ওপেনহাইমার ছবির দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বের দ্বিতীয় ভাগ। এথেন্সের খোলা মঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সফোক্লিস আর ইউরিপিদেস। তাঁদের যিনি গুরুসম— ইস্কাইলাস— তিনি তখন অবসরের কোঠায়। তাঁর প্রমিথিউস বাউন্ড তত দিনে হতচকিত করেছে দর্শককে। অবাক বিস্ময়ে তাঁরা দেখেছেন যে, নায়ক প্রমিথিউস মাউন্ট অলিম্পিয়ার রাজরাজেশ্বর জ়িউস-এর বিরুদ্ধে গিয়ে দৈবভান্ডার থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে উপহার দিয়েছেন। কারণ? বাবা ক্রোনোসকে যুদ্ধে হারিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শাসন কায়েম করেই জ়িউস চেয়েছিলেন মানবজাতিকে চিরকালের মতো ধ্বংস করতে। কিন্তু আগুনের ব্যবহার মানুষ জেনে যাওয়ায় সেই কাজ অনেকটাই কঠিন হয়ে যায়। তাই অসীম রাগে জ়িউস প্রমিথিউসকে বাঁধলেন ককাসাস পর্বতের প্রস্তরগাত্রে। কিন্তু শত কষ্টভোগের পরও ইস্কাইলাস-এর নায়ক অনুতাপহীন; অবিচল ভাবে বরণ করলেন শাস্তি।
শুধু আগুন নয়, লেখনী, স্থাপত্য, অঙ্ক আর চিকিৎসাশাস্ত্রও প্রমিথিউস মানুষকে উপহার দেন। ইস্কাইলাসের নাটকের জোর এমনই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতেও প্রমিথিউস ছিলেন অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লবের আর্কিটাইপ— দৈবনির্ভরতা থেকে মুক্ত করে মানুষকে সভ্যতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসার প্রতীক। প্রমিথিউসে মুগ্ধ ছিলেন গোয়টে থেকে শেলি বা বায়রন, বেঠোফেন, মার্ক্স, নিটশে। তাঁদের সবার চিন্তায় বা কাব্যে প্রমিথিউস আলোকায়নের মানসসন্তান, মানুষের মুক্তির আহ্বায়ক। শেলির চার অঙ্কের প্রমিথিউস আনবাউন্ড পুরোটাই ইস্কাইলাসকে সামনে রেখে, যেন গ্রিক নাট্যকারের শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসকে উন্মুক্ত করে ইস্কাইলাসের অসমাপ্ত বিদ্রোহের আলেখ্যকে উপসংহারের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন শেলি। সেই অর্থে প্রমিথিউসের আধুনিক ব্যাখ্যা ইতিবাচক হওয়ারই কথা। কিন্তু সেটা পুরোপুরি হল না।
এর কারণ মেরি শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন (১৮১৮), যার উপশিরোনাম ‘দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’। জীবনসঙ্গী পেরসি শেলি বা বন্ধু জর্জ বায়রনের থেকে সরে এসে একেবারে অন্য প্রশ্ন তুললেন মেরি, তাঁর প্রমিথিউসের চরিত্রায়ণে। তাঁর উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, যিনি মৃতের দেহে জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার অসম্ভব পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করে অমরত্বের গৌরবাকাঙ্ক্ষী। এই অবধি মেরির বিজ্ঞানী আলোকায়নেরই বৌদ্ধিক উত্তরসূরি। যে পরীক্ষায় তিনি হাত লাগিয়েছেন, তাতে শুধু বিজ্ঞানের সীমা নয়, বিচূর্ণ হবে বিধাতার ক্ষমতা, এমনকি অস্তিস্ত্বও। অর্থাৎ চার্চকে স্পর্ধা প্রদর্শনের খেলায় নামলেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। ঠিক প্রমিথিউসের মতোই।
কিন্তু মেরি বাকিটা ভাবলেন অন্য ভাবে। ‘বিধাতা’র ভূমিকায় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন যে ‘সন্তান’-এর পুনর্জন্ম দিলেন, সে এতটাই বীভৎস যে, তাকে তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করলেন তার ‘পিতা’, আর ওই ত্যাজ্য ‘সন্তান’— অপমানিত, একাকী, আক্রান্ত— ছায়ার মতো অনুসরণ করতে লাগল তার ‘পিতা’কে, ধ্বংস করতে উদ্যত হল তার পরিবার, পরিজন, পারিপার্শ্বিক। প্রমিথিউসের আলেখ্যর বিচারে শেলির উপন্যাস যেন এক ভবিষ্যদ্বাণী। আধুনিক বিজ্ঞান আগুন উপহার দেওয়ার মত্ততায় মানুষকে নিজেই নিজের ধ্বংসের বীজ বপন করতে শেখাচ্ছে না তো? ঊনবিংশ শতকের প্রাতঃকালে, ফরাসি বিপ্লবের অনতিবিলম্বে, শিল্প বিপ্লবের গোড়ায় দাঁড়িয়ে, এনলাইটেনমেন্ট-এর প্রচেষ্টায় ধর্মের থেকে সরে এসে মানুষের স্ব-শাসনের দর্শন যখন পতাকা ওড়াচ্ছে ইউরোপে, তখন এই প্রশ্ন শুধু দুঃসাহসিক নয়, প্রায় আত্মঘাতী। বিজ্ঞানের হইহই জয়যাত্রার সামনে তিয়ানআনমেন স্কোয়্যারে সামরিক ট্যাঙ্কের সামনে থলি হাতে ওই লোকটার মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন মেরি শেলি। বিজ্ঞান শুধুমাত্র অসীমকে জয় করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বা ভবিতব্যের সঙ্গে সাপ-লুডো খেলায় হার-জিতের প্রশ্ন নয়। আজ নয় কাল বিজ্ঞান এক নৈতিক অচলাবস্থার সামনে পড়বে, তাকে পড়তেই হবে— এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য।
বিজ্ঞানের এই নৈতিক অবস্থানের তর্কটাই আবার ভীষণ ভাবে ফিরিয়ে এনেছে ক্রিস্টোফার নোলানের সাম্প্রতিক ছবি ওপেনহাইমার। ছবিটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সেই মতামতের এক দিকে নোলানের স্পেক্টাকল-বুভুক্ষু ফ্যান ক্লাব; অন্য দিকে ওপেনহাইমারকে শ্বেত-শহিদ বানাতে উদ্যত নোলান, এ রকম হাস্যকর সমালোচনাও শোনা গেছে। নোলানের ছবির শৈল্পিক পর্যালোচনা এখানে বিষয় নয়। কিন্তু যেটা অনস্বীকার্য— সিজিআই ভারাক্রান্ত মার্ভেল স্টুডিয়ো ধাঁচের সিনেমার একাধিপত্যের বাজারে অনেক দিন পর হলিউডের কোনও বিগ-বাজেট ছবি উন্মুক্ত করেছে যুক্তি, তক্কো ও গপ্পের ঝুলি। পৃথিবী জুড়েই। এক ভাবে বলা যায়, সিনেমার যা ‘আদি পাপ’— তর্কের জন্ম দেওয়া— সেটাই করেছে ওপেনহাইমার।
আইনস্টাইন বা নিলস বোরের পর ওপেনহাইমারই গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর যশ দাঁড়িয়ে আছে মূলত যে কৃতিত্বের উপরে, সেটাই ছবির বিষয় আর তর্কের তাস। এবং সেই একই কারণে ছবির চিত্রনাট্য যে বইটির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, কাই বার্ড আর মার্টিন শেরউইন রচিত, পুলিৎজ়ার পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই বইয়ের শিরোনাম আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি অব জে রবার্ট ওপেনহাইমার। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অসীম মেধাবী ও প্রতিভাধর ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে একটি দল দু’বছরে তৈরি করেছিল পারমাণবিক বোমা, নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে প্রথম সফল পরীক্ষার এক মাসের মধ্যে যার দু’টি নিক্ষেপ করা হয় জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। অগস্ট ১৯৪৫-এর সেই ঘটনার তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী বীভৎসতা আমাদের অজানা নয়। বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত ওপেনহাইমারের নয়— কোনও বিজ্ঞানীরই নয়— আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের। কিন্তু পারমাণবিক বোমার জনক হওয়ায় কাঁটার মুকুট ওপেনহাইমারেরই প্রাপ্য হল, ট্রুম্যানের নয়। বলা বাহুল্য, লেখকদ্বয় প্রমিথিউসের যে ব্যাখ্যা এখানে আহ্বান করছেন, সেটার যোগ সরাসরি মেরি শেলির প্রমিথিউসের সঙ্গে। কারণ মানবসভ্যতাকে পারমাণবিক বোমা উপহার দেওয়া আর যাই হোক, বিজ্ঞানের নির্ভেজাল বদান্যতা হিসাবে দেখা যায় না। বরং বহু প্রশ্ন লেগে থাকে এই উদ্ভাবনের গায়ে।
এর মধ্যে তিনটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, নোলান যার সব ক’টিকেই ছুঁয়ে গেছেন। প্রথম, ১৯৩০-এর দশক জুড়ে এনরিকো ফার্মি, নিলস বোর ও অন্য বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে নিউক্লিয়ার ফিশন ঘটানো হচ্ছিল ইউরোপের একাধিক ল্যাবরেটরিতে। ওখান থেকে স্বাভাবিক অগ্রগতির পথই পারমাণবিক বিস্ফোরণ। কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণের উদ্ভাবন আর পারমাণবিক বোমা এক জিনিস নয়। অর্থাৎ, যুদ্ধ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করল, না বিজ্ঞান যুদ্ধকে— এই প্রশ্ন থেকেই যায়। দুই, আমেরিকা এই বোমা তৈরির বিপুল রসদ জোগাতে রাজি হয় এই ভয়ে যে, জার্মানিতে নাৎসিরা বোমা তৈরিতে সচেষ্ট, এ রকম একটি পাকা খবর তখন ছিল, কারণ জার্মান বিজ্ঞানীরাই ছিলেন নিউক্লিয়ার ফিশনের পথিকৃৎ। অর্থাৎ এ রকম হতেই পারত যে, আমেরিকা নয়, এই বোমা নাৎসিরা তৈরি করতে সক্ষম হত, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবধারিত পরাজয় জেনে মরিয়া, প্রায়-উন্মাদ হিটলার এর ব্যবহারে উদ্যোগী হতেন। তখন?
তিন, নাৎসিরা যে এটা পারেনি তার অন্যতম কারণ, পারমাণবিক বোমার চেয়েও বিস্ফোরক ছিল তাদের ইহুদিবিদ্বেষ, আর ইহুদি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সের খেলায় জেতা ছিল অসম্ভব। কিছুটা এই কারণেও বাম মনোভাবাপন্ন হলেও ইহুদি বিজ্ঞানীদেরই আমেরিকা বেছে বেছে নিয়ে আসে বোমার গবেষণাগারে। স্বয়ং ওপেনহাইমারও এর বাইরে নন। আবার সেই ওপেনহাইমারকেই আমেরিকা ঘাড় ধরে স্বীকার করিয়েছে যে, আমেরিকা ব্যতীত আর কোনও আবেগ তাঁর নেই। অর্থাৎ বিজ্ঞান, আদর্শ, ভূ-রাজনীতি, ধর্ম, দেশপ্রেম, আইন, হলোকস্ট ও যুদ্ধের জটিল সংমিশ্রণে পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ও তার পরবর্তী অধ্যায়। নোলানের ছবি এটা খুব জোরালো ভাবে ধরতে পেরেছে। কিন্তু এই ছবি তার চেয়েও বেশি যেটা পেরেছে তা হল, ওপেনহাইমারের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের নৈতিক অচলাবস্থাকে একেবারে ছুঁয়ে দেখার দূরত্বে নিয়ে আসতে।
বিজ্ঞান তার নিজস্ব রীতিতে একের পর এক বাঁধ ভেঙে এগিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী। সভ্যতার অক্ষ দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের এই চরৈবেতিতে। তা হলে কি অলঙ্ঘনীয় বলে বিজ্ঞানের কিছু নেই? কে সেটা ঠিক করবে? রাষ্ট্র? ধর্ম? সমাজ? না কি বিজ্ঞান নিজের মধ্যেই একটি ‘মরাল আদার’— একটি ‘নৈতিক অপর’— তৈরি করবে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। নিউক্লিয়ার ফিশন থেকে পারমাণবিক বোমা, এই যাত্রাপথ বিজ্ঞানের নিরিখে স্বাভাবিক, ঠিক যেমন স্বাভাবিক ডারউইন থেকে জিন-এডিটিং প্রযুক্তি ক্রিসপর-এ উত্তরণ। আমরা পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, পারি বলেই কি আমরা ব্যবহারে উদ্যোগী হব?
মানুষকে আগুন জোগানোর কারবারি বিজ্ঞানকে আরও এক বার এই প্রশ্নের সম্মুখীন করল নোলানের ছবি। আর রেখে গেল এক অমোঘ প্রশ্ন— ফিশন থেকে বোমার দূরত্ব কি ঠিক ততটাই, যতটা প্রমিথিউস থেকে ডাক্তার ফস্টাসের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy