— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সুন্দরবনের ‘ব্যাঘ্রবিধবা’ মেয়েদের কথা কে না শুনেছে? মধু-কাঠ আনতে জঙ্গলে ঢুকে, বা মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে যে পুরুষরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীদের অসহায়তা দেশ-বিদেশের মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তুলনায় আড়ালে রয়ে গিয়েছেন সমুদ্রবিধবারা। ‘সমুদ্রবিধবা’ যদিও সরকারি ভাবে স্বীকৃত কোনও বিভাগ নয়, তবু যাঁদের স্বামীরা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেননি, সেই মেয়েরা সুন্দরবন অঞ্চলে ওই নামে পরিচিত। আবহাওয়া পূর্বাভাসের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা আগের থেকে অনেক ভাল হয়েছে, তবু সুন্দরবনের ব্লকগুলোতে সমুদ্রবিধবাদের সংখ্যা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, দাবি মৎস্যজীবীদের সংগঠনগুলির। তার কারণ, আগের থেকে বেশি মৎস্যজীবী সমুদ্রের আরও ভিতরে ট্রলারে চেপে মাছ ধরতে যাচ্ছেন।
এক সময়ে সুন্দরবন ছিল মাছেদের স্বর্গরাজ্য। কয়েক পুরুষ ধরে এখানকার নদী-উপকূলের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন মৎস্যজীবীরা। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে মাছ শুকোনোর জন্য অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তৈরি হত জায়গা, বা ‘খটি’। এক সময় খটিগুলোতে মাছের অভাব হত না। কিন্তু গত বছর তিনেক মাছের অভাবে খটিগুলো প্রায় ফাঁকা। কারণ, সমুদ্র জুড়ে শুরু হয়েছে ‘ট্রলিং’। নব্বইয়ের দশক থেকেই ট্রলিং শুরু হয়েছিল, তবে তা ছিল সমুদ্রের নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে। এখন সেই সব নিয়মকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না বড় ট্রলার-মালিকেরা। গভীর সমুদ্রে মাছ কমে যাওয়ায় অগভীর সমুদ্র, অর্থাৎ তীরের কাছাকাছি চলে এসেও ট্রলিং করছেন। কাজেই ছোট মৎস্যজীবীরা মাছ পাচ্ছেন না। তাঁদের বড় জাল নেই, বড় নৌকা নেই। উপকূলে মাছ না পেয়ে তাঁরা গভীর সমুদ্রে যেতে বাধ্য হন, এবং ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে পড়ে প্রাণ হারান।
‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ চালু হওয়ার পর খটিগুলোতে স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও কোস্ট গার্ডেরা আগের চেয়ে সক্রিয় হয়েছেন অনেক। ফলে, মৎস্যজীবীর সুরক্ষার ব্যবস্থা আগের থেকে বেশি। তবু অসহায় মেয়েদের মুখ দেখা যায় উপকূলবর্তী নানা গ্রামে। রুম্পা, চন্দা, পিয়ালি বকখালির ‘সমুদ্রবিধবা’। এঁদের স্বামীরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, কেউ বা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। অকাল বৈধব্যের পরে এই মেয়েরা ব্লক অফিস থেকে সরকারি ভাবে এক লক্ষ টাকা সাহায্য পেতে পারেন। অনেকে টাকা পেয়েছেন, অনেকে পাননি। সমুদ্রে মৃত ব্যক্তির মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র না থাকলে সরকারি সাহায্য পেতে সমস্যা হয়। আর দ্বিতীয় কারণটি সামাজিক ব্যাধি। স্বামীহারা মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি তাঁকে কোনও সরকারি অফিসে যেতে দেয় না। বধূর হাতে টাকা আসুক, তা তারা চায় না। টাকা শ্বশুরের পরিবারই কাছে রাখে, স্বামী মারা যাওয়ার পরে বাড়ির সম্পত্তিতেও মেয়েটিকে কোনও ভাগ দিতে চায় না। কালিস্থানের পার্বতী (নাম পরিবর্তিত) বললেন, “শ্বশুর-শাশুড়ি ভাবেন, বাড়ির বৌকে সম্পত্তি লিখে দিলে সে সম্পত্তি বিক্রি করে চলে যাবে। বিধবা হওয়ার পরের দিনই হাঁড়ি ভিন্ন করেছেন ভাশুর। আমি তিন বাড়ি কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। নিজের সন্তানকে প্রাথমিক স্কুলে পড়াচ্ছি। তবুও আমার প্রতি ওঁদের ভরসা নেই।”
অন্তরা (নাম পরিবর্তিত) সাত বছর হল বিধবা হয়েছেন, এখন বয়স ঊনচল্লিশ বছর। সমুদ্রে ট্রলার উল্টে মারা গেছেন তাঁর স্বামী। ওই একই ট্রলারে ট্রলারের মালিক ছিলেন, তিনিও মারা যান। সরকারি সাহায্য অন্তরা পাননি। ট্রলারের মালিক নিজেই মারা যাওয়াতে মালিকের কাছ থেকেও কোনও সাহায্য আসেনি। স্বাচ্ছন্দ্যহীন জীবনে একটাই স্বস্তি, স্বামীর মৃত্যুর জন্য তাঁর ভাগ্যকে দায়ী করা হয় না। অন্তরা বলেন, “আগে আমার বিধবা মায়ের ভাগ্যকে দোষারোপ, পরিবারের লোকেদের নানা গালি দিতে দেখেছি, মাকে সে সব কথা শুনে কাঁদতে দেখেছি। তবে এখন এই সব কথা তেমন কেউ বলে না। আমার শাশুড়িও তো বিধবা। পাড়া-পড়শিদের কাকিমা-পিসিমারাও বেশির ভাগ বিধবা। মেয়েদের উপর তাদের দুর্ভাগ্যের দায় চাপিয়ে দেওয়ার রীতি একটু কমেছে।”
নারায়ণ দাস, কাকদ্বীপ ফিশারিজ় উইডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহ-সভাপতি জানালেন, গত দু’বছরে আট জন মৎস্যজীবী প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের পাঁচ জনের স্ত্রী ব্লক অফিস থেকে সহায়তা পেয়েছেন। বাকিরা পাননি পরিচয়পত্র যথাযথ দাখিল করতে না পারার জন্য।
মেয়েদের এই আর্থ-সামাজিক সঙ্কট বস্তুত এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবিকার সঙ্কটের প্রতি ইঙ্গিত করে। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যেতেই হবে, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। তাঁদের পক্ষে মাছের চাষ করা সম্ভব নয়, যে-হেতু নিজস্ব পুকুর নেই। পুকুর ঠিকা নেওয়ার মতো পুঁজিও নেই। মৎস্য দফতর থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মৎস্যজীবী ক্রেডিট কার্ডে পাওয়া যেতে পারে। সমস্যা হল, রাজনৈতিক চক্রান্তে ও দফতরের গাফিলতিতে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও মৎস্যজীবীরা ক্রেডিট কার্ড পাচ্ছেন না। ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার স্বীকার করেছিলেন, ছোট মাছ চাষিরা পুকুরের স্বত্ব বা ঠিকার কাগজ দিতে পারেন না বলে ব্যাঙ্কগুলি কার্ড দিচ্ছে না। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের বাঁচাতে বিকল্প মাছ চাষের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। উপকূলে ট্রলিং বন্ধ করা দরকার। মৎস্যজীবী ক্রেডিট কার্ডকে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য সহজলভ্য করা প্রয়োজন। তার জন্য সরকারি বিধিকে নমনীয় করতে হবে, চাষিদের সহায়তা করতে হবে। না হলে মাছচাষির প্রাণহানি, আর তাঁদের স্ত্রীদের দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy