অধিপ: বুদ্ধের প্রতি হর্ষবর্ধনের শ্রদ্ধা-যাত্রা, শিল্পীর চোখে। উইকিমিডিয়া কমনস।
সপ্তম শতকের গোড়ার দিকের কথা। পুষ্পভূতি শাসিত থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যু হল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হতে চান। এমন সময় খবর এল, মালবের রাজার আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর স্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মার। ভগিনীপতির হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে ছুটলেন রাজ্যবর্ধন, পথেই গুপ্তহত্যার শিকার হলেন, যার নেপথ্যে গৌড়রাজ শশাঙ্ক। হর্ষবর্ধন রাজা হলেন, দিগ্বিজয়ী হলেন। কিন্তু বোন রাজ্যশ্রী নিরুদ্দেশ। শেষে বিন্ধ্যপর্বত-সংলগ্ন অরণ্যে, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করলেন হর্ষবর্ধন।
উপরের বিবরণ মেলে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট-রচিত হর্ষচরিত-এ। এই গদ্যকাব্যের বিষয়বস্তু কাল্পনিক নয়, বাণভট্ট উল্লিখিত অনেক রাজার অস্তিত্বের পাথুরে প্রমাণ আছে। হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত চিনা পর্যটক শুয়ানজাং (হিউয়েন সাং)-ও হর্ষের বোনের প্রতিপত্তি লক্ষ করেছেন। কিন্তু, হর্ষচরিত ঠিক ইতিহাসও নয়, তাতে মিশে আছে হর্ষবর্ধনের পূর্বপুরুষ পুষ্পভূতির এক তান্ত্রিকের সাধনা রক্ষা করতে গিয়ে নাগ শ্রীকণ্ঠের সঙ্গে লড়াই, দেবী ‘শ্রী’-র আশীর্বাদে রাজ্যলাভের মতো কাহিনি-কিংবদন্তিও।
হর্ষচরিত রাজসভার সাহিত্য, গুপ্তযুগ থেকেই যে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল রাজকীয় ক্ষমতার অনুমোদনের অন্যতম অবলম্বন। যেমন, গুপ্ত রাজসভার অধীন সামন্ত বিশাখদত্তের ঐতিহাসিক নাটকগুলি। তাঁর মুদ্রারাক্ষস নাটকের শেষে চন্দ্রগুপ্ত নামক রাজাকে বরাহ অবতারের সঙ্গে তুলনা করে প্রশস্তি দেখে মনে হয় যে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমকালীন তিনি। অথচ মুদ্রারাক্ষস-এর বিষয়বস্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে নন্দবংশের পতন ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থান। আট শতক আগের ঘটনার প্রামাণ্য ইতিহাসরচনা নয়, বিশাখদত্তের উদ্দেশ্য গুপ্ত রাজসভার দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌর্য ইতিহাসের পুনর্গঠন। গুপ্ত রাজসভা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামী হলেও মৌর্যরা ছিলেন প্রতিবাদী ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। মেগাস্থিনিসের বিবরণ বা অশোকের লেখমালা— কোথাওই মৌর্য রাজসভায় ব্রাহ্মণদের বিশেষ প্রভাবের উল্লেখ নেই। কিন্তু মুদ্রারাক্ষস-এ নন্দ-মৌর্য সংঘাত হয়ে উঠল দুই ব্রাহ্মণ মন্ত্রী রাক্ষস ও চাণক্যের বুদ্ধির লড়াই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ বর্ণিত নীতির আদলে চন্দ্রগুপ্তের গুরু ও মন্ত্রী ‘চাণক্য’ চরিত্রটি নির্মাণ করেন বিশাখদত্ত। মৌর্যযুগের কোনও উপাদানে চাণক্যের উল্লেখ নেই, অর্থশাস্ত্রেও (যার রচনাকাল নিয়েও বিতর্ক আছে) কোথাও নেই চাণক্য নামটি। মুদ্রারাক্ষস-এর প্রভাবেই চাণক্য ও কৌটিল্যের অভিন্নতা গেঁথে গেছে জনমানসে।
বিশাখদত্তের দেবীচন্দ্রগুপ্তম্-এর উপজীব্য গুপ্তযুগেরই ঘটনা। মূল নাটকটি অমিল, কিন্তু বিভিন্ন গ্রন্থে উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট, এর বিষয়বস্তু ছিল দাদা রামগুপ্তকে হত্যা করে এবং তাঁর স্ত্রী ধ্রুবাদেবীকে বিবাহ করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যলাভের পটভূমি— দুর্বলচিত্ত রামগুপ্ত শকরাজার হাতে নিজের স্ত্রীকে তুলে দিয়ে আক্রমণ থেকে বাঁচতে চাইলে স্ত্রী-ছদ্মবেশে শক শিবিরে গিয়ে শকরাজাকে হত্যা করেন চন্দ্রগুপ্ত। ধ্রুবাদেবী/ধ্রুবস্বামিনী নানা উপাদানে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রধান স্ত্রী এবং কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্তের মা হিসাবে উল্লিখিত। রামগুপ্তের নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা ও তিনটি জৈনমূর্তির আবিষ্কার তাঁর ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছে। শকদের সঙ্গে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সংঘাতও ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু সত্যিই কি রামগুপ্ত স্ত্রীকে তুলে দিচ্ছিলেন শত্রুর হাতে, না কি ভ্রাতৃহত্যা ও তাঁর স্ত্রীকে বিবাহের মতো বিতর্কিত আচরণের নৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন তাঁর সভাসদ, রামগুপ্তের নেতিবাচক চরিত্রায়ণে?
রাজসভার কবিরা পরবর্তী কালেও যে চরিতসাহিত্য (জীবনী) রচনা করেছেন, তা সাধারণত বড় ভাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ছোট ভাইয়ের রাজা হওয়ার ব্যাখ্যা। চরিতসাহিত্যের রাজনৈতিক, সাহিত্যিক মোড়ক ছাড়িয়ে ইতিহাস-নিষ্কাশনের জন্য তাই প্রয়োজন প্রশিক্ষিত বিশ্লেষণ। দাক্ষিণাত্যের চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি ছিলেন কাশ্মীরের বিলহন। ১০৭৬ সালে ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের দাদা দ্বিতীয় সোমেশ্বরকে সরিয়ে সিংহাসন দখল দৈবনির্দেশের ফল, রাজ্যলোভের নয়— দাবি বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত-এর। দ্বাদশ শতকের পালরাজা মদনপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত-এর উপজীব্য কৈবর্ত নেতা দিব্যর বিদ্রোহে পালরাজাদের আদি বাসভূমি বরেন্দ্রী হাতছাড়া হওয়া, এবং সামন্তদের একজোট করে রামপালের তা পুনরুদ্ধার। নেপথ্যে রয়েছে রামপালের দাদা মহীপালকে অযোগ্য হিসাবে দেখানো, এবং মহীপাল ও শূরপালের অকালমৃত্যুর পর রাজা হওয়া রামপালের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা। যে মদনপালের প্রশস্তি রয়েছে রামচরিত-এর শেষে, তিনিও রামপালের জ্যেষ্ঠপুত্র নন। রামচরিত-এর প্রতিটি শ্লোকে রামপালের পাশাপাশি রামের কাহিনি বর্ণিত। এ যেমন আদর্শ রাজা রামের সঙ্গে রামপালের তুলনা, তেমনই বালী ও রাবণকে বধ করে তাঁদের ছোট ভাই সুগ্রীব ও বিভীষণের রাজা হওয়ার দৃষ্টান্তস্থাপনও।
আবার, সম্পদ, সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, উর্বরতার দেবী শ্রী-লক্ষ্মীর কথা বেদে না থাকলেও ঋগ্বেদের পরিশিষ্ট ‘খিল’ অংশের ‘শ্রীসূক্ত’-তে রয়েছে তাঁর উল্লেখ। রাজৈশ্বর্যের দেবী হিসাবে শ্রী-লক্ষ্মীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে মৌর্য-পরবর্তী যুগের বিভিন্ন মুদ্রায় গজলক্ষ্মীরূপে তাঁর প্রতিকৃতিতে। পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মে বিশ্বাসী গুপ্তদের মুদ্রাতেও লক্ষ্মী উপস্থিত। কিন্তু বৈষ্ণবধর্মে লক্ষ্মীর ভূমিকা বদলে গেছে বিষ্ণুর সেবাপরায়ণা স্ত্রীতে। অনেক সময়ই লক্ষ্মীর সমৃদ্ধিস্বরূপা এবং ভূমিস্বরূপা দুই রূপকে উপস্থাপন করা হয়েছে বিষ্ণুর দুই স্ত্রী শ্রীদেবী ও ভূদেবী হিসাবে। বিষ্ণু যেমন এই দেবীদের স্বামী এবং রক্ষাকর্তা, রাজাও তেমনই রাজৈশ্বর্য (শ্রী) এবং রাজ্যের ভূ-সম্পদ (ভূ)-এর রক্ষক ও উপভোক্তা। বিষ্ণুর সঙ্গে রাজার এই সাযুজ্য হয়ে ওঠে রাজসভার শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নির্মিত বিশাল বরাহমূর্তি এই ধরনের শিল্পের অন্যতম উদাহরণ— বরাহ অবতারে ভূদেবীর রক্ষাকর্তা বিষ্ণু গুপ্তসম্রাটেরই প্রতিভূ। গুপ্তসাম্রাজ্যের এক টালমাটাল সময়ে, রানির সন্তান না হয়েও সামরিক সাফল্যের কারণে রাজা হওয়া স্কন্দগুপ্ত তাঁর মুদ্রায় লক্ষ্মীর স্বামী হিসাবে উপস্থাপিত করেন নিজেকে, ব্যবহার করেন ‘শ্রীপরীক্ষিতবক্ষ’ অভিধা, তাঁর লেখতে দাবি করা হয় বহু প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে তাঁকেই স্বামী হিসাবে বরণ করেছেন স্বয়ং শ্রীদেবী। বিষ্ণু অবতার রামের মতোই রাজা ভূদেবীর স্বামী ও রক্ষক— ভূদেবীর সন্তান লক্ষ্মীস্বরূপা সীতা উদ্ধারের সঙ্গেই তুলনীয় রামপালের বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার। কারণ উভয়েই ‘জনকভূ’, যার অর্থ পিতৃভূমি ও জনকের সন্তান দুই-ই হয়।
চরিত-রচয়িতা হয়েও বাণভট্ট রাজসভার কবিদের তীব্র সমালোচনা করে চেষ্টা করেছেন নিজের নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার। নিজ যোগ্যতার সপক্ষে দিয়েছেন কিংবদন্তি ও বাস্তবতা মেশানো এক বংশপরিচয়। হর্ষবর্ধনের রাজা হওয়ার পক্ষে এনেছেন অসংখ্য যুক্তি— দেবী শ্রী-র ভবিষ্যদ্বাণী ও হস্তক্ষেপ, প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুশয্যায় হর্ষকে রাজ্যশাসনের পাঠদান, রাজ্যবর্ধনের রাজা হতে অস্বীকার। কিন্তু, হর্ষবর্ধনের নিজের লেখতে পূর্বতন রাজাদের মধ্যে রাজ্যবর্ধনের নাম রয়েছে। তাই, রাজ্যবর্ধনের রাজা হতে রাজি না হওয়ার ব্যাখ্যা সন্দেহজনক। রাজ্যবর্ধনের গুপ্তহত্যায় হর্ষবর্ধনও কি ছিলেন সন্দেহের আওতায়? রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারী হিসাবে শশাঙ্ককে তুলে ধরাও বাণভট্টেরই বয়ান। থানেশ্বরের হর্ষবর্ধন কেন ভগ্নিপতির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই মৌখরি-শাসিত কনৌজের সিংহাসনে বসলেন, সে প্রশ্নও থেকে যায়। প্রশ্নের মুখেই সভাকবিরা শ্রী-লক্ষ্মীর আশীর্বাদধন্য যোগ্য শাসক হিসাবে তুলে ধরেন পৃষ্ঠপোষকদের। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা রামপাল হয়ে ওঠেন ভূদেবীর উদ্ধারকারী বরাহ বা সীতা-উদ্ধারকারী রামের সঙ্গে তুলনীয়। হর্ষচরিত-এর আখ্যানের কেন্দ্রে যে নারীর হারিয়ে যাওয়া ও পুনরুদ্ধার, তাঁর নামও কিন্তু রাজ্যশ্রী (রাজ্যলক্ষ্মী)!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy