পাল্টা: মহিলারা জড়ো হয়েছেন জুতোর মালা নিয়ে, সন্দেশখালি, ৯ ফেব্রুয়ারি। —ফাইল চিত্র।
তেভাগা আন্দোলন, বর্গা আইনের পর ৭৪ বছর কেটে গেছে। বর্গা নথিভুক্তির পরও ৩৮ বছর। ফাল্গুনের কোকিলের প্রথম ডাক, প্রেম দিবস, সরস্বতী পুজো এই সবের নরম আবহ। তারই মধ্যে দাউ দাউ জ্বলছে সন্দেশখালি। সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ আশ্চর্য করে দিয়েছে শহরকে। এলাকার শোষণের ও অত্যাচারের নায়করা দৃশ্যপটের পিছনে যেতেই মাফিয়াদের সম্পত্তিতে আগুন দিয়েছে জনতা। মেয়েরা বেরিয়ে এসেছেন কাটারি-ঝাঁটা-লাঠি নিয়ে। ক্যামেরার সামনে বলছেন তাঁদের উপর নির্যাতনের কাহিনি।
সন্দেশখালিতে যা ঘটছে, তা এক দিনে হয়নি। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সামান্যতম সহানুভূতি পেলে এ কথাগুলি অনেক দিন আগে বেরিয়ে আসত। এখন সাধারণ মানুষ যে প্রতিরোধ তৈরি করেছেন, তা হল ‘মরিয়ার মুখে মারণের বাণী’। উপকূল-ঘেঁষা ভেড়ি অঞ্চল। দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরে। বাংলার মাছের উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ হয় ভেড়িতে। চিংড়ি চাষের বেশি লাভের লোভে ভেড়িগুলি হয়ে উঠছে অগ্নিগর্ভ। ১৯৪৬-৫০ সালে দরিদ্র ভাগচাষিদের সংগঠিত করেছিল যে তেভাগা, তার মূল ক্ষেত্রই ছিল বাদা অঞ্চল, যা এখন অংশত ভেড়ি এলাকায় পরিণত হয়েছে। কাকদ্বীপ যদিও ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র, সন্দেশখালি, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্রসংলগ্ন অঞ্চলে নিজেদের ফসলের ন্যায্য ভাগ পেতে ছোট চাষি কৃষকসভার নেতৃত্বে মরণপণ লড়েছিলেন।
তখন এ সব ছিল ধানের জমি। যখন থেকে মাছের রফতানি বাজারের কল্যাণে দাম বাড়ল চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের, চাষের জমি ভেড়িতে পরিণত হতে থাকল। অতীতেও ভেড়ি অঞ্চল ছিল অশান্তিপূর্ণ, ভেড়ি লুট ঠেকাতে সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের মোতায়েন করা হত। কিন্তু সাধারণ কৃষকের জমিতে জবরদস্তি নোনা জল ঢুকিয়ে চাষের জমি কেড়ে নিয়ে তাকে ভেড়ি বানিয়ে দেওয়া, লিজ়ের পয়সা না দিয়ে জবরদখল ভেড়িতে মাছের চাষ, এ সবই সাম্প্রতিক সময়ের। একটি রফতানি সংস্থা বন্ধ করে তার কোটি কোটি টাকার মাছের দাম আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছে। অর্থাৎ, আমরা ভূমিসংস্কারের উল্টো দিকে হাঁটছি।
সন্দেশখালির মেয়েরা ক্যামেরা সামনে নির্যাতন ও শ্লীলতাহানি, জবরদস্তি পার্টি অফিসে আটক, মাঝরাতে তুলে কাজ করানো ইত্যাদি নিয়ে যা বলেছেন, তা ভয়াবহ। তা বলতে তাঁদের নিশ্চয়ই প্রাণ উঠে এসেছে মুখের কাছে। কিন্তু মেয়েদের উপরে অত্যাচারের ঘটনাগুলিকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা কেবল নিন্দনীয় নয়, অন্যায়ও। এ হল গরিবের শোষণের জন্য শক্তিশালীদের মধ্যে আঁতাঁতের ফল। শ্রেণিসংঘাত। তাই, মেয়েদের উপর অত্যাচার হিসাবে সন্দেশখালির ঘটনাবলিকে দেখলে সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া যাবে না। একে মিলিয়ে দেখতে হবে বাংলার সার্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে।
সন্দেশখালির মেয়েরা বলেছেন, ২০২১-এ তাঁরা লিখিত ভাবে লাঞ্ছনার অভিযোগ করেছিলেন রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসকের কাছে। মিনাখাঁ অঞ্চল থেকে কয়েক বছর আগে নির্যাতনের অভিযোগ এসেছিল। কেউ কান দেননি। আজ যখন পুলিশ বা মহিলা কমিশন বলে যে, মেয়েদের কাছ থেকে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তখন তাঁরা যেন আহ্লাদিত বোধ না করেন। সুন্দরবন অঞ্চলে পুরুষরা বাইরে যান কাজে। মেয়েরাই এখানে মূল শ্রমজীবী শ্রেণি। মেয়েদের উপরে অত্যাচার করলে পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়, তাতে জমি হাতানো সোজা হয়ে যায়। কোনও মেয়েকে পার্টি অফিসে বসিয়ে রাখা, তাঁকে দিয়ে জবরদস্তি কাজ করানো, মজুরি না-দেওয়া, তাঁর জামা ধরে টানা, হাত ধরে টানা— এগুলিও গুরুতর অপরাধ। এই সব অপরাধীকে তাঁরা শাস্তি দিতে পারবেন তো?
যে দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধে সাক্ষীর সুরক্ষা বলে কোনও বস্তুর বালাই নেই, তিন ভাগের এক ভাগ কেসেও অভিযুক্তের শাস্তি হয় না, সেখানে পুলিশবাহিনী সরে গেলে আর বাহুবলীরা এলাকায় ফিরে এলে কী হবে, মেয়েরা ভালই জানেন। সন্দেশখালিতে যদি একটিও যৌন লাঞ্ছনা বা বলপ্রয়োগ, হুমকির ঘটনা ঘটে থাকে, তা আমাদের মাথা হেঁট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
নাবালিকা বিবাহে আমাদের রাজ্য শীর্ষে। অনেক গরিব ঘরে তরুণী মেয়েদের যৌন সুরক্ষার সমাধান মনে করা হয় বিবাহকে, তাতেই মা-বাবার বিবেক পরিষ্কার থাকে, হোক না তা বিয়ের নামে পাচারই। গরিব মা-বাবা পুলিশের কাছে গিয়ে এফআইআর লেখাতে পারেন কি? পারেন না, আপসের পরামর্শ শুনে বা গঞ্জনা খেয়ে ফিরে আসেন। আসলে আইন শৃঙ্খলা যখন ভেঙে পড়ে, তার সবচেয়ে বড় বলি হয় গরিবের জীবন, জীবিকা আর সম্মান। কিন্তু রাষ্ট্রের, সরকারের কিছু সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে। তা হল সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া, তাঁদের শ্রমের মূল্য নিশ্চিত করা। জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ যেখানে জনজাতি ও তফসিলি জাতিভুক্ত, সেখানে এই দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যর্থতা বেদনাদায়ক। পুলিশ-প্রশাসন যখন পার্টির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়, সাধারণ মানুষ তখন বুঝতে পারেন যে, তাঁদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। সন্দেশখালি সেই বাস্তবের ছবি।
আন্দোলনের ফলে সন্দেশখালির সমস্যাগুলি সামনে এসেছে। কিন্তু এর সমাধান করার পথ যেমন দীর্ঘ, তেমনই জটিল। যে সব জমি চাষির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেড়িতে পরিণত হয়েছিল, চাষিরা যার পাট্টা চেয়েও পাননি, সেগুলির পাট্টা দেওয়ার কথা উঠেছে। জমিগুলি চাষিরা ফেরত পাবেন তো? পেলেই বা তাতে আবার চাষ হবে কি? লবণ জলে জমির ফসল ফলানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে কি চাষিরা ক্ষতিপূরণ পাবেন সরকারের কাছ থেকে? যে দুষ্কৃতীরা এখন এলাকার বাইরে, তারা অবশ্যই জামিন পেয়ে ফিরে আসবে। তখন মেয়েদের, আন্দোলনকারী কৃষক ও অন্যদের কী হবে? যে সব লিজ়ের টাকা বাকি রেখেছিল স্থানীয় মাফিয়া, সে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কী করে? যাঁরা জনসংগঠন করেন, তাঁদের উপস্থিত থাকা দরকার গরিব কৃষক-শ্রমিকের পাশে।
মূল সমস্যা নিহিত সন্দেশখালি তথা বাংলার অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায়। সংগঠন ছাড়া নির্বাচনে জেতা যায় না। টাকা ছাড়া সংগঠন তৈরি হয় না। বৈধ পথে যত টাকার সংস্থান করা সম্ভব, তাতে কুলোয় না। নদীর বালি, তীরের মাটি, গবাদি পশু পাচার, জবরদখল ভেড়ির চিংড়ি, অবৈধ ট্রলার— এ সব হল স্থানীয় অর্থ সমাগমের উপকরণ। প্রচুর টাকা আসছে পঞ্চায়েত, জেলায় নানা যোজনায়, তার ব্যয়ে দুর্নীতিও একটি উপার্জনের স্রোত। বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রামাঞ্চলে বেড়ে উঠছে মধ্যস্বত্বভোগী মুনাফাখোর শ্রেণি। এরাই শোষণের উৎস। ভয়ের পরিমণ্ডল তৈরি হচ্ছে এদের হাতে। আবার এরাই রাজ্যে রাজনীতির রক্তবাহী ধমনী জাল।
বাংলার প্রয়োজন বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচি। বছরভর জনসংগঠন করার মতো গণতান্ত্রিক শক্তি। মানুষকে বলতে হবে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পুষ্টিতে তাঁদের অধিকারের কথা। শ্রমের মূল্যের দাবি। শ্রমজীবীর প্রাপ্য সম্মানের কথা। বাংলায় সন্দেশখালি আরও আছে। শোষণের সেই সব অবরোধ মুক্ত করা দরকার। আর প্রয়োজন এই সময়ের কাহিনি নথিবদ্ধ করা। ভবিষ্যতের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy