ভরসা: গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় সমর্থকরা। ছবি: পিটিআই।
সাম্প্রতিক গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল গত নির্বাচনগুলির তুলনায় বিজেপিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। ২৭ বছর ধরে গুজরাতের ক্ষমতায় থাকা বিজেপি এই নির্বাচনে ১৮২টি আসনের মধ্যে ১৫৬টিতে জয় লাভ করেছে, ভোট পেয়েছে ৫৩%। গত বারের তুলনায় ৬৫টি বেশি আসনে, এবং ২০০২ সালে গোধরা-পরবর্তী নির্বাচনের চেয়ে ২৯টি বেশি আসনে জয়ী হওয়া অবশ্যই বড় কৃতিত্ব। লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক দাপটের এর চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন আর হয় না।
যদিও নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন ভোট-সমীক্ষা বিজেপির জয় অনুমান করেছিল, তবে এই জয়ের পথ সুগম ছিল না। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি বা সরকার বিরোধী হাওয়া, যেটিকে সামাল দিতে নির্বাচনের এক বছর আগে বিজেপি বিজয় রূপাণীকে সরিয়ে ভূপেন্দ্র পটেলকে মুখ্যমন্ত্রী করে। এ ছাড়া অতিমারির সময় সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, করোনায় মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, সরকারি চাকরির অভাব, সর্বোপরি কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পাওয়ার ক্ষোভ সরকার বিরোধী আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিল। এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল অতিমারির সময়ের আর্থিক সঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধি ও জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তফসিলি জনজাতির ক্ষোভ। নির্বাচনের ঠিক আগে মোরবী সেতু ভেঙে দেড়শো মানুষের মৃত্যু প্রশাসনিক গাফিলতির দিকে আঙুল তুলে সরকার বিরোধী হাওয়া চরম আকার ধারণ করতে পারত।
কিন্তু এই সাময়িক সমস্যা ছাড়াও, বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সরকারকে চাপে রেখেছিল। গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের সূচকের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। গুজরাতের জনসংখ্যা দেশের ৪.৯৯ শতাংশ, কিন্তু দেশের জিডিপির ৭.৬ শতাংশ আসে এই রাজ্য থেকে; দেশের মোট শিল্পোৎপাদনের ১৮.৪ শতাংশ, মোট রফতানির ২০ শতাংশেরও বেশি হয় গুজরাত থেকে। কিন্তু শিশুমৃত্যুর হারে রাজ্যটি ঝাড়খণ্ডের পিছনে; প্রাইমারি স্তরে স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্যের অন্যতম গুজরাত। এমন অবস্থা বজায় থাকলে গণতন্ত্রে কোনও সরকারের পক্ষেই দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন। বিজেপি সেই কাজটাই করে দেখিয়েছে। প্রশ্ন হল, কী ভাবে?
জয়ের পর বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের প্রতিক্রিয়া থেকে অনুমান করা চলে যে, তাঁরা এই ফলাফলকে এক দিকে দলের সাংগঠনিক শক্তির জয় হিসাবে দেখছেন, অন্য দিকে আমদাবাদ মেট্রো, ভুজ ক্যানাল প্রজেক্ট, সুরাতের স্মার্ট সিটি প্রজেক্টের মতো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতি মানুষের সমর্থনের প্রকাশ বলে দাবি করছেন, এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি মানুষের আস্থা হিসাবে গণ্য করছেন। তিনটি কারণই আংশিক ভাবে সত্য। যে ভাবে অনেক পুরনো বিধায়ককে টিকিট না দিয়ে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ভেঙেছে বিজেপি, পাটীদার জাতি-রাজনীতির লাগাম ধরতে পেরেছে, এবং যে ভাবে মানুষ নরেন্দ্র মোদীর প্রতি নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেছে, তার কোনওটিই অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু, কারণগুলি তো ২০১৭-তেও ছিল— সে বছর বিজেপির ফলাফল কেন এত ভাল হয়নি?
বিজেপির এই বিপুল জয়ের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল বিরোধীদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি। আপ জয় লাভ করেছে মাত্র পাঁচটি আসনে, জমানত বাজেয়াপ্ত হল ১২৬টি আসনে— কিন্তু তারা যে ১৩ শতাংশ ভোট পেল, তা এল মূলত সৌরাষ্ট্র ও দক্ষিণ গুজরাতে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি থেকেই। তবে, কংগ্রেসের ভরাডুবির একমাত্র কারণ আপ নয়। প্রচারপর্বেও কংগ্রেসের সক্রিয়তার ঘাটতি লক্ষ করা গিয়েছিল। ওবিসি, জনজাতি, দলিত ও মুসলমানদের সংগঠিত করার যে নীতি কংগ্রেস নিয়েছিল, দলের শক্ত গড় সৌরাষ্ট্রে বা রাজ্যের জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতেও তার যথেষ্ট প্রভাব পড়েনি। তবে কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতা ভোটের অনেক আগেই প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল— ২০১৭ সালে নির্বাচিত কংগ্রেসের ৭৭জন বিধায়কের মধ্যে হার্দিক পটেল, অল্পেশ ঠাকোর-সহ ২১ জন বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, যা নির্বাচনের আগে জনমানসে কংগ্রেস সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভোট ভাগ হলেও এটা মানতেই হবে যে, বিজেপি নিজের ক্ষমতায় জয় লাভ করেছে। এই নির্বাচনে মাত্র ৬২টি আসনে কংগ্রেস এবং আপ-এর সম্মিলিত ভোট বিজেপির চেয়ে বেশি ছিল।
রাজনীতির এই প্রত্যক্ষ প্রেক্ষাপটের অন্তরালে কিছু কারণ আছে, যা বিজেপির জয়কে সুনিশ্চিত করেছে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই গুজরাতের রাজনীতি জাতি, শ্রেণি ও ধর্মের সংমিশ্রণের একটি নির্দিষ্ট গতিপথ অবলম্বন করে। আশির দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা অতিক্রম করে এই রাজ্যে ধীরে ধীরে কংগ্রেস ও বিজেপির দ্বান্দ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কংগ্রেসের সমর্থনের মূল ভিত্তি ছিল ক্ষত্রিয়, হরিজন, জনজাতি ও মুসলমান জনগোষ্ঠী, এক সঙ্গে যাকে বলা হত খাম। তবে, রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে মূল দাপট ছিল পাটীদার, পটেল ও বানিয়াদের নিয়ে তৈরি স্থানীয় বুর্জোয়া শ্রেণির। ফলে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, গুজরাতের উন্নয়ননীতি সব সময়ই ব্যবসায়িক স্বার্থের অনুকূল থেকেছে। রাজ্যে প্রগতিশীল রাজনীতির উজ্জ্বল অতীত থাকা সত্ত্বেও, আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তা কোণঠাসা হয়ে যায়। আশির দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির আবির্ভাবের পর গুজরাতেই প্রথম সে দলের ভোট শতাংশ দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছয়। দশকের শেষ দিকে সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে স্থানীয় বুর্জোয়া-সমর্থন পাকা হয় বিজেপির প্রতি, যার সুফল তারা এখনও পাচ্ছে।
১৯৯৫ সালের পর থেকে সব নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি ৪৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, এবং ২০০২ সালের পরে বিজেপি হিন্দু ভোট ধরে রাখতে পেরেছে। ২০২২ সালের এই নির্বাচনে কংগ্রেসের খাম-ফর্মুলার কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হল, কারণ তফসিলি জাতি ও জনজাতির মধ্যেও বিজেপি বৃহত্তর জাতি-সমীকরণ তৈরি করতে সফল। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, বিজেপি স্থানীয় বুর্জোয়া এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সামাজিক সংযোগ স্থাপনে সফল। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস এবং গুজরাত ইলেকশন ওয়াচ-এর তথ্য অনুসারে, ১৮২ জনের মধ্যে ১৫১ জন বিধায়কই কোটিপতি— তাঁদের মধ্যে ১৩২ জন বিজেপির, ১৪ জন কংগ্রেসের, ৩ জন নির্দল, এবং আপ ও সমাজবাদী পার্টির এক জন করে। ২০১৭ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৪১। জয়ী প্রার্থীদের গড় সম্পদ ১৬.৪১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে গুজরাতে মাথাপিছু আয় ছিল আড়াই লক্ষ টাকারও কম। স্পষ্টতই, রাজ্যের নতুন রাজনীতিতে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষরা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের পরিসর থেকে উধাও।
এই নির্বাচন সমকালীন রাজনীতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে, রাজনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় ন্যারেটিভ ও তার ব্যাখ্যান। রাজনীতি যত বেশি পপুলিজ়ম বা জনবাদ ও পরিচিতির দিকে ঝুঁকছে, এই দিকটির গুরুত্বও তত বাড়ছে। বিশ্লেষক নীলাঞ্জন সরকারের মতে, নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতিকে ‘বিশ্বাসের রাজনীতি’ বলা যেতে পারে, যেখানে অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ের দায়বদ্ধতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছ রাজনৈতিক বয়ান। এক দিকে, তথ্যের অপ্রতুলতা বা তথ্য সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা, আর অন্য দিকে রাজনীতিতে ব্যক্তিবাদের বাড়বাড়ন্ত, এই দুইয়ের মিশেলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। গুজরাতে বিজেপি নিখুঁত ভাবে রাজনীতির এই বয়ানটি নির্মাণ করে চলেছে। সতীশ ঝা লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে গুজরাত টাইটানের আইপিএল জয়, অথবা অমিত শাহের শিলান্যাস করা ৬০০ কোটি টাকা বাজেটের স্পোর্টস কমপ্লেক্স— এই সবই সেই রাজনৈতিক বয়ানের অঙ্গ, যা শেষ অবধি বিজেপিকে এমন বিপুল জয় এনে দিল। আমদাবাদের একটি ক্রিকেট টিমকে গুজরাতি অস্মিতার সঙ্গে এক সূত্রে গেঁথে ফেলতে পারা আসলে সাফল্যের বয়ান নির্মাণেরই অঙ্গ। এ বারে গুজরাতে বিজেপির স্লোগান ছিল ‘বিজেপি এটলে ভরোসো’— ‘বিজেপি মানেই ভরসা’। মানুষ এই স্লোগানটিতে বিশ্বাস করেছেন, তাঁরা মোদীকে দেখেছেন এক শুভাকাঙ্ক্ষী অভিভাবক হিসাবে, যিনি রাজ্যের মানুষের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখবেন ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবেন। সেখানে মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি, অভাব, অতিমারি গুরুত্বহীন।
আপও এ রকমই একটা বয়ান তৈরি করেছিল— তারা নিজেদের কৃষ্ণভক্ত ও বানিয়া সম্প্রদায়ের ‘আসল প্রতিনিধি’ হিসাবে দেখিয়েছে। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের প্রচারে এই কথাগুলি উচ্চারিত হয়েছে খুব সক্রিয় ভাবে। এই রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের বার্তা। জনবাদী রাজনীতির যে কোনও বয়ানই আসলে তৈরি হয় সমাজকে আমরা-ওরা’র দ্বন্দ্বে ভেঙে, ‘আমাদের’ সঙ্গে ‘ওদের’ পার্থক্যগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এবং ‘ওদের’ অবৈধ হিসাবে চিহ্নিত করে। ফলে, এই রাজনীতি যত সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে প্রসারিত হবে, ভারতে সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তত বেশি দুশ্চিন্তা বাড়বে বই কমবে না ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy