—প্রতীকী ছবি।
বিগত এক দশক ধরে মালয়েশিয়ার ঘরোয়া রাজনীতি উথালপাথাল এক দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। দেশের উন্নয়নকল্পে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী নজিব রজ়াক মূলত আরব দুনিয়ার থেকে ঋণ নিয়ে বহু বিলিয়ন ডলারের তহবিল তৈরি করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি ছিল, দেশ হবে একুশ শতকের সিঙ্গাপুর। তা অবশ্য হয়নি— সেই বিপুল টাকা নয়ছয় করেছেন রজ়াক ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা, মূলত বিলাসব্যসনে। এক দুর্নীতির ধাক্কাতেই দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে— হিসাব চলছে, ঠিক কত বছর পিছিয়ে গেল মালয়েশিয়া।
আমাদের অবশ্য দুর্নীতির খোঁজে অন্য দেশের দিকে তাকানোর প্রয়োজন হয় না। রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে এ দেশে দুর্নীতি ঘটেছে। মালয়েশিয়ার মতোই ভারতেও দুর্নীতির মূল্য চোকাতে হয়েছে উন্নয়নের অঙ্কে। শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্যের মতো প্রাথমিক চাহিদাগুলি পূরণ করার দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁদের অধিকাংশই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তখন অন্যদের মনে দুর্নীতিতে জড়িত থেকে ধরা পড়ার ভয় কমে যেতে থাকে— মনে হয়, “শিক্ষামন্ত্রী নিজেই যদি কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তা হলে চুনোপুঁটি আমি কয়েক হাজার টাকার ঘুষ নিলে কে-ই বা কী বলতে যাবেন?” এবং তথাকথিত ‘সিস্টেম’-এর অংশীদার হয়ে থাকলে তো কেউ বলতে ভরসাও পাবেন না।
যাঁরা দুর্নীতির স্রোতে গা ভাসাবেন না, তাঁদের ধীরে ধীরে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর থেকেই ভরসা চলে যেতে শুরু করবে। মানুষ ক্রমে ভরসা করতে শুরু করবেন চেনা সর্বাধিপত্যকামী শাসকদের— যাঁরা কঠোর হাতে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের পর নরেন্দ্র মোদী; ব্রাজ়িলে লুলা দা সিলভা এবং দিলমা রুসেফ-এর ছাড়া জায়গায় বোলসোনারো; হিলারি (এবং বিল) ক্লিন্টনের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কায় ট্রাম্প— অসীম দুর্নীতির পরেই স্বৈরাচার যেন এক ধ্রুব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক এবং প্রধান বিরোধী দল দু’টির নেতারা অবিরত জার্সিবদল করে চলেছেন বলে রক্ষে, না হলে যে পরিমাণ দুর্নীতির বোঝা আমাদের কাঁধে চেপেছে, তাতে যোগী আদিত্যনাথ গোত্রীয় কোনও নেতার বঙ্গীয় মসনদে বসে পড়ার সম্ভাবনাকে, অন্তত ইতিহাসের আলোয়, উড়িয়ে দেওয়া যেত না।
দুর্নীতির সবচেয়ে বড় শিকার দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষরা। সরকারের থেকে যে পরিষেবা তাঁদের নিখরচায় ও নিঃশর্তে পাওয়া উচিত, সেই প্রতিটি পরিষেবার জন্য তাঁদের মূল্য ধরে দিতে হয়। যাঁরা সে মূল্য দিতে পারছেন না, পরিষেবা পাওয়ার জন্য বহু সময়েই তাঁদের অসংখ্য কৃতজ্ঞতাপাশে বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। সে কৃতজ্ঞতাপাশকে দাসত্ব বললেও খুব ভুল হবে না। নিয়মমাফিক এবং অন্তহীন হিংসার সূত্রপাত এই শ্রেণিবৈষম্যের মধ্যেই। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ন্যায্য চাকরির চিঠি পেতেই লাখ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে, এ খবর আমরা কে-ই বা শুনিনি? এবং শুনছি বেশ কয়েকটি দশক ধরেই। আজ নাহয় অযোগ্য প্রার্থীরা টাকার বিনিময়ে সরাসরি চাকরি পেতে শুরু করেছেন, কিন্তু ন্যায্য চাকরি পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছে বহু আগেই। এ টাকা যাঁরা দিতে পারবেন না, তাঁদের করণীয় কী? স্থানীয় দাদার কাছে শুধু রাজনৈতিক নয়, সব রকমের বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া। উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে এ প্রথা শুরু হয়েছিল বহু আগে, এখন আমাদের রাজ্যেও তা চালু। সেই দাদা যদি গ্রামের বাকিদের জমি দখল করে নেন, আমরা টুঁ শব্দটি করব না। দাদার উপরে বোমাবাজি হলে আমরা রে-রে করে তেড়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারব সন্দেহভাজনদের— তারা আসলেই দোষী কি না, জানতেও চাইব না।
এই শ্রেণিবৈষম্যই মিলিয়েছে বৃহত্তম দুর্নীতি এবং তৃণমূল স্তরের দুর্নীতিকে। প্রান্তিক শ্রেণির যতটা শোষণ হয় এই দুর্নীতির জন্য, ততটা অন্য কোনও আর্থসামাজিক শ্রেণির মানুষের হয় না। মালয়েশিয়ার মানুষদের চরম হতাশা ওই কারণেই— শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নগরায়ণভিত্তিক যে স্বপ্ন তাঁদের দেখানো হয়েছিল, তা চুরমার হয়ে গিয়েছে, এবং তাঁরা বুঝছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে শ্রেণি-উত্তরণের সুযোগ তাঁদের নেই। উন্নয়নখাতের টাকা নয়ছয় হলে সবচেয়ে ক্ষতি হয় প্রান্তিক শ্রেণির মানুষেরই, কারণ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের উপরে তাঁদের নির্ভরতাই সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গের থানায়, আদালতে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথীর মতো প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য অভিযোগের বন্যা বইছে। দুর্নীতির মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত না করে বা সেগুলিকে উৎখাতের সামান্যতম চেষ্টা না করে সরকার যতই সমাজবন্ধু সাজার পরিকল্পনা করুক, আখেরে বিশেষ লাভ হবে না।
আইন ও বিচারব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, যুগোপযোগী প্রযুক্তির উপরে নির্ভরতা বাড়ানো, সাংবাদিকদের বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা, একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির মোকাবিলায় কাজে লাগানো— ওষুধ কম নেই। কিন্তু এই প্রতিটি কাজেই জনসাধারণকে রাষ্ট্রশক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তার ফলে, দুর্নীতির আখ্যান হয়ে উঠছে চিরকালীন। দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা নিতান্ত তত্ত্ব হয়েই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু মালয়েশিয়া দেখাচ্ছে যে, জনসাধারণকে রাষ্ট্রশক্তি পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারে না। মালয়েশিয়ার মানুষের হতাশা প্রতিফলিত হচ্ছে সে দেশের উৎপাদন ক্ষমতায়, শেষ কয়েক বছরে ‘ওয়ার্ল্ড কম্পিটিটিভনেস র্যাঙ্কিং’-এ মালয়েশিয়ার স্থান ক্রমেই পড়েছে। এক বিকৃত পথে হলেও রাষ্ট্রশক্তি তার অক্ষমতার জন্য শাস্তি পাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এক হিসাবে মালয়েশিয়ার মতোই। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রাজ্যটিকে হতাশায় ঘিরে ধরেছে, মানুষ ক্রমেই বুঝতে পারছেন যে, এর থেকে পরিত্রাণের পথ বিশেষ নেই। যিনি যে দলেই থাকুন না কেন, দিনের শেষে সবাই এক সঙ্গেই ডুবছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy