—প্রতীকী ছবি।
একটা কথা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যু এবং র্যাগিংয়ের অভিযোগকে ঘিরে যে গণআলোড়ন তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। কিন্তু সেই আলোড়ন নিজেই যদি র্যাগিংয়ে পর্যবসিত হয়, তবে তার চেয়ে দুঃখের এবং উদ্বেগের আর কিছু নেই। মুক্ত চিন্তার পরিসর হিসাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিচিতি, সেই পরিসরে এমন একটি ঘটনা কী ভাবে ঘটে গেল, এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে। কিন্তু তাই বলে ‘মুক্ত চিন্তা’ শব্দবন্ধটিই যদি আক্রমণের চাঁদমারি হয়ে ওঠে, তা হলে ভাবনার কথা বইকি। র্যাগিংয়ের সংস্কৃতি মুক্ত চিন্তার খামতি থেকে আসে। তার একমাত্র প্রতিষেধক আরও বেশি মুক্ত চিন্তা। মুক্ত চিন্তা আর র্যাগিং পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, এ কথা মনে রাখার দায়িত্ব ছাত্রসমাজের (শুধু যাদবপুর নয়, সামগ্রিক ছাত্রসমাজ) যতটা, বৃহত্তর জনসমাজেরও ততটাই।
খেদের বিষয় এই যে, যাদবপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনসমাজে যে তোলপাড়, তার মধ্যে অনেকখানি গোঁড়ামি আর রক্ষণশীলতার উদ্গার দৃশ্যমান। সেটা একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও অনভিপ্রেত বটেই। অপ্রত্যাশিত পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না, কারণ আমাদের মতো দেশে যে কোনও এলিট প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই সমাজমনে দু’টি বিপরীত চিন্তাস্রোত কাজ করে। তার একটি যদি হয় আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-সম্ভ্রমের দিক, অন্যটি এক ধরনের নাক-সিটকানো, মাত্রান্তরে চিড়বিড়ে রাগ। এলিট-এর সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের ব্যবধান এবং বিচ্ছিন্নতা থেকেই এর জন্ম। এক ধরনের ‘স্টেটাস সিম্বল’ করায়ত্ত হওয়া এবং না-হওয়ার বোধ সেখানে কাজ করতে থাকে উভয়তই। সেটা কোনও পক্ষেরই গৌরবের কথা নয়। অহংদীপ্ত গজদন্তমিনারে পরিণত হওয়া যেমন কোনও উৎকর্ষকেন্দ্রের লক্ষ্য হতে পারে না, তেমনই তথাকথিত মুক্তচিন্তা আর সামাজিক রক্ষণশীলতার বিরোধ যদি ক্রমশ কমে না আসে, সেটা দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থারই ব্যর্থতা বলে গণ্য করতে হবে। যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে এই সব রকম মনোভঙ্গিই এক সঙ্গে সরব হয়ে উঠেছে। এলিটকে আক্রমণ করে গায়ের ঝাল মেটানোর চেষ্টা যেমন চলছে, রয়েছে যন্ত্রণাদীর্ণ বিস্ময়— সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের জন্য গলাফাটানো প্রতিষ্ঠানে এমন হয় কী করে? এই মুহূর্তের গণছিছিক্কারে যাদবপুরকে ঘিরে প্রত্যাশা আর বিরাগের দুই স্বরই তাই মিলেমিশে গিয়েছে। রাজনীতির কারবারিরা তারই সুযোগ নিচ্ছেন পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু এর পরিণামে মুক্ত চিন্তার অঙ্গন সঙ্কুচিত হলে আখেরে ক্ষতি বাড়বে বই কমবে না।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিসে এলিট হয়? একটি তার ফলিত দিক— অর্থাৎ ভাল র্যাঙ্কিং, ভাল পরিকাঠামো, পরীক্ষায় সাফল্য ইত্যাদি। অন্যটি তার চারিত্রিক দিক— অনন্যসাধারণ শিক্ষক, মেধাবী পড়ুয়া, মননের উৎকর্ষ। প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, সঙ্কটকালেই অন্তরের শক্তি আর দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত হয়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক এই ঘটনায় অন্তত, দু’দিক থেকেই যাদবপুরের দুর্বলতা অতি প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং পরিকাঠামো যে এমন একটি ঘটনা রুখতে পারেনি, সে দায় তাকে নিতেই হবে। পাশাপাশি, ‘চান্স পেয়ে দেখা’-গোত্রীয় বালখিল্য লম্ফঝম্প আর কিছু না হোক, এটা সকলের সামনে প্রতিভাত করে দিয়েছে যে, সেখানকার পড়ুয়াদের একটি অংশ অত্যন্ত দুর্বিনীত এবং উদ্ধত। ধরাকে সরা দেখা সবজান্তা দেমাকই তাদের অভিজ্ঞান। মুক্ত চিন্তার চর্চায় এও এক বিরাট খামতি। প্রতিষ্ঠানের কৌলীন্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই দুর্লক্ষণটি যে ক্রমবর্ধমান, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষককুলের ওয়াকিবহাল থাকারই কথা। হোক কলরবের মতো বহুচর্চিত আন্দোলনে উপাচার্যের পুলিশ ডাকা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। খুব সঙ্গত ভাবেই উঠেছিল। ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার মতো আচরণ শিক্ষকধর্মের পরিপন্থী, এ কথায় কোনও ভুল নেই। কিন্তু কোন ছাত্রধর্মে ভিসি-র ‘চামড়া গুটিয়ে নেব’ বলে স্লোগান তোলা যায়, সে প্রশ্নটাও কিঞ্চিৎ আলোচিত হওয়া দরকার ছিল না কি? কাদের প্রশ্রয়ে ছাত্র-আন্দোলনের কণ্ঠ এমন কদর্য হয়, তার হদিস করা দরকার ছিল না কি? মুক্ত চিন্তার পথে ক্ষুদ্রস্বার্থও যে একটা বড় অন্তরায়, এই গোড়ার কথাটা যাদবপুরের তথাকথিত ‘স্টেকহোল্ডার’রা কেউই সম্ভবত মনে রাখেননি।
তারই খেসারত আজ তাঁদের সকলকেই দিতে হচ্ছে। ছাত্রাবাসে দাদাগিরির ঘুঘুর বাসাই হোক বা পড়ুয়াদের বেলাগাম প্রতিক্রিয়া, দলবাজি আর ইউনিয়নবাজির কায়েমি স্বার্থ কিন্তু তার প্রতি পদে জড়িয়ে। ছাত্র ইউনিয়ন, শিক্ষক ইউনিয়ন, কর্মচারী ইউনিয়নের দখলদারির হিসাবনিকাশ নিজ নিজ পার্টি-গণিতে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত। শৌভিক ভট্টাচার্যের মতো উপাচার্যের চলে যাওয়ার জন্য শুধু ছাত্রেরা দায়ী ছিল না। হস্টেলে ছড়ি ঘোরানোর মৌরসি পাট্টাও তাদের একার ক্ষমতায় টিকে থাকেনি। এমনকি আজও এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও কিন্তু দলগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার দৃষ্টান্ত যাদবপুর এখনও অবধি তৈরি করে উঠতে পারেনি। তুই-মুই কোন্দলকে নিরস্ত করে শোনা যায়নি ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারের স্বর। মুক্ত চিন্তার অন্যতম প্রধান শর্ত যে দায়িত্বজ্ঞান, তার অভাবটাই বরং বড় বেশি বেআব্রু।
ফল কী দাঁড়াল? জনসমাজের চোখে ভিলেন এখন ‘মুক্ত চিন্তা’ই। রাজনৈতিক মহলও তাতে যারপরনাই খুশি। একটা বেয়াড়া ঘোড়াকে বশে আনার এমন সুবর্ণসুযোগ আলটপকা হাতে এসে পড়বে, সেটা তাঁরা ভাবতেই পারেননি। জনসমাজ এমনিতেই কড়া অভিভাবক পছন্দ করে। বলদর্পী নেতা, বাণীবর্ষী গুরু, ডাকাবুকো নায়ক, মারকুটে পুলিশ, উচ্চনাদী সাংবাদিক দেখলে ভক্তিতে তার মাথা নত হয়ে আসে। মুক্ত চিন্তার অভ্যাসটি পরিশ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ। সমস্যাসঙ্কুল দৈনন্দিনতায় মস্তিষ্কে অত বার কে সাধ করে বইতে যাবে? তলিয়ে ভাবা, খুঁটিয়ে দেখা, প্রশ্ন তোলা সচরাচর মানুষের স্বভাবে নেই বলে সে নিজের দিকে তাকাতেও ভুলে যায়। ভুলে যায়, যারা র্যাগিংয়ের শিকার এবং যারা র্যাগিংয়ের ধারক-বাহক, তারা সকলেই এ সমাজেরই সন্তান। আজ যে উৎপীড়িত, কাল সে নিজে উৎপীড়ক— এই ট্র্যাডিশন বহতা থাকতে পেরেছে যে সমাজে, আমরা প্রত্যেকে সেই সমাজের সদস্য। এ পাপ কারও একার নয়।
জনসমাজ ভেবে দেখে না, পরিবার থেকে পাড়া, সংগঠন থেকে কর্মক্ষেত্র— কোথায় নেই র্যাগিং? কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো গায়ককে সংস্কৃতিমান বঙ্গসমাজ অবলীলায় ‘কানা কেষ্ট’ বলে ডেকেছে। বিদ্যাসাগরকে তাঁর সতীর্থেরা যে ‘যশুরে কৈ’ বলে টিটকিরি দিত, আজকের লব্জে সেটা বডিশেমিং। অরক্ষণীয়া-র জ্ঞানদা থেকে আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ-এর সুটু— পরিবার কবেই বা র্যাগিং থেকে মুক্ত! কমনীয় পুরুষকে ‘ঋতুপর্ণ’ বলে রগড় করার অভ্যাস রপ্ত নেই ক’জনের? র্যাগিং তো শুধু যাদবপুরের রোগ নয়। র্যাগিং শুধু ছাত্রসমাজেরও রোগ নয়। যদি এ রোগের মূলোৎপাটন করতে হয়, তবে সমাজের সর্ব স্তরেই তা করতে হবে। তার জন্য মুক্ত চিন্তা ও চেতনার অধিকতর প্রসার ছাড়া দ্বিতীয় ওষুধ আছে কি? উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারা তাসের দেশ-মার্কা হলেই ভাল কি না, এ কথা ভেবে দেখার সনির্বন্ধ অনুরোধ জনসমাজের কাছেও তাই থাকছে।
র্যাগিংয়ের সারমর্মটি কী? ক্ষমতার প্রদর্শন বই তো নয়। দাবড়ানি-রগড়ানি-কড়কানির দাওয়াই যদি সমাজের এত প্রিয় হয়, সে সমাজ কী ভাবে র্যাগিং রোধ করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy