বাংলার নবাব তখন মির কাসিম। ১৭৬২-৬৩ সাল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় ক্ষমতায় এলেও তাঁর খেতাবি পরিচয় ছিল মোগল বাদশাহের প্রতিনিধি প্রশাসক। সেই দায়িত্বপালনের তাগিদেই ব্রিটিশ গভর্নর ভ্যান্সিটার্টকে বার বার চিঠি লিখেছেন তিনি, কোম্পানির কর্মচারীদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যাধিকারের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে, এবং প্রতিকার চেয়ে। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের মানুষ’, অর্থাৎ ভারতীয় কৃষক, কুটিরশিল্পী, বণিকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। মির কাসিম প্রশ্ন করেছিলেন, “আমার দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, আর আমি একটা কথাও বলব না?” একশো বছর পরেও, সিপাহি বিদ্রোহের সময় জারি হওয়া ফিরোজ় শাহের ঘোষণাপত্রে দেখা যায়, তাঁদের বিদ্রোহ ছিল বিদেশিদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দুস্থানি’-দের বিদ্রোহ— “দীন ও ধর্মরক্ষার্থে হিন্দুস্থানের হিন্দু ও মুসলমানদের লড়াই।” সেই লড়াইয়ে মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জ়াফরকে নেতা মানতে কিন্তু হিন্দুদের বাধেনি কোথাও।
বলিউড অভিনেতা অক্ষয়কুমারের একটি সাক্ষাৎকার শুনে মনে হল, এই কথাগুলো ফের বলা দরকার। তাঁর ছবি সম্রাট পৃথ্বীরাজ প্রসঙ্গে অক্ষয় বলেন, প্রচলিত ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পৃথ্বীরাজকে নিয়ে থাকে দু’চার কথা, মহিমাকীর্তন করা হয় আক্রমণকারীদের। তা ছাড়া মোগলদের ইতিহাস যেমন জানা উচিত, তেমনই জানা উচিত ‘আমাদের মহারাজাদের ইতিহাস’। ইতিহাসের পাঠ্যক্রমের এই সব ‘ত্রুটি’ সংশোধনের জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধও জানান তিনি। কিছু দিন পরেই প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
ভারতীয় ইতিহাসের কোন পাঠ্যক্রমে মৌর্য-সাতবাহন-গুপ্তদের ইতিহাস নেই, তার কোনও স্পষ্ট উদাহরণ শাহ বা অক্ষয় দেননি, দেওয়া অসম্ভব বলেই। ইতিহাসচর্চা যে রাজবংশের সালতামামিতে আটকে নেই— রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চায় প্রাধান্য পায়— এই বোধ বা জ্ঞানও নেতা বা অভিনেতার না-ই থাকতে পারে। কিন্তু, শাহের মন্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে, অক্ষয়ের মতামত তাঁর ব্যক্তিগত ভ্রান্ত ধারণা নয়, ইতিহাসবিকৃতির এক পরিকল্পিত আয়োজনের অংশ— যার বহুমুখী প্রতিফলন ইতিমধ্যেই দেখছি। এই পরিকল্পনার ভাষা আলাদা করে দেয় ‘মোগলদের’ ও ‘আমাদের মহারাজাদের’, যদিও আকবর ও তাঁর পরবর্তী মোগল শাসকরা— পৃথ্বীরাজ ও অন্যান্য রাজপুত রাজার মতোই— ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে জন্মানো ও বড় হওয়া, এই ভূখণ্ডেরই শাসক।
‘আমাদের রাজা’ আর ‘মোগলদের’ আলাদা করে দেখার এই ভাষা ইতিহাসের ভাষা নয়, ইতিহাসবিকৃতির ভাষা। এ ভাষা তাই অচেনা ঠেকত মির কাসিম ও তাঁর প্রজাদের, বাহাদুর শাহ জ়াফর ও বিদ্রোহী সিপাহিদের। আকবরের দরবারের কবি মুশফিকি বুখারি, যিনি ইরানের কবি হাফিজ় শিরাজির ভারতকে ব্যঙ্গ করে লেখা কবিতার জবাব দেন নিজের কবিতায় ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রশংসা করে; নিজের আত্মজীবনীতে বার বার এ দেশের প্রকৃতি ও গান-কবিতার সঙ্গে একাত্মতার কথা বলা সম্রাট জহাঙ্গির; বা আকবরের আমল থেকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সহযোগী অধিকাংশ রাজপুত রাজা— এই ভাষা তাঁদের সবার উত্তরাধিকারের সঙ্গে এক বিকৃত বিশ্বাসঘাতকতা।
সম্রাট পৃথ্বীরাজ ছবির কেন্দ্রে রয়েছেন চাহমান/চৌহান বংশীয় রাজপুত রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ, যাঁকে তুলে ধরা হয়েছে ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট হিসেবে। পৃথ্বীরাজ প্রকৃতপক্ষে ছিলেন অজমের-দিল্লি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা উত্তর ভারতের এক বড় রাজ্যের শাসক। বুন্দেলখণ্ডের চন্দেল্ল বা কনৌজের গাহাড়ওয়ালদের মতো সমসাময়িক অন্যান্য রাজপুত গোষ্ঠীর সঙ্গে বার বার লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। তাই ভারতসম্রাট দূরস্থান, পৃথ্বীরাজ সব রাজপুতেরই অবিসংবাদী নেতা ছিলেন না। পৃথ্বীরাজ ভারতীয় উপমহাদেশের শেষ হিন্দু শাসকও নন। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরির কাছে তাঁর পরাজয়ের পরেও দক্ষিণ ভারতে কাকাতীয়, হোয়সালা, পাণ্ড্য রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। পরে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী বিজয়নগর রাজ্য। মোগল আমলে রাজপুত ও মরাঠা শক্তির উত্থান ঘটে। এদের অনেকের রাজ্যের পরিসরই ছিল পৃথ্বীরাজ-শাসিত রাজ্যের চেয়ে বড়।
তা হলে, পৃথ্বীরাজকে ‘শেষ হিন্দু সম্রাট’ ভাবার ভুয়ো দাবির উৎস কী? ঔপনিবেশিক যুগে রাজস্থানের লোকপরম্পরার অন্যতম সঙ্কলক জেমস টড এই দাবির স্রষ্টা। এই দাবির কারণ বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে হিন্দু ও মুসলিমদের দু’টি পরস্পরবিরোধী জাতি হিসেবে তুলে ধরার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার সম্পর্ককে, যার ফলে জেমস মিল দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আদি ঐতিহাসিক যুগকে ‘হিন্দু যুগ’ ও দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত মধ্যযুগকে ‘মুসলিম যুগ’ বলে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, তরাইনের যুদ্ধে ঘুরির জয় ও দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার অর্থ হিন্দুশাসনের অবসান। ঔপনিবেশিক যুগের এই ভ্রান্ত, সাম্প্রদায়িক অপব্যাখ্যাকেই তবে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে দেখতে চান অক্ষয় কিংবা শাহ?
এই উদ্দেশ্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে ছবির শেষে লিখিত মন্তব্যে— পৃথ্বীরাজের পরাজয়ে ভারত স্বাধীনতা হারায়, যা ফিরে পায় ১৯৪৭ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশে জন্মানো, বেড়ে ওঠা, এ দেশের সম্পদ অন্য কোনও দেশে না-পাঠানো আকবর, ও তাঁর পরবর্তী মোগল সম্রাটদের লন্ডন থেকে নিযুক্ত ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষায় তৎপর চাকরিজীবী বিদেশি প্রশাসকদের সঙ্গে এক করে দেখিয়ে স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে গুলিয়ে দেওয়ার এই ষড়যন্ত্রকেই কি গৈরিকবাহিনী ‘ইতিহাস’ হিসেবে দেখতে চায়? ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বলতে পৃথিবী যা বোঝে, তার নির্মাণে অপরিসীম অবদান রাখা ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীকে পরাধীনতার কাল হিসাবে তুলে ধরার মিথ্যা ইতিহাসই কি শিখবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? ভুলে যাবে যে, মোগলদের আগেও বহু জনগোষ্ঠীর পরিযাণ ঘটেছে এই উপমহাদেশে, যারা মোগলদের মতোই এই ভূখণ্ডকে গ্রহণ করেছে নিজেদের বাসভূমি হিসেবে? বিভিন্ন শক্তির রাজনৈতিক টানাপড়েন নিয়ন্ত্রিত হয়নি ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি দিয়ে। তাই উত্তর ভারতের রাজপুত গোষ্ঠীগুলি এবং আদিমধ্যযুগের অন্যান্য শক্তি (কাশ্মীর, পাল, সেন, চালুক্য, পল্লব, গঙ্গ, রাষ্ট্রকূট, চোল ইত্যাদি) ধর্মীয় পরিচয়নিরপেক্ষ ভাবেই লিপ্ত হয়েছে কখনও সংঘর্ষে, কখনও সহযোগিতায়। সম্রাট বাবর মোগল শাসন কায়েম করেছেন মুসলমান লোদিদের পরাস্ত করেই। আবার, আকবরের সময় থেকে রাজপুতদের প্রতিপত্তি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তাগিদ এসেছে রাজপুতদের ইতিহাস নতুন করে লেখার। এই তাগিদের ফসলের অন্যতম ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ নামক দীর্ঘ কবিতাটি, যা অক্ষয়ের ছবিটির মূল অবলম্বন।
সেই কবিতা দাবি করে যে, এর রচয়িতা পৃথ্বীরাজের সমসাময়িক চারণকবি চাঁদ বরদাই। কিন্তু গবেষকদের মতে, দাবিটি ভিত্তিহীন। ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’-র ঐতিহাসিক ভিত্তি যে নড়বড়ে, তা ধরা পড়ে যায় পৃথ্বীরাজের আমলে রচিত জয়নকের পৃথ্বীরাজবিজয়, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিভিন্ন পারসিক ও সংস্কৃত বিবরণ (যেমন মিনহাজ সিরাজের লেখা তবাকত-ই-নাসিরি বা মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিন্তামণি), বা কথাপরম্পরার ভিত্তিতে পরবর্তী কালে রচিত অন্যান্য বিবরণের (যেমন সংস্কৃতে রচিত পৃথ্বীরাজ-প্রবন্ধ) সঙ্গে এর অমিলে। রাসো-তে বর্ণিত বন্দি পৃথ্বীরাজের হাতে ঘুরির মৃত্যু, যা এই ছবির প্রধান নাটকীয় চমক, একটি অনৈতিহাসিক কল্পনা। পৃথ্বীরাজ ও ঘুরি, দু’জনের নামেই মুদ্রিত মুদ্রা ইঙ্গিত দেয়, পৃথ্বীরাজ অল্প সময়ের জন্য হলেও ঘুরির অধীনে শাসন করেন। পৃথ্বীরাজকে হত্যা করার পরও ঘুরি তাঁর অধীনস্থ শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন পৃথ্বীরাজের পুত্র গোবিন্দরাজকেই। পৃথ্বীরাজ ও ঘুরির মৃত্যুর মধ্যে রয়েছে এক দশকেরও বেশি ব্যবধান। ছবিতে ঘুরির জয় যদিও মুসলিম বাহিনীর শঠতার ফল, চতুর্দশ শতকের সংস্কৃত উপাদানগুলি কিন্তু পৃথ্বীরাজের অসতর্কতা, আলস্য, ও অতিনিদ্রাকেই তাঁর পরাজয়ের জন্য দায়ী করে। কোনও কোনও উপাদান তো প্রশ্ন তোলে মন্ত্রী কৈঁবাস, এমনকি খোদ চাঁদের বিশ্বস্ততা নিয়ে। ছবিতে পৃথ্বীরাজবেশী অক্ষয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের গৌরব নিয়ে মুখর হলেও, আর এক রাজপুত রাজ্য চন্দেল্ল-র রাজসভার চারণকবি জগনাইক রাও-এর নামে প্রচলিত পরমল রাসো ও অল্হাখণ্ড-এ কিন্তু পৃথ্বীরাজের পরিচয় চন্দেল্ল রাজ্যে আক্রমণকারীর, যাঁর বিরুদ্ধে স্বভূমিরক্ষায় স্থানীয় বীর অল্হা ও উদালের লড়াই মনে রেখেছে বনফর রাজপুতেরা।
কল্পকাহিনির ভিত্তিতে ছবি নির্মাণের স্বাধীনতা পরিচালকের আছে। কিন্তু, ইতিহাসের বহুমুখী বিশ্লেষণ বা উপাদানের ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক অভিনেতা যখন গত সাত দশকের গবেষণালব্ধ উপনিবেশ-উত্তর ইতিহাসচর্চার ধারাকে ধ্বংস করে বিকৃত, সাম্প্রদায়িক, ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান, এবং তার পুনরাবৃত্তি করেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন তা ত্রিশ বছর বয়সে প্রয়াত রাজার ভূমিকায় চুয়ান্ন বছরের অভিনেতাকে দেখার মতো বেমানান; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনকও।
প্রাচীন ভারতীয় ও বিশ্ব ইতিহাস বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়; ইন্ডিয়ান ওশ্ন ওয়ার্ল্ড সেন্টার, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি, কানাডা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy