Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ নাগরিক স্বার্থকে সর্বোচ্চ মান্যতা দিল
Electoral Bonds

অসাংবিধানিক ‘বন্ড’

সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় একটি মাইল ফলক, কেননা বিচারপতিরা শুধু নির্বাচনী বন্ডটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েই দায় সারেননি, পাশাপাশি এর সঙ্গে জুড়ে থাকা সব ক’টি আইনে করা পরিবর্তনগুলিকেও অসাংবিধানিক বলেছেন।

সচেতন: নির্বাচনী বন্ড কাণ্ডের প্রতিবাদে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কার্যালয়ের বাইরে সিপিএম-এর কর্মীরা, চেন্নাই, মার্চ ২০২৪। পিটিআই।

সচেতন: নির্বাচনী বন্ড কাণ্ডের প্রতিবাদে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কার্যালয়ের বাইরে সিপিএম-এর কর্মীরা, চেন্নাই, মার্চ ২০২৪। পিটিআই।

আনন্দ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৪ ০৮:৪৬
Share: Save:

পনেরো ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ‘নির্বাচনী বন্ড’ প্রকল্পটিকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেয়। প্রকল্পটিকে নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য জানার অধিকার লঙ্ঘনকারীরূপে আখ্যা দিয়ে আদালত স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেয়, গত ১২ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ থেকে কেনা সমস্ত বন্ডের হিসাব ভারতের নির্বাচন কমিশনকে আগামী ৬ মার্চের মধ্যে জানাতে হবে, যা নির্বাচন কমিশন ১৩ মার্চের মধ্যে তার সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবে। এর পর স্টেট ব্যাঙ্ক সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই তথ্য প্রকাশের জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চায়। অভিযোগ ওঠে, স্টেট ব্যাঙ্ক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে নির্বাচনের সময় বিশেষ সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আদালতের রায়কে কার্যকর করতে টালবাহানা করছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের কড়া অবস্থানের ফলে স্টেট ব্যাঙ্ক অবশেষে গত ১২ মার্চ নির্বাচন কমিশনের কাছে বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা দিতে বাধ্য হয়, যা ধীরে ধীরে নির্বাচন কমিশন তার ওয়েবসাইটে তুলে ধরবে বলে আশা করা যায়। স্বভাবতই, কোন কোন ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা প্রদান করেছে, তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত সচেতন নাগরিক সমাজ।

নির্বাচনী বন্ড হল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের সময় ডোনেশন রূপে প্রদেয় অর্থের আইনস্বীকৃত পথ। কোনও ব্যক্তি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকেই এই বন্ড কিনতে পারত এবং তা পছন্দের রাজনৈতিক দলকে চাঁদা বাবদ প্রদান করতে পারত। শুধুমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক ছাড়া কেউই জানতে পারত না যে, কোন ব্যক্তি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক দলকে বন্ডের মাধ্যমে কত টাকা দিয়েছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পটি চালু হওয়ার আগে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭-র মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫১, আয়কর আইন ১৯৬১ এবং কোম্পানি আইন ২০১৩-তে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ডোনেশন দাতাদের পরিচয় গোপন রাখার উপর সুরক্ষা প্রদান করে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং নির্বাচন কমিশনের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করেই সরকার স্বচ্ছতার নামে এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে কালো টাকার রমরমা খতম করার দোহাই দিয়ে এই বন্ড চালু করে। স্টেট ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৮ থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির হাতে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা পৌঁছেছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থ (৫৭ শতাংশ) একাই বিজেপির হাতে গিয়েছে। ১০ শতাংশ গিয়েছে কংগ্রেসের ঝুলিতে। নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ের করা পরিসংখ্যান মোতাবেক বিজেপি ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬৫৬৬ কোটি টাকা বন্ড মারফত গ্রহণ করেছে। কংগ্রেস নির্বাচনী বন্ড মারফত পেয়েছে ১১২৩ কোটি টাকা। অন্য দিকে, রাজ্যভিত্তিক দল হিসাবে এই সময়কালেই তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ১০৯৩ কোটি টাকা এসেছে, যার অবস্থান সর্বভারতীয় নিরিখে বিজেপি ও কংগ্রেসের ঠিক পরেই।

সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় একটি মাইল ফলক, কেননা বিচারপতিরা শুধু নির্বাচনী বন্ডটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েই দায় সারেননি, পাশাপাশি এর সঙ্গে জুড়ে থাকা সব ক’টি আইনে করা পরিবর্তনগুলিকেও অসাংবিধানিক বলেছেন। বস্তুত এই রায়ের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছে সর্বোচ্চ আদালত। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন, তথ্য জানার অধিকার তথা স্বাধীন ও মতপ্রকাশের অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সর্বোচ্চ আদালতের এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কোন রাজনৈতিক দল কোন ব্যক্তি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্বাচনী খরচ মেটাতে চাঁদা বাবদ কত বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছে, তা জানার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের নিশ্চয়ই আছে। এই তথ্য জানার পরে নাগরিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনও রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন করতে পারেন বলে সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে।

পূর্ববর্তী একাধিক আইন সংশোধন করে কোনও কোম্পানি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে যে কোনও পরিমাণ অর্থ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ডোনেশন বাবদ পছন্দের রাজনৈতিক দলকে প্রদান করার সুযোগ করে দিয়েছিল বর্তমানে কেন্দ্রশাসিত বিজেপি সরকার। পূর্ববর্তী আইন অনুযায়ী, কোনও কোম্পানি শেষ তিন বছরের গড় লাভের ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ চাঁদা বাবদ প্রদান করতে পারত। পরিবর্তিত আইনে ক্ষতির মুখে পড়া কোনও কোম্পানিও এই বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা দেওয়ার অধিকারী হয়ে ওঠায় বন্ডের আড়ালে দুর্নীতি ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করার উদ্দেশ্য মাননীয় বিচারপতিদের নজর এড়িয়ে যায়নি। স্বভাবতই, সরকারের আইন সংশোধনের সিদ্ধান্তকেই নাকচ করে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছে।

এই রায় দিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালত তথ্য জানার অধিকার আইনের মূল ভাবনাটিকেই পুনঃস্থাপিত করল বলা যেতে পারে। স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা, তথ্য অধিকার আইনের দু’টি মূল উপাদান, যা নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভাবে অবহেলিত হয়েছে। এক সময় কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনারও নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য জানানোর আবেদন পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিল, যা একটি অনৈতিকতার নজির হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি সংসদে এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও তারাও এই বন্ডের মাধ্যমে অনুদান নিতে পিছপা হয়নি। অসরকারি সংস্থা এডিআর, কমন কজ়-এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসাবে একমাত্র সিপিএমই এই প্রকল্প বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করেছিল।

এই রায় প্রকাশের ফলে তথ্য অধিকার আইন নিয়ে কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্য সরকারের চরম অবহেলা ও টালবাহানার দিন শেষ হতে চলেছে বলে বহু তথ্য অধিকার কর্মী মনে করছেন। এমনিতেই দেশ জুড়ে অসংখ্য আবেদন এই আইনের আওতায় সরকারি দফতরে পড়ে রয়েছে। গত বছরের ৩০ জুন সময়সীমা পর্যন্ত ৩ লক্ষ ২১ হাজার আপিল বিভিন্ন কমিশনে ঝুলে রয়েছে।

জরুরি কথা হল, রাজ্য তথ্য কমিশনগুলির ২৯টির মধ্যে চারটি কার্যত অচল, তিনটি বর্তমানে অভিভাবকহীন। অন্য দিকে, ১৯টি রাজ্য কমিশন বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি, যা এই আইনে বাধ্যতামূলক। বহু কমিশনে অভিযোগের শুনানি হতে বছরখানেকেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বস্তুত, সরকারি অনাগ্রহে এই কমিশনগুলির অস্তিত্ব ক্রমশই লুপ্ত হওয়ার মুখে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের আদেশ এই আইনের ভবিষ্যৎকে নতুন ভাবে আলোকিত করল নিঃসন্দেহে। ২০১৩-র ৩ জুন কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন একটি যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় নিয়ে আসে। এ বার নির্বাচনী বন্ড বাতিলের পাশাপাশি ডোনেশন গ্রাহক ও প্রাপকদের নাম ঘোষণার আদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের মুষ্টিকে আরও বেশি শক্ত করতে উদ্যত হল। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো নিজেদের স্বার্থে কাজ করে যাবে, কিন্তু নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা ও গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা, এই দু’টি কাজ সর্বোচ্চ আদালতের প্রচেষ্টায় জারি থাকুক, সেটাই দেশবাসীর আশা।

অন্য বিষয়গুলি:

Electoral Bonds Supreme Court SBI Post Editorial Lok Sabha Election 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy