E-Paper

মণিপুর সঙ্কট, কিছু সংশয়

বেশ কিছুটা দেরিতে হলেও মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ কড়া ভাষায় মণিপুরে চলতে থাকা নৈরাজ্যের সমালোচনা করে বলে, সেখানে আইনশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই।

An image of Manipur Violence

মণিপুর রাজ্যে চলা নারী-নির্যাতন ও অশান্ত পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কঠোর পদক্ষেপ করল সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।

আনন্দ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫০
Share
Save

সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলাদের নগ্ন করে হাঁটানোর দৃশ্য দেশবাসীর সামনে আসার পরই মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট মণিপুর রাজ্যে চলা নারী-নির্যাতন ও অশান্ত পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কঠোর পদক্ষেপ করল। বেশ কিছুটা দেরিতে হলেও মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ কড়া ভাষায় মণিপুরে চলতে থাকা নৈরাজ্যের সমালোচনা করে বলে, সেখানে আইনশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই বীভৎসতা দেখে উদ্বিগ্ন আদালত প্রশ্ন তুলেছে, এ কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না এটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে? বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ও মানবাধিকার তথা নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকারীরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে কেন্দ্রের যথাযথ পদক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। শুধু তা-ই নয়, মণিপুর রাজ্যের হিংসাত্মক পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সে জন্য গত ৬ মে জনৈক নাগরিক সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা রুজু করে আদালতের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন।

অনুমান করতে ইচ্ছে করে, সে দিন সুপ্রিম কোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তকারী কমিটি গঠন করে যদি মণিপুরের মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তের নির্দেশ আসত, তার পরও পরিস্থিতি এতটা খারাপ হত কি না। আবেদনকারী আর্জি জানিয়েছিলেন, মণিপুরে জাতিগত হিংসার ফলে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়ে পড়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে রাজ্য সরকার যেখানে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে, সেখানে ভারতীয় সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুক সর্বোচ্চ আদালত। দাঙ্গার আবহে যখন সে রাজ্যের সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হচ্ছে, শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে চলেছে, সেই পরিস্থিতিতে আদালতের কঠোর হস্তক্ষেপ ভীষণ ভাবে জরুরি হয়ে পড়েছিল।

সে সময় আদালতে সলিসিটর জেনারেল বিচারপতিদের এ কথা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে ফিরছে। সে ক্ষেত্রে মামলাকারীর ঘাড়েই বন্দুক চাপিয়ে সলিসিটর জেনারেল মন্তব্য করেন, মামলাকারীর আরও অনেক বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া উচিত ছিল, কারণ যে কোনও ধরনের ভুল তথ্য সে রাজ্যের পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলতে পারে। প্রসঙ্গত, মামলাকারীর পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেসের উদ্দেশে আদালতের মন্তব্যটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং হতাশাজনক। আদালতের বক্তব্য ছিল, সংশয়বাদের উপর নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব হাতে তুলে নেওয়া যায় না। এই মামলাটিকে কেন্দ্র করে সে রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি আরও হিংসাত্মক হয়ে উঠুক ও অন্য সমস্যাগুলি আরও বাড়তে থাকুক, এটা বাঞ্ছনীয় নয়।

যদি আগেই কোনও তদন্ত কমিটি তৈরির নির্দেশ পাওয়া যেত, তা হলে জনস্বার্থ মামলারূপে রুজু করা রিট আবেদনটিতে মামলাকারীর উদ্দেশ্যটাও হয়তো আদালতের সামনে স্পষ্ট হয়ে যেত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয় সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টে বা ২২৬নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক দেশের হাই কোর্টগুলিতে কোনও নাগরিক যখন মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তা রক্ষা করতে আদালতের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন, তখন আদালত কি নিছকই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসন, আইনসভা, পুলিশ, সরকার সকলেই নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকারের মতো মৌলিক ও নাগরিক অধিকারগুলি রক্ষা করতে অসমর্থ হলে আদালতকেই তো সেই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে হবে।

প্রসঙ্গত, বি আর আম্বেডকর নিজেই ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আমার মত জানতে চাইলে আমি ৩২নং অনুচ্ছেদটি ছাড়া অন্য কোনও অনুচ্ছেদের নাম করতে পারব না। এটা এক দিকে সংবিধানের আত্মা ও অপর দিকে হৃদয়ও বটে।

খোদ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টও শীলা বরসে বনাম ভারত রাষ্ট্র (১৯৮৮) মামলায় বলেছে, জনস্বার্থ বিষয়ে পদক্ষেপ করার সময় বিচারবিভাগীয় বাধ্যবাধকতা হল সংবিধানে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে যাতে সমতাযুক্ত সমাজব্যবস্থা ও মঙ্গলকারী রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায়। আদালত কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয়, উদাসীন বা দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। তার গতিশীলতা ও ইতিবাচক ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয়। শুধু তা-ই নয়, নাগরিককে দেওয়া পরিত্রাণ সদর্থক ও ইতিবাচক হওয়ার পাশাপাশি তা প্রয়োগের দিকেও নজরদারি চালাতে হবে।

কোনও সরকার যদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য বা ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়, সেখানে আদালতকেই সংবিধান মান্য করে সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় ব্রতী হতে হবে, উপায় কী। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি তো প্রধান ও অগ্রগণ্য। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চই একটি মামলায় এই মত ব্যক্ত করেছে। পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়। মহামান্য আদালত মণিপুর নিয়ে আরও পদক্ষেপ করবে, এই বিশ্বাস ও আস্থা আমাদের রইল— একমাত্র তাতেই হয়তো মণিপুরের মানুষ আবার স্বস্তি ও শান্তির জীবনে ফিরতে পারবেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Manipur Violence Manipur Supreme Court of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।