শান্তিনিকেতনে তখন শঙ্খ ঘোষ। সেখানে অরবিন্দ নিলয়ে বক্তৃতা দিতে এসেছেন দার্শনিক জিতেন্দ্রনাথ মহান্তি। অরবিন্দের দর্শন তাঁর বলবার বিষয়। শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল শঙ্খের, “একই সঙ্গে অভিজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞকে মুঠোয় ধরতে পারেন এই বক্তা। সেইটেই খুব শক্ত কাজ।” জিতেন্দ্রনাথ যে কাজটি অরবিন্দ বিষয়ে করতে চাইছিলেন, সেই কাজটিই শঙ্খ ঘোষ অনেক সময় করতে চাইতেন তাঁর রবীন্দ্র-বিষয়ক লেখাগুলির ক্ষেত্রে। রবীন্দ্ররচনার অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ উভয় পাঠককেই এক সঙ্গে তাঁর রবীন্দ্র-বিষয়ক রচনার উঠোনে উপনীত করতে চাওয়া আসলে এক রকম সামাজিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন বলেই যাকে বিশুদ্ধ অর্থে টীকা-কণ্টকিত অ্যাকাডেমিক শরীরবাহী বই বলে, তা তিনি রচনা করেননি। তবে তথ্যনিষ্ঠ, স্থির-সিদ্ধান্তবাহী জ্ঞানচর্চার প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ছিল না। অবজ্ঞা থাকলে নিরলস পরিশ্রমে গড়ে তুলতেন না পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র-রচনাবলীর ষোড়শ খণ্ডটি। গ্রন্থপরিচয় নামের এই খণ্ডটি কোষগ্রন্থের মতো। সম্পাদকমণ্ডলীর শেষ নামটি তাঁর। তবে নিকট-জনেরা জানতেন, পুরো খণ্ডটি গড়ে তুলতে কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের কোনও রচনা পড়তে গিয়ে যা যা তথ্য মোটের উপর কাজে লাগতে পারে, তা সাজানো আছে এখানে, রয়েছে প্রয়োজনীয় সমভাবের রচনাংশ, চিঠিপত্রের প্রাসঙ্গিক উল্লেখ। কোনও বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়াই এক জন রবীন্দ্রপাঠক এই কোষগ্রন্থ সদৃশ গ্রন্থপরিচয় খণ্ডটি হাতে পেলে সহজেই সতথ্য ঢুকে পড়তে পারেন রবীন্দ্র-রচনার ভিতরে।
শঙ্খবাবুর বন্ধুত্বের গভীরতম বৃত্তে ছিলেন প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য, শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। শেফালী মৈত্র লিখেছিলেন, “শঙ্খ ঘোষ (শঙ্খদা), শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শচীনদা) ও প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য (প্রদ্যুম্নদা) ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। মনের মিল এঁদের এতটাই যে একজনের মনোজগতের পরিচয় থেকে অপর দুজনের চেতনার পরিমণ্ডল কেমন হতে পারে, তা অনুমান করা সম্ভব।” তাঁর থেকে সাত মাসের ছোট প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের প্রয়াণের পর শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘ভারতকোষ থেকে লোকবিদ্যা’ নামের স্মৃতিচারণ। তাতে ধরা পড়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের তিনতলায় ছাদ-সংলগ্ন পাশাপাশি দুটো ঘরের ছবি। সেখানে নির্মলকুমার বসু, চিন্তাহরণ চক্রবর্তীদের সাহচর্যে শঙ্খ-প্রদ্যুম্নের মতো তরুণেরা ভারতকোষ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। গত শতকের ষাটের দশক সেটা। শঙ্খবাবু লিখেছিলেন, “বস্তুত, এই স্বপ্নটাই তখন প্রদ্যুম্নের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন। ‘ভারতকোষ’-এর সূত্র ধরে... জ্ঞানচর্চার এমন একটা আন্দোলন গড়ে উঠবে, যা কেবল কয়েকজনের বুদ্ধিচর্চাই নয়, যা হয়ে উঠতে পারে গোটা একটা সমাজবদলের সূচক।” তাঁদের সে-স্বপ্ন সার্থক হয়নি। তবে শঙ্খ ঘোষ পড়াশোনার অনলসতায় বিরতিহীন সম্পাদনায় কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখার কাছে যেতে হয়, সে চেষ্টা করতেন। এ চেষ্টা যাতে সাধারণ-সামাজিকরাও এক ভাবে করতে পারেন, তারই জন্য হাত দিতেন রবীন্দ্র-রচনার সঙ্কলন নির্মাণে। তাঁর করা ‘রবীন্দ্ররচনা থেকে নির্বাচিত অংশাবলির সংকলন’ হে মহাজীবন তেমনই এক নির্মাণ। ‘সুভাষ চৌধুরীর প্রবর্তনায়’ রেকর্ড কোম্পানির মাধ্যমে বাঙালি শ্রোতাদের জন্য আদতে নির্মিত হয়েছিল পারফর্মেটিভ টেক্সট। সত্যজিতের করা রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রের মতোই সংহত, লিখেছিলেন এ রবীন্দ্ররচনার মাধ্যমে ‘রবীন্দ্রনাথের ভাবনাপথকে ছুঁয়ে যাবারই ক্ষীণ একটা চেষ্টা।’ রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা থেকে শঙ্খবাবু বেছে নিয়েছিলেন সেই অংশগুলি, যা নিরাপদ ধূপ-ধুনো কবলিত ‘ঠাকুরপুজো’র বাঙালি নিশ্চিন্ততাকে একটু ঝাঁকুনি দেয়।
মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের লেখা-পত্রকে ঘিরে বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে হত তাঁকেও। রবীন্দ্ররচনা কেন্দ্রিক বিতর্কের ভাষা কেমন হবে, তার একটা চেহারা তাঁর সেই লেখাগুলিতে পাওয়া যায়। সে ভাষার চরিত্র নানা রকম হতে পারে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আবু সয়ীদ আইয়ুব দু’জনের সঙ্গে রবীন্দ্র-রচনা বিষয়ক বিতর্ক হয়েছিল তাঁর। নীরদচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর যা হয়েছিল, তাকে অবশ্য ঠিক বিতর্ক বলা যাবে না। নিজের স্মৃতিশক্তি সম্বন্ধে অসম্ভব প্রত্যয়ী নীরদচন্দ্র রবীন্দ্ররচনা সম্বন্ধে স্মৃতিনির্ভর নানা মন্তব্য করতেন। আত্মঘাতী বাঙালি-র রচয়িতা বিশ্বাসই করতেন না যে, তাঁর স্মৃতি তঞ্চকতা করতে পারে। শঙ্খ ঘোষ একটি সকৌতুক রচনায় এই ‘আত্মঘাতী প্রতিভা’র তথ্যগত ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর ভাষা সকৌতুক, কিন্তু নির্মম নয়। আইয়ুবের সঙ্গে তাঁর রবীন্দ্রবিচারের প্রতর্কটি আর এক রকম। সেখানে দু’জনের কথা হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটি নিয়ে। সেখানেই শঙ্খবাবু লিখেছিলেন ‘আমাদের এই অভাগ্য দেশে যখন মতান্তর মানেই মনান্তর’-এর মতো সেই প্রবাদতুল্য বাক্যাংশটি। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আঁঠিতে খোসাতে এত মনান্তর, মতান্তর, অবস্থান্তর থাকিত না।’ বাক্যাংশটি ভেঙে এই নতুন-নির্মাণ ঘটিয়ে ছিলেন তিনি। তবে রবীন্দ্রবিচার বিতর্কে তাঁর সবচেয়ে তথ্যনিষ্ঠ শানিত রচনা প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের অভিযোগের জবাব। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী যে স্ট্রিন্ডবার্গের আ ড্রিম প্লে থেকে চুরি এবং তা ঢাকা-দেওয়ার জন্য নানা কৌশল করতে হয়েছে, এই অভিযোগ তথ্য-বিশ্লেষণে খারিজ করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তর্কের জবাব কী ভাবে সাজাতে হয়, সে লেখা তার চমৎকার নিদর্শন। এই বিশ্লেষণী মনোভঙ্গি ছিল বলেই ছন্দের বারান্দা বইতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছন্দ নিয়ে নতুন কথা লিখতে পেরেছিলেন তিনি।
তবে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক অধিকাংশ রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেরই একটি সিদ্ধান্ত মনে রাখতেন তিনি। রবীন্দ্র-অভিমত, ‘সাহিত্যের বিচার হচ্ছে সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয়। এই ব্যাখ্যা মুখ্যত সাহিত্যবিষয়ের ব্যক্তি নিয়ে, তার জাতিকুল নিয়ে নয়। অবশ্য সাহিত্যের ঐতিহাসিক বা তাত্ত্বিক বিচার হতে পারে। সে-রকম বিচারে শাস্ত্রীয় প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তার সাহিত্যিক প্রয়োজন নেই।’ এ জন্যই হয়তো সাহিত্যের ঐতিহাসিক বা তাত্ত্বিক বিচারের চাইতেও আস্বাদনমূলক ব্যাখ্যাতেই তাঁর মন নিয়োজিত। তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লেখার সময় প্রবন্ধের প্রচলিত রূপের মধ্যে আটকে থাকতেন না তিনি। কাল্পনিক চরিত্র, তাদের শ্রেণিগত অবস্থান কখনও বা নির্দেশিত, শঙ্খ ঘোষের লেখায় তাঁরা কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথের কোনও রচনা নিয়ে।
রবীন্দ্ররচনার ব্যাখ্যাকার হিসেবে তাঁর গদ্যভঙ্গিও বদলে গিয়েছিল ক্রমে। কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক যে ভঙ্গিতে লিখেছিলেন তিনি, সে ভঙ্গিতে দামিনীর গান বা ভিন্নরুচির অধিকার লেখা নয়। রবীন্দ্রনাথের নাটক-গান-কবিতা চিরকালই তাঁর মনোযোগ দখল করেছিল বেশি। এগুলি পারফর্ম করা সম্ভব— তাই এই রচনাগুলিই হতে পারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ পাঠকের যোগাযোগের সূত্র। সেই যোগাযোগ এক রকম রাজনৈতিক কৃত্যও বটে। কারণ রবীন্দ্র-রচনাকে ফ্যাসিবাদী পরাক্রমের বিরুদ্ধে, পুঁজির উল্লাসের বিপরীতে মানুষের দাঁড়াবার জায়গা হিসেবে নির্দিষ্ট করতে চাইছিলেন তিনি। আজ এই বিষণ্ণতার দিনে সে দাঁড়ানোর জায়গাটি আমরা যেন হারিয়ে না ফেলি।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy