কূটবৈঠক: প্রেসিডেন্ট মুশারফ আর প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, আগরা, ২০০১
পারভেজ় মুশারফের জীবনাবসান পাকিস্তানের একবিংশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের (২০০১-২০০৮) মূল্যায়ন অনিবার্য করে তুলেছে। মুশারফ নিঃসন্দেহে এক বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্র। স্বাধীন পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুশারফও তাঁর পূর্ববর্তী সেনানায়ক আয়ুব খান ও মুহাম্মদ জ়িয়া-উল-হকের যোগ্য উত্তরাধিকারী।
রাজনীতিতে ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাষী, সুযোগসন্ধানী ও আপসে বিশ্বাসী মানুষের অভাব নেই। সুতরাং এই সব বিশেষণে মুশারফকে অলঙ্কৃত করা অর্থহীন। বরং চারটি দিক দিয়ে তাঁর মূল্যায়ন সম্ভব। প্রথমত, তাঁর শাসনকালে পাকিস্তান গণতন্ত্র থেকে সামরিক শাসনে পরিণত হয়, যা তার পর এক ধরনের মেকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপ নেয়। দ্বিতীয়ত, মুশারফের শাসনকালে ইসলামিক মৌলবাদ শাসনব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিসরে মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল মুশারফের সময় নজিরবিহীন শক্তি সঞ্চয় করে, যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধৰ্ম-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। তৃতীয়ত, মুশারফের শাসনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক, আমেরিকা ও পাকিস্তানের বিপরীতমুখী দাবির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় তৈরি। এক দিকে, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী যুদ্ধে প্রথম সারির রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকান শাসককুলের আস্থাভাজন হওয়ার বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা। অন্য দিকে, ইসলামি শাসনের প্রতি পাক সরকারের অনিবার্য দায়বদ্ধতা, দুই বিপরীতমুখী স্রোত নিঃসন্দেহে যে কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিত। মুশারফ তাঁর মতো করে যে ভারসাম্যের রাজনীতির জমি তৈরি করেছিলেন, তার রাজনৈতিক অপ্রাসঙ্গিকতা ও নিশ্চিত অবক্ষয়ের পরিণতিও সেই অনিশ্চয়তায় নিহিত ছিল। পরিশেষে, মুশারফের আমলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বতন্ত্র বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভারতের প্রতি সে দেশের সরকারের মনোভাব ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। মুশারফের বিদেশনীতির অন্যতম ব্যর্থতার কারণ দূরদর্শিতার অভাব ও লোক-দেখানো বাহবা কুড়োবার প্রবণতা। কার্গিল- এর প্রধান কারিগর মুশারফ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর শাসনকালে ভারতের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানের বিদেশনীতির প্রধান দু’টি লক্ষ্য, আফগানিস্তানের জমিতে তার ভূকৌশলগত আধিপত্য ও ভারতের সঙ্গে যে ভাবে হোক সামরিক ভারসাম্য বজায় রাখা। মুশারফের পক্ষে এই দুই নির্ধারক দিশার পরিবর্তন ঘটানো অসম্ভব ছিল।
মুশারফ ছিলেন প্রথম সামরিক প্রেসিডেন্ট, যিনি সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে ২০০২ সালে নির্বাচনের ডাক দেন, যা ছিল সে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনার আপাতচেষ্টা। অবশ্যই প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতি মুশারফের দায়বদ্ধতা ছিল না; বরং সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও কর্তৃত্বকে কাজে লাগিয়ে, স্থানীয় সন্ত্রাসবাদ-উদ্ভূত পরিস্থিতি ও তার ভীতিকে সক্রিয় ভাবে ব্যবহার করে, এবং তৎকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অস্থিরতাকে ঢাল বানিয়ে মুশারফ ক্রমে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করেন। এক দিকে, সামরিক বাহিনীর নিঃশর্ত সমর্থন, আর অন্য দিকে তালিবানি আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকান জোটের অভিযান, মুশারফের রাজনৈতিক অভিসন্ধির যথার্থ পরিপূরকের ভূমিকা পালন করে।
রাজনীতিতে মুশারফ দ্বৈত পরিচিতির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এক দিকে, তাঁর তুরস্কে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাজাত উদারনৈতিক সত্তা এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ব্রত; অন্য দিকে, পাকিস্তানের উপর নিজের আধিপত্য কায়েম করার অপ্রতিরোধ্য বাসনা। নওয়াজ় শরিফের সরকার ফেলে দিয়ে মুশারফ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনটি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা দেখেন। প্রথমত, তাঁর শক্তির একমাত্রিক উৎস সে দেশের সামরিক বাহিনী। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণযোগাযোগ ও সংবাদমাধ্যম এবং বিচারব্যবস্থার মুশারফ তথা সামরিক শাসনের প্রতি সহজাত আনুগত্যের অভাব তার রাজনৈতিক স্থায়িত্বের পথে নানা অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে বাধ্য। কূটতা ও ষড়যন্ত্রকে হাতিয়ার করে মুশারফ তাঁর পথ নিষ্কণ্টক করেছেন। ফলে, প্রাথমিক ভাবে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি তার বিরুদ্ধ জোটকেই মজবুত করেছেন। বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্ব তাঁর বিরোধীদের একত্র করে তৈরি করে এক মহা-শক্তিশালী জোট। শেষে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
মুশারফের আর একটি অসঙ্গতি ও দ্বিচারিতার ক্ষেত্র ছিল রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ক। ২০০২ সালে, তিনি প্রথাগত রাজনীতিবিদদের উপর নির্ভর করতে শুরু করেন। গোড়ায় মুশারফ পাকিস্তানি পাসপোর্ট থেকে ধর্মের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তি অপসারিত করলেও অচিরেই নিঃশব্দে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহৃত হয়। পাশাপাশি, যে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীকে মুশারফ পুনরুদ্ধার করেছিলেন, মৌলবাদীদের চাপে তিনি তা দ্রুত পরিত্যাগ করেন। সর্বোপরি, তালিবানি আফানিস্তানের পতনের ফলে বহু মৌলবাদী ও উগ্রপন্থী পাকিস্তানের এফএটিএ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানে ধর্মীয় মৌলবাদকে তা অন্য মাত্রা দেয়। ওই সময়ে পকিস্তানের শহুরে জীবনে হয়তো কিছু বাহ্যিক উদারপন্থী জীবনধারা সাময়িক ভাবে ফিরে আসে, কিন্তু পাকিস্তানি গণসংস্কৃতিতে উদার বা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের কোনও স্থায়ী সম্ভাবনা মুশারফ সৃষ্টি করেননি।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ঐক্য বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর ছিল যথেষ্ট চাপ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাবি পূরণে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতা এড়ানো। ১৯৮০-র দশকে তৈরি সামরিক বাহিনী ও ইসলামি শক্তির পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণের কাঠামো আবার নবরূপে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফিরে আসে। মুশারফ না চাইলেও, তালিবানি ইসলামপন্থীদের পাকিস্তানে মূলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়া তাঁর ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতির অনিবার্য ফসল। বেসামরিক নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মৌলবাদী রাজনীতির মোড় ঘোরাতে সক্ষম হত কি না, তা জল্পনাসাপেক্ষ। জ়ারদারি ও তাঁর দল পিপিপি তাঁদের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী পরিচয় নির্মাণে যে ধরনের কঠোর নীতির প্ৰয়োগ প্রয়োজনীয় ছিল তা নিতে পারেননি। নওয়াজ় শরিফের দল আরও বেহাল।
তবে মুশারফের শাসন স্মরণীয় থাকবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। একটা ইংরেজি প্রবাদ বড় লাগসই এ ক্ষেত্রে, ‘টু হান্ট উইথ দ্য হাউন্ডস, অ্যান্ড রান উইথ দ্য হেয়ার’! মুশারফ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক সত্তা ছিল সামরিক দৃষ্টিকোণ নির্মিত। যে দৃষ্টিকোণ বলে, এক দিকে যেমন ভারতের বৈরিতাকে অতিক্রম করা দরকার, অন্য দিকে প্রয়োজন আফগানিস্তানের ভূমিতে নিরঙ্কুশ সামরিক কৌশলগত গভীরতা অর্জন। এই দুই লক্ষের স্বার্থে পাকিস্তান ক্রমাগত সামরিক জোট বেঁধেছে আমেরিকা ও চিনের সঙ্গে। তালিবানের উত্থান হয় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে। আমেরিকার বাহিনীর কাছে তাদের পরাভব পাক রণনীতিতে এক বিরাট ধাক্কা। মুশারফের সামনে আমেরিকার শর্তে জোট করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু, মুশারফ একটা বড় চাল চাললেন। আমেরিকার বাহিনী পাকিস্তানের সাহায্য ছাড়া অসহায়; সেই সাহায্যের পরিবর্তে আখের গোছালেন মুশারফ। প্রত্যাশিত অর্থ সাহায্য ও অনুদান তো পাকিস্তান আদায় করলই, এর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কেও আমেরিকার চাপ অনেকটা কমে এল। মুশারফ এক দিকে পাক বাহিনীকে আফগানিস্তানে তালিবান ও আল কায়দা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সুচতুর ভাবে পরিচালনা করলেন। অন্য দিকে, সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে।
মুশারফের শাসনকালে, একাধিক বার ভারত ও পাকিস্তান, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। মুশারফ এক দিকে ক্রমাগত কাশ্মীরে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে গিয়েছেন। অন্য দিকে, আগরা বৈঠক ও তার পরবর্তী সময়ে মনমোহন সিংহ সরকারের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের চিরস্থায়ী শান্তি নির্মাণের স্বার্থে আলোচনাও চালিয়েছেন।
রাষ্ট্রযন্ত্র কোনও বিপদের আশঙ্কাকে বাস্তব বলে মনে করলে, সেই বিশ্বাসের প্রমাণ অপ্রাসঙ্গিক। গুরুত্বপূর্ণ হল এই উপলব্ধি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অস্তিত্বের ভিত্তি, যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতিপথকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রভাবিত করেছে। পাক অভিজাতরা মনে করেন, সামরিক বাহিনী তাঁদের একমাত্র ভরসা। মুশারফ এই অভিজাত পাকিস্তানি ভাবধারার ফসল। তাঁর রাজনীতির দ্বিচারিতার উত্তরাধিকারের দায়ভার পাকিস্তান আজও বহন করছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy