুক্তি খুঁজছে জনপরিসরে, শিক্ষাক্ষেত্রে, গুরু-শিষ্যপরম্পরার আনাচেকানাচে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষা এই সব নিয়ে কথা বলতে বলতে বহু দূর চলে এসেছি। বাংলা লোকায়ত গানে বন্দনা করা ‘মুর্শিদ’ আর রবীন্দ্রনাথের গানে নাটকে দীপ্যমান ‘গুরু’দের দেশ এই ভারতবর্ষ। এই বাংলাও। সেই ধারায় লাগুক নতুন মুক্তির রং।

অন্য বিষয়গুলি:

Teachers Society Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy