Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Language

ভাষা আন্দোলনের সেই দিনে

সদুত্তর না দিয়েই সেই ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমতলায় পৌঁছে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:১২
Share: Save:

অত সকালেও মা ও বোন পরোটা-ডিম খাইয়ে দিয়েছিলেন সকলকে। বেরোনোর মুখে মায়ের জিজ্ঞাসা, “পুলিশ তোমাদের ধরে নিয়ে গেলে তখন আমাদের করণীয় কী হবে?”


সদুত্তর না দিয়েই সেই ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমতলায় পৌঁছে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। তিন দিন আগে পনেরো বছরের জন্মদিন গিয়েছে তাঁর। গোটা এলাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা। ছাত্র সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দশ জনের এক-একটি দল রাস্তায় বেরোতে শুরু করে। প্রথম দল বেরিয়ে গেলে এক ছাত্রনেতা আনিসুজ্জামানকে ডেকে, যুবলীগ অফিসের চাবি দিয়ে বলেন, ওঁরা গ্রেফতার হলে অফিসের দায়িত্ব তাঁর। অবস্থা বুঝে কাগজপত্র সরাতে হবে, সমস্ত ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। দায়িত্ব পালনের জন্য সে দিন আনিসুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেননি।


তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দল ক্রমশ বাড়তে থাকলে পুলিশ লাঠি চালায়। ছাত্ররা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। চোখ জ্বলছিল, আনিসুজ্জামান গা থেকে গেঞ্জি খুলে পুকুরের জলে ভিজিয়ে চোখে দিচ্ছিলেন। পরে কলাভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা উপাচার্যের কাছে গিয়ে তাঁকে এই পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে বলেন। উপাচার্য জানান, পুলিশ তাঁর কথা শোনেনি, তিনি প্রতিবাদ করবেন।


তত ক্ষণে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে জড়ো হচ্ছে সবাই। গ্যাসের টিউব পায়ে লেগে বছর দশেকের একটি ছেলে আহত হয়। আনিসুজ্জামান-সহ কয়েকজন তাঁকে রেলিঙের উপর দিয়ে অন্যদের হাতে তুলে দেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আনিসুজ্জামান পরে লিখছেন, “আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাকে বলেন, গুলি চলতে পারে। তার মিনিট পনেরো পরেই গুলি চলে… আমরা শুনতে পাই যে, আবুল বরকত, সালাম ও রফিকউদ্দীন নামে তিনজন মারা গেছে।”


এই ঘটনার পর মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের এগারো নম্বর ঘরে মাইক্রোফোন বসানো হয়। ওটাই কন্ট্রোল রুম। যে যেমন পারছিলেন বলছিলেন। আনিসুজ্জামানকে একটা বক্তৃতা লিখে দিতে বলা হলেও লেখার গতি তাল রাখতে পারছিল না বলার উদ্দামতার সঙ্গে। তাঁর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয় কেউ। পুলিশের নিজেদের ধর্মঘটের সময় “সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন চালায়, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাঙালী হিসেবে তাদেরকে আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে বলি…।”


২২ ফেব্রুয়ারি তল্লাশির আশঙ্কায় যুবলীগ অফিস থেকে দরকারি কাগজপত্র ও টাইপরাইটার বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। পর দিন বাবার ‘ডাক্তার’ লেখা গাড়িতে লক্ষ্মীবাজার থেকে মাইক্রোফোন ভাড়া করে জগন্নাথ কলেজে নিয়ে যান। হস্টেলের একটা ঘরে সেটা বসিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ বক্তৃতা চলে। সে দিনই তাঁর কাছে ফরিদপুর থেকে টেলিগ্রাম আসে, ফরিদপুর জেলের সংবাদ। কাল নিরবধি গ্রন্থে তাঁর স্মৃতিচারণ: “রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সেখানে কয়েকদিন ধরে অনশন করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ। একুশের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে অনশনের কারণ হিসেবে তার প্রতিবাদও তাঁরা যুক্ত করেছেন... এই টেলিগ্রামের ভিত্তিতে একটা খবর তৈরি করে আমি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় দিয়ে আসি এবং তা মুদ্রিত হয়।”


১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আনিসুজ্জামান ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তার কিছু দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি, ক্রমে লীগের অফিস সম্পাদক। ১৯৫২-র ৪ ও ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবসে যোগ দেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে ভাষা আন্দোলনের পতাকা বিক্রি করেছেন, প্রতিবাদ কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে। পোগোজ ও সেন্ট গ্রেগরি’জ় স্কুলে ধর্মঘট করাতে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। এই সময় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে একটি পুস্তিকা রচনার ভারও তাঁর উপর বর্তায়; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: কি ও কেন শিরোনামে পুস্তিকাটি মুদ্রিত ও প্রচারিত হয় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নামে। এটাই সম্ভবত ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারি মাসে ছাপা প্রথম পুস্তিকা।


১৯৮২-র ২২ অক্টোবরে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে আনিসুজ্জামানের একুশের স্মৃতিচারণ এমনই। লিখেছেন ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহিদ মিনার তৈরির কথাও। তাঁর আব্বা ও মা শহিদ মিনারে গিয়েছিলেন, বাবার বয়ানে সেই ঘটনা: “খুব একটা আবেগঘন দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। সবাই সাধ্যমত সাহায্য করছিল। টাকাপয়সা, ফুল। ওঁরা বলাবলি করছিলেন, এই সাহায্য আন্দোলনের তহবিলে জমা করা হবে...তোমার মা সোনার হার দিয়ে দিলেন। আমি তো অবাক। এই হারটা তিনি আমাকে না বলেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কোন হার। তোমার মা বললেন, নাজমুনের।”


নাজমুন আনিসুজ্জামানের ছোট বোন। মাত্র এগারো মাস বেঁচেছিল সে।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy