Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ramayana

দশশির আর রাম হায়দার

ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে মহাকাব্য রামায়ণের যোগ বহুচর্চিত। ভিন্ন দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতাত্মাকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য শ্রীরামচন্দ্র যুগ যুগে সেতুবন্ধ।

ramayana

—ফাইল চিত্র।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৪
Share: Save:

রামায়ণের মহানায়ক শ্রীরামচন্দ্রের আর এক নাম যদি বলি ‘রাম হায়দার’, অবিশ্বাস্য মনে হবে? ইয়েমেনে প্রচলিত রামায়ণ কাহিনির শরণাপন্ন হলে সেই ধোঁয়াশা কেটে যাবে। সে জন্য অবশ্যপাঠ্য ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে আরব ভূখণ্ডে লেখা বই তারিখ আল মুস্তাবসির, লেখক ইবন আল মুজাহির। তিনি মক্কা থেকে লোহিত সাগরের তীর ধরে ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূল-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন, সংগ্রহ করেছেন তথ্য, লোককথা। ইয়েমেনের সে-কালের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মহম্মদ বিন মাসুদের পিতা মুবারক ইল শারোনি মৌলা এই পর্যটক-ইতিহাসবিদকে ‘রাম হায়দার’-এর কাহিনি শুনিয়েছিলেন। প্রাচীন কালে ইয়েমেনের এডেন ছিল যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের নির্বাসনস্থল। দানবরাজ দশশির এখানে বন্দিদের নির্বাসন দিতেন। এডেনে অসংখ্য পাহাড়, কোন‌ও একটির মুখে আছে কূপ— তার ভিতর দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের উপযুক্ত এক সুড়ঙ্গপথ। দশশির দানব অযোধ্যা থেকে রাম হায়দারের স্ত্রীকে খাট সমেত চুরি করে আকাশপথে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। জোবেলসিরা পাহাড়ের মাথায় বিশ্রামের সময় দানবরাজ দশশির রাম হায়দারের স্ত্রীকে বলেন: “আমি তোমার মানুষের শরীরটাকে একটা জ্বীনে বদল করব, তাই তোমাকে চুরি করেছি।”

‘সীতা’হরণের সংবাদ পেলেন হনবীত। তিনি বানররূপী এক ইফরীত। এক রাত্রির কঠিন পরিশ্রমে উজ্জ‌য়িন-বিক্রম নগর থেকে সমুদ্রের তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে জোবেলসিরার কেন্দ্রে এসে পৌঁছলেন তিনি। কূপের মুখ দিয়ে প্রস্থান করে দেখতে পেলেন, পাহাড়ের মাথায় একটা কাঁটাগাছের নীচে রাম হায়দারের স্ত্রী ঘুমিয়ে আছেন। “সে তৎক্ষণাৎ তাহাকে পিঠে তুলিয়া সেই সুড়ঙ্গ-পথে ভোরবেলা উজ্জ‌ইন বিক্রমেতে আসিয়া পৌঁছিল এবং তাহাকে তাহার স্বামী রাম হায়দারের হাতে সমর্পণ করিল। রাম হায়দারের দুইটি সন্তান হ‌ইল লথ (Luth) ও কুশ।” লিখেছেন উনিশ শতকের বাংলা কথাসাহিত্যে প্রখ্যাত উদ্ভট রসের স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁর আ ভিজ়িট টু ইউরোপ গ্রন্থে। ১৮৮৬-র এই ভ্রমণবৃত্তান্তে দেখা যায় তিনি এডেন পৌঁছে এই রামায়ণ-কাহিনি শুনে অবাক, সেই সঙ্গে তা লিখে নিতেও ভুল করেননি। ইংরেজিতে লেখা এই ব‌ইয়ের অনুবাদক পরিমল গোস্বামী। কাহিনিতে বর্ণিত সুড়ঙ্গের প্রসঙ্গে ত্রৈলোক‍্যনাথ বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি: “প্রাচীন হিন্দুদের বিস্ময়কর সব ক্রিয়াকলাপ বা কীর্তি আবিষ্কারের জন‍্য আমার দেশের যাঁহারা কল্পনার বিস্তারে আনন্দলাভ করিয়া থাকেন, তাঁহারা ইহা শুনিয়া খুশি হইবেন নিশ্চিত।” দেড়শো বছর প্রায় কেটে গেল, ত্রৈলোক্য-কথিত কল্পনার বিস্তার এখন প্লাস্টিক সার্জারিতে উন্নীত হয়েছে, গণেশের উদাহরণে আনন্দ আহরণ করছেন রাষ্ট্রের প্রধান!

আরবি লোক-রামায়ণে লক্ষণীয় ‘দশশির’ নামটি। ‘হনবীত’ যে হনুমান, ‘লথ’ ও ‘কুশ’ যে সীতার দুই সন্তান লব-কুশ তা বলে দিতে হবে না। শুধু সেই কাহিনির সময়-বাক্সে এক‌ই সঙ্গে বন্দি অযোধ্যা আর উজ্জয়িনী। প্রমাণ, আরবের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ব্যবসায়িক যোগ ছিল যা পরিণত হয়েছিল সাংস্কৃতিক যোগেও। ব্যবসার বৃত্ত ছাপিয়ে এক দেশের মহাকাব্য আত্মস্থ করছেন অন্য দেশের মানুষ, তথাকথিত ‘ধর্ম’ সেখানে প্রবেশাধিকার
পায় না।

কেরলে প্রচলিত মাপ্পিলা রামায়ণ-এ রাম উচ্চারণ করেছেন শরিয়ত আইনের কথা, প্রসঙ্গ লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখার প্রেমপ্রস্তাব। “প্রতিটি নারীর জীবনে এক জন‌ই পুরুষ থাকবে”— শরিয়তের কথা মনে করিয়ে দেন রামচন্দ্র। শূর্পণখার জবাবে মেলে আধুনিক উদারবাদী ভাবনার রেশ: “শরিয়ত পুরুষের জন্য একের বেশি নারীর কথা বলে থাকলে নারীর জন্য কেন একক পুরুষের বিধান দিয়েছে?” অন্য কোনও দেশে নয়, রামচন্দ্রের জন্মভূমি ভারতবর্ষেই গড়ে ওঠা এমন আশ্চর্য নিখাদ মুসলমানী রামায়ণে শূর্পণখা হলেন ‘বিবি শূর্পণখা’, তাঁর সখীর নাম ফতিমা! মাপ্পিলা জনগোষ্ঠী ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, তাঁদের ‘র’-এর উচ্চারণ শুনতে ‘ল’-এর মতো, তাই এই কাহিনির নায়ক ‘লামা’, খলনায়ক ‘সুলতান লাভন্’, গেয়-কাব্যটির শিরোনাম‌ও লামায়ণম্। চারণকবি পিরাণথান হাসানকাট্টু ‘মাপ্পিলা পাত্তু’-র গান শুনিয়ে বেড়াতেন। অজানা উৎস, লোকমুখে ঘুরে বেড়ানো এই রামকাহিনির শ’দেড়েক পঙ্‌ক্তি মুখস্থ ছিল কেরলের এক ব্রাহ্মণ কিশোরের— টি এইচ কুনহিরামন নাম্বিয়ার। পরে তিনিই কেরলে লোকসংস্কৃতি গবেষণায় বিশিষ্ট নাম, এই রামায়ণ সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। সাহিত্যিক এম এন কারাসেরি পুরোটা লিপিবদ্ধ করে কুরিমানম্ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন মাপ্পিলা রামায়ণ-কে।

ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে মহাকাব্য রামায়ণের যোগ বহুচর্চিত। ভিন্ন দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতাত্মাকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য শ্রীরামচন্দ্র যুগ যুগে সেতুবন্ধ। সেই বিষয়ে হাজারো আলোচনা, তবু নতুন বয়ানে কথা বলার সুযোগ নিজেই যেন তৈরি করে দেয় রামায়ণ। ইয়েমেনের রামায়ণ আর মাপ্পিলা জনগোষ্ঠীর রামায়ণ তার প্রমাণ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন: “আমি এশিয়ার... গ্রামগ্রামান্তে গিয়ে দেখেছি, নাচে-গানে-লোকবৃত্তে আমাদের এই ভূখণ্ড উৎসায়িত প্রথম আদি মহাকাব্য সব জায়গায় আমাদের ভুবনজোড়া আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞানপত্র— ভিসা— হয়ে আছে।” বোঝা যায় ঘরে বাইরে রামায়ণ-এর উদার অঙ্গনে সকলের নিজস্ব স্থান আছে, সেখানে সঙ্কীর্ণতার জায়গা নেই কোন‌ও।

অন্য বিষয়গুলি:

Ramayana Islam Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy