— ফাইল চিত্র।
আজকাল রাজনীতির তরজায় বার বার উঠে আসছে ১৯৪০-এর জুন মাসে দেওয়া নেতাজির একটি বক্তৃতার কথা। ঝাড়গ্রামে এই বক্তৃতায় সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘোর সমালোচনা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, “সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছেন। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই তাদের নিন্দা করা কর্তব্য।”
ইতিমধ্যে নেতাজি গবেষক হিসাবে খ্যাত চন্দ্রচূড় ঘোষ ২০২২-এর ২৪ জানুয়ারি সমাজমাধ্যমে দাবি করেছেন, উপরের এই উক্তিটি বানানো, ‘বাম-কংগ্রেসি জালিয়াতি’র উৎকৃষ্ট উদাহরণ— এমন কথা নেতাজি আদৌ বলেননি। ইংরেজিতে তিনি যা লিখেছেন, তার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “এ ভাবেই মিথ সৃষ্টি করা হয়। মিথ্যা প্রচারের একটি ছাঁদ তৈরি করো আর পার্টি কর্মীরা সেটা ছড়িয়ে দিক। কেউ মূলটি দেখাতে পারবে না। সুভাষ বসুর রচনা সংগ্রহ-তে নেই। আমি সেই দিনের যুগান্তর দেখেছি। কোনও খবর নেই। বাম-কংগ্রেসি জালিয়াতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।” তাঁর পোস্টটি প্রচুর ‘শেয়ার’ হয়। এবং এর পর থেকে সমাজমাধ্যমে নেতাজির ওই বক্তব্যকে হিন্দুত্ববাদীরা বার বার মিথ্যাচার বলে দাগিয়ে দিতে থাকেন।
ঘটনা হল, নেতাজির উক্তিটি গত কয়েক বছরে যে সমাজমাধ্যমে নানা ভাবে ছড়িয়েছে, তার অধিকাংশেই কিন্তু সূত্র হিসাবে ১৯৪০-এ আনন্দবাজার পত্রিকার ১৪ মে সংস্করণের উল্লেখ আছে। চন্দ্রচূড়বাবুরা যদি ওই দিনের আনন্দবাজার পত্রিকার সাতের পাতাটি দেখতেন, তা হলেই পেয়ে যেতেন নেতাজির বক্তব্য।
১২ মে-র সভার বক্তব্য ১৪ তারিখ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, নেতাজি কিছু অন্য পত্রিকার নাম করে এ-ও বলেছিলেন, তারা “দিনের পর দিন মিথ্যা কথা প্রচার করিতেছে। সুতরাং ওই সকল কাগজ পড়া কাহারো কর্তব্য নহে।” তাঁর অভিযোগ, যে সময়ে দীর্ঘ তিন বছরের চেষ্টায় মুসলিম লীগের সঙ্গে ইউরোপীয়দের সমঝোতা ভেঙে ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলনে শরিক করা গেছে, কলকাতা পুরসভা চালানো হয়েছে হিন্দু-মুসলমানে মিলে, প্রমাণিত হয়েছে ইংরেজদের সরিয়ে দেশ চালানো সম্ভব, সেই সময়ে হিন্দু মহাসভা-পন্থী এই সব সংবাদমাধ্যম লাগাতার এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে চলেছে।
সেই রবিবার, ঝাড়গ্রামের অদূরে দহিজুড়িতে (তখন দইজুড়ি) সংবর্ধনা গ্রহণ ও ঝাড়গ্রাম শহরে সাংগঠনিক বৈঠক সেরে লালগড়ের মাঠে জনসভায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ইহারা কেহই আমাদের শত্রু নয়, দেশবাসী সকলেই আমাদের মিত্র। একমাত্র শত্রু বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ। কংগ্রেসের নীতি বজায় রাখিয়া আমরা হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা করিয়াছিলাম (মার্চ ১৯৪০-এ), কিন্তু সাভারকর হুকুম দিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে মিটমাট করিও না। সেই জন্য হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মিটমাট ভাঙ্গিয়া গেল।”
তিনি প্রশ্ন করেন, “হিন্দু মহাসভার চেষ্টার ফলে কংগ্রেসের ভিতর দুই দলের সৃষ্টি হইয়াছে। ইহাতে হিন্দুসমাজ শক্তিশালী হইয়াছে না দুর্বল হইয়াছে?” তিনি বলেন, “হিন্দু মহাসভা হিন্দু মহাসভার কাজ করুক, কংগ্রেস কংগ্রেসের কাজ করুক, তাহা হইলে গোলমাল থাকে না। কিন্তু হিন্দু মহাসভা যদি কংগ্রেসের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করে, তবে বিরোধ অনিবার্য।” প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা হিন্দু মহাসভার নামে রাজনীতিতে প্রবেশ করে রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন, এমন অভিযোগ তুলে তাঁর বক্তব্য, “যদি হিন্দু মহাসভার নীতি প্রগিতিশীল হইত, আমরা আপত্তি করিতাম না। তাহা যখন নয়, তখন বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। বাঙ্গালী নিজের রক্ত দ্বারা জাতীয়তার শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে। জাতীয়তাকে ভুলিলে বাঙ্গালীর অস্তিত্ব থাকিবেনা।”
সুভাষচন্দ্রের মুখে এই সব ঝাঁঝালো বক্তব্য হঠাৎ উঠে আসেনি। সুর চড়ছিল ১৯৩৯-এর ডিসেম্বর থেকেই, যখন হিন্দু মহাসভার বঙ্গীয় সংগঠন জোরদার করতে সাভারকর কলকাতায় এসেছেন, আর অন্য দিকে সুভাষচন্দ্র তখন ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর করার ডাক দিয়েছেন। তাঁর সম্পাদিত ফরোয়ার্ড সাপ্তাহিকে (৩০ ডিসেম্বর ১৯৩৯) কলকাতায় সাভারকরের ভাষণের তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়, কংগ্রেস বার বারই মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভাকে কাছে টেনে জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই ‘সাম্প্রদায়িক’ সংগঠনগুলি তাতে সাড়া দেয়নি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বয়ান থেকে জানা যায়, তিনি যখন ১৯৩৯-এর ডিসেম্বরে বাংলায় হিন্দু মহাসভার দায়িত্ব নেওয়ার পর সুভাষের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যান, সুভাষ হাসতে হাসতে তাঁকে বলেন যে এমন সংগঠন তৈরি হওয়ার আগেই ভেঙে দেওয়া উচিত।
সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির সঙ্গে তাঁর বিরোধ সত্ত্বেও তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইতে তাদের কাছাকাছি আনার চেষ্টা করার পক্ষপাতী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সাভারকর ও জিন্না দু’জনের সঙ্গেই তিনি যোগাযোগ করেন। জিন্নাকে তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলেও জিন্না তখন পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনায় বুঁদ হয়েছিলেন। আর সাভারকার ছিলেন, সুভাষের ভাষায়, “আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন” এবং “শুধুমাত্র হিন্দুরা কী ভাবে ভারতে ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করে সামরিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পারে”, সেই চিন্তায় মগ্ন।
বস্তুত, সুভাষের দেশদর্শন পুরোটাই হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনার বিপরীত মেরুতে। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাভাবনার অনুসারী। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ছিল, কিন্তু তা আন্দোলনের পথ নিয়ে; দেশের স্বরূপ নিয়ে নয়। এঁরা তিন জনই ব্রিটিশ শাসনকে পরাধীনতার সূত্রপাত ধরতেন, অন্য কিছুকে নয়। এটা আলাদা করে জোর দিয়ে বলা দরকার, কেননা গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে একাধিক বার ‘হাজার বছরের পরাধীনতা’র কথা বলে মুসলিম সম্রাটদের শাসনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, দেশবন্ধু, গান্ধী, সুভাষ বা নেহরু— চার জনেই এই ভাবনার থেকে বহু যোজন দূরে ছিলেন।
অথচ গত কয়েক বছর ধরেই হিন্দুত্ববাদীরা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদী ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত তাঁদের নেতাজি প্রেম বারংবার দেখানোর চেষ্টা করছেন। নেতাজিকে ‘অখণ্ড ভারত’-এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদী, বিদেশমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। সম্প্রতি চিত্রাভিনেত্রী তথা বিজেপি প্রার্থী কঙ্গনা রানাউতের মন্তব্যটিকে তাই খুব আকস্মিক বা বিক্ষিপ্ত বলা চলে না। বুঝতে অসুবিধা নেই, তাঁদের রাজনীতি নেতাজির রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে ধারাবাহিক ভাবে এ কাজ করে চলেছেন, তার একটাই কারণ— নেহরুকে ছোট করতে নেতাজির নামের ‘ব্যবহার’।
দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইতে ‘দ্য ব্যাকগ্রাউন্ড অব ইন্ডিয়ান পলিটি’ প্রবন্ধে সুভাষ বলেছেন, আগত মুসলমানরা ভারতকেই তাদের বাসস্থান বানিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে। এই মেলামেশা থেকে বিকশিত হয়েছে নতুন শিল্প ও সংস্কৃতি, যা আগের থেকে আলাদা, কিন্তু বিশেষ ভাবে ভারতীয়। মুসলমান শাসনে প্রশাসন জনগণের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করেনি। তাঁরা স্থানীয় গ্রাম্য স্ব-শাসনে হস্তক্ষেপ করেননি। তিনি মন্তব্য করেন যে মোগল রাজারা দেশকে একীভূত করেছিলেন এবং সর্বাত্মক উন্নতির একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।
এ বার ভাবা যেতে পারে, হিন্দুত্ববাদীরা মোগল তথা অন্য মুসলমান শাসকদের নিয়ে নিত্যদিন কী বলে থাকেন। সুভাষচন্দ্র বলেছেন, ভারতে আগতদের মধ্যে ব্রিটিশরাই প্রথম এবং একমাত্র ব্যতিক্রম, যারা এ দেশের সঙ্গে মিশে না গিয়ে চেয়েছে গোটা দেশটিকে পুরোপুরি আধিকার করতে। তাঁর মতে, মোগলদের পর ব্রিটিশ শাসনেই ভারতীয় জনগণ প্রথম বারের মতো অনুভব করতে শুরু করেছিল যে তারা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে কেমন বিজাতীয় আধিপত্যের শিকার। এই আলোকে তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রীর ‘হাজার বছরের গোলামি’র তত্ত্ব?
১৯৪০-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ফরোয়ার্ড-এ ‘সাম্প্রদায়িক ঐক্যের দিকে’ শিরোনাম-সহ একটি সম্পাদকীয়তে সুভাষ লিখেছিলেন, “সাম্প্রদায়িক মানসিকতা চলে গেলেই সাম্প্রদায়িকতা যাবে। তাই সাম্প্রদায়িকতাকে ধ্বংস করা সেই সমস্ত ভারতীয়ের কাজ— মুসলমান, শিখ, হিন্দু, খ্রিস্টান ইত্যাদি— যারা সমস্ত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে একটি প্রকৃত জাতীয়তাবাদী মানসিকতা গড়ে তুলছে।”
সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করা আজ খুব বেশি জরুরি। এই শেষ বাক্যটিই তার কারণ বুঝিয়ে দেয়— যে বাক্যে তাঁর সারা জীবনের সাধনার অন্যতম মূলকথাটি বলে দেওয়া আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy