—ফাইল চিত্র।
দেশের সামনে সাধারণ নির্বাচন। এমন সময়ে সারা দেশের তথা বিশ্বের নজর টেনেছেন লাদাখের সোনম ওয়াংচুক (অনেকের কাছে তাঁর পরিচয়, থ্রি ইডিয়টস ছবিতে আমির খান অভিনীত কেন্দ্রীয় চরিত্রের বাস্তব অনুপ্রেরণা)। শিক্ষাবিদ, পরিবেশ আন্দোলনকারী সোনম একুশ দিনের দীর্ঘ অনশন ভঙ্গ করেছেন ২৬ মার্চ, কিন্তু তাঁর যা উদ্দেশ্য ছিল— লাদাখে হিমালয়ের ভঙ্গুর প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ, তা সফল হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি ও তাঁর অগণিত লাদাখি অনুগামী চেয়েছেন লাদাখের আদিবাসীদের স্বাধিকার। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পর লাদাখ এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কোনও বিধানসভা ছাড়াই প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন বহিরাগত অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। যদিও এখানে ‘হিল কাউন্সিল’ রয়েছে, কিন্তু তার হাতে প্রায় কোনও ক্ষমতাই নেই।
লাদাখে উন্নয়নের নামে কী হয়েছে? তার উত্তর হিমালয়-ঘেঁষা ভারতের সব পার্বত্য এলাকার মানুষের সঙ্কটকেই প্রতিফলিত করে। পর্যটনকে প্রচার করতে গিয়ে রমরমিয়ে শুরু হয়েছে হোটেল ব্যবসা। আজ থেকে এক দশক আগেও লাদাখে পানীয় জলের কষ্ট ছিল না। অতীতে লাদাখের বরফ-ঢাকা পাহাড়ের গায়ে তৈরি সরু সরু নালা দিয়ে বরফ-গলা জল মিশত নীচে পাথর দিয়ে তৈরি করা এক চৌবাচ্চাতে। আশপাশের গ্রামের মানুষ সেই জল নিতে আসতেন। এই প্রাচীন পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কাজেই তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে পানীয় জলের। এ ছাড়াও হিমালয়ের বুকে খনিজ উত্তোলনের জন্য ঢুকে পড়েছে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি। এখানকার ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত ভঙ্গুর। কাজেই হিমালয় ও তিব্বতি মালভূমি দিয়ে গড়া লাদাখ অঞ্চলটির বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হচ্ছে।
গত বার লোকসভার আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ক্ষমতাতে এলে ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করবে লাদাখকে। ফের লোকসভা নির্বাচন এল, দল সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। লাদাখের আদিবাসী সমাজ বুক দিয়ে যে বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা জলবায়ু পরিবর্তন ও হিমালয় ধ্বংসের ফলে আজ বিপন্ন। তাই সোনম-সহ লাদাখবাসীদের একটা বড় অংশ সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি তুলছেন। তা এই আশায় যে, লাদাখ ‘রাজ্য’ হিসাবে স্বীকৃতি পেলে লাদাখবাসী উন্নয়নের রাশ নিজেদের হাতে পাবেন। প্রাকৃতিক সম্পদকে তাঁরা আগলে রাখতে পারবেন উন্নয়নের নামে ধ্বংসের হাত থেকে। লাদাখে ৯০ শতাংশ আদিবাসী মানুষ। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতিও বিপন্ন, দাবি করছেন সোনম।
কিন্তু যে সব রাজ্যে নির্বাচিত বিধানসভা রয়েছে, সে সব রাজ্যে মানুষদের পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচানোর দাবি কি সরকার শুনেছে? হিমালয়ের অবৈধ খাদান বন্ধ ও গঙ্গা বাঁচানোর দাবিতে স্বামী নাগনাথ যোগেশ্বর, স্বামী সানন্দ, স্বামী আত্মবোধানন্দ, সাধ্বী পদ্মাবতী, স্বামী শিবানন্দ অনশন করেছেন। স্বামী সানন্দ (যিনি অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল নামেও পরিচিত) একশো এগারো দিন অনশন করে মারা গিয়েছেন। সেই সময়ে হিমালয় ও গঙ্গাকে বাঁচানোর আশ্বাস এসেছিল বিজেপির কাছ থেকেই। দল সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। হিমালয়ে অবৈধ নির্মাণ ও খাদানের লুট ক্রমশ বেড়েছে। সেই সময় গঙ্গার জন্য ‘গঙ্গা আইন’ আনার প্রস্তাবও হয়। বিজেপি সেই বিলকে সংসদে এখনও ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে।
সিকিম হিমালয়কে বাঁচাতে ‘তিস্তার বুকে আর একটিও বাঁধ নয়’ এই দাবিতে সিকিমের সংগঠন ‘অ্যাফেক্টেড সিটিজ়েনস অব তিস্তা’ দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তার সদস্যরাও বছরকয়েক আগে দীর্ঘ দিন ধরে অনশন করেছিলেন। সিকিমে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই তিস্তার বুকে তৈরি হয়েছিল অনেকগুলো বাঁধ। বড় বাঁধ যে হিমালয়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তিস্তাকে মেরে ফেলছে, সে দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। লাভ হয়নি কিছু। ফলাফল হল ২০২৩ সালে সাউথ লোনাক লেক বিস্ফোরণ। যার ফলে তিস্তার উপরে তৈরি স্টেজ-৩’র বাঁধটি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। মৃত্যুও হয় বহু মানুষের।
আবার হিমালয়ের বুকে ‘চারধাম প্রকল্প’ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছে বিজেপি-পরিচালিত সরকার, পরিবেশের উপর তার প্রভাবের মূল্যায়ন ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ ছাড়াই। সদ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে কিছু দিন আগে চারধাম প্রকল্পের অধীন যে সিল্কিয়ারা-বারকোট সুড়ঙ্গটি ভেঙে পড়ে, তার নির্মাণকারী সংস্থা ‘নবযুগ এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড’ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৫৫ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে বিজেপিকে। ঠিক এখানেই পরিবেশকর্মীরা সন্দেহের আঙুল তুলছেন বিজেপির দিকে। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০২২ সালে ভূতাপ শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা করা হয় ওএনজিসি-র তরফে। ভূগর্ভে থেকে কিছু বিষাক্ত তরল বেরিয়ে আসায় সেই অনুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ইউরেনিয়াম ও লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেছে লাদাখ অঞ্চলে, যা বিজেপি তুলে দিতে চাইছে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। পরিবেশ-সংক্রান্ত আইন-বিধিকে সংশোধন করে শিথিল করছে।
লাদাখিদের দাবি পূরণের ক্ষেত্রেও উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন ছাড়া আর কিছুই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে আন্দোলন চলবে। ভারতবর্ষ হিমালয়েরই দান। হিমালয় না বাঁচলে ভারতীয় উপমহাদেশ বিপন্ন হবে। সোনম ও তাঁর অনুগামীদের পরিবেশ রক্ষার লড়াই আসলে অগণিত মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy