কথা বলতেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না রণজিৎ গুহ। ফাইল ছবি।
নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লিখতে, এমনকি কথা বলতেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না রণজিৎ গুহ। জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে অল্প কয়েকটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানেই পাওয়া যায় টুকরো কিছু স্মৃতি আর তথ্য: বরিশালের গ্রামের বাড়ি, কলকাতার দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিত্র ইনস্টিটিউশন আর প্রেসিডেন্সি কলেজ। ২০০৯ সালে ক্রিস মানজাপ্রা আর ২০১৮-তে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দেওয়া দু’টি সাক্ষাৎকারে তিনি স্মৃতিচারণা করেন তাঁর ছাত্রজীবনের দিনগুলির। লক্ষণীয় বিষয়, দুই সাক্ষাৎকারেই স্কুল এবং কলেজ জীবনের নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা আর মানুষের উল্লেখ করছেন— তাঁর স্মৃতিজালের জীবনদর্শন যেন তৈরি হচ্ছে তাঁদেরকে আটকে রেখে, আঁকড়ে ধরে। এই টুকরো স্মৃতিচারণকে অনুসরণ করেই যদি খোঁজার চেষ্টা করি তাঁর ভাবনার কিছু সূত্র, প্রতিষ্ঠানের অন্দরমহলে?
আপাদমস্তক প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই মানুষটিকে কোনও স্থানিক গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা অসম্ভব। তবে যিনি গঠনবাদের গুরু, তাঁর কিছু অপরিচিত গঠনসূত্রের বুনট বানানো যেতে পারে, যাতে ব্যক্তি-প্রতিভার আরাধনা বিসর্জন দিয়ে সমষ্টির জোরের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায় আজ— এক নতুন ‘সমষ্টি’র জনক রণজিৎ গুহ-র শততম জন্মদিনে।
সহজ করে বললে, প্রতিষ্ঠানকে যদি বৌদ্ধিক সমষ্টি ভাবা যায়, তা হলে ১৯৩৮-৪২ সালে তেমনই এক সমষ্টির অংশ ছিলেন রণজিৎ গুহ, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সাম্প্রতিক কালে হিন্দু/প্রেসিডেন্সি কলেজের আর্কাইভ-এর নথিভান্ডার তৈরি করতে গিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল আরও গভীর কিছু সূত্র। খুঁজে পেলাম ছাত্র রণজিতের প্রাতিষ্ঠানিক গতিবিধির কিছু চমৎকার নিদর্শন। পেলাম প্রেসিডেন্সির বহুমুখী বৌদ্ধিক ‘সমষ্টি’র ছাপ, রণজিতের চিন্তার উপর।
প্রেসিডেন্সির শিক্ষার কিছু সূত্র পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বই, আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল-এর উৎসর্গবাক্যে। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক সুশোভন সরকারকে। সুশোভন সরকারের অধ্যাপনা এবং গবেষণা ভারতীয় ইতিহাসের একাধিক ধারার সূত্রপাত করেছিল, তৈরি করেছিল অসংখ্য নবীন ইতিহাসবিদকে। এঁদের সম্মিলিত শ্রদ্ধার্ঘ্য এসেজ় ইন অনর অব প্রফেসর এস সি সরকার স্মারক গ্রন্থ। চল্লিশ জন ইতিহাসবিদের লেখায় সমৃদ্ধ এই বইয়ে কিন্তু রণজিৎ গুহের লেখা নেই। বিস্ময়কর, তবে হয়তো বোধগম্য। রণজিৎ-সুশোভন, বা আরও সহজ করে, শুধুমাত্র ইতিহাসের বিষয়গত শিক্ষার তাগিদে রচিত অধ্যাপক-ছাত্রের সম্পর্কের ব্যাকরণে যদি সেই সময়ের কলেজের বৌদ্ধিক সমষ্টিকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়, অপরিজ্ঞান অনিবার্য। সুশোভন যতটা ডুবে থাকতেন ক্লাসের পড়ানোয়, ততটাই মিশে যেতেন অসংখ্য ছাত্র-পরিচালিত আলোচনা-মণ্ডলীতে। বিতর্ক সভা, রবীন্দ্র পরিষদ, ইতিহাসের সেমিনার, এমনকি জিয়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউটেও ছিল তাঁর অবাধ চলাফেরা। রণজিৎ গুহের বিচরণভূমিও ছিল বিস্তৃত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, রবীন্দ্র পরিষদের সম্পাদক ছিলেন তিনি, আর ১৯৪০-এর কলেজ পত্রিকায় মেলে সেই বছরের রবীন্দ্র পরিষদের কার্যকলাপের বিবরণ। সেই সময়কার প্রেসিডেন্সিতে ছাত্রদের সাহিত্য চর্চার জায়গা ছিল রবীন্দ্র পরিষদ। পরিষদের আলোচনা জুড়ে থাকত রবীন্দ্রসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং পরিষদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রবীন্দ্র-সর্বস্ব এ-হেন পরিমণ্ডলে হঠাৎ দেখা গেল চমক। যে বছর রণজিৎ গুহ সম্পাদক, সেই বছর পরিষদে আলোচনা হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরপদ্মানদীর মাঝি। তর্ক হল সাহিত্যে বাস্তবতা, নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, স্থানীয় ভাষার ব্যবহার, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত বিশেষত্ব নিয়ে। আলোচনায় অংশ নিলেন ইংরেজির অধ্যাপক সুবোধ সেনগুপ্ত, গণিতবিদ এবং তৎকালীন অধ্যক্ষ ভূপতিমোহন সেন, ইতিহাসের ডাকসাইটে ছাত্র অমলেশ ত্রিপাঠী এবং আরও অনেকে। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, রণজিৎ গুহের ইতিহাস, দর্শন এবং সাহিত্যের কোলাকুলিতে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম প্রধান চরিত্র। সাক্ষাৎকারেও বার বার এসেছে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ। কিন্তু ৯৬ বছরে এসে, স্মৃতি-কথার সূত্রে রণজিৎ গুহ অকস্মাৎ বলে ওঠেন “লেখার অনেকগুলো প্রজেক্ট মাথায় ছিল। যেমন মানিক বাঁড়ুজ্যেকে নিয়ে একটা বই লেখার ইচ্ছে ছিল।”
ছাত্রদের বিতর্ক-সভার নিয়মিত সভাপতিত্ব করতেন সুশোভন সরকার। ১৯৩০-এর দশক থেকেই দেখা যায় বিতর্ক-সভায় সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জোয়ার। ১৯৪০-৪১’এর দুটো অধিবেশনে তর্কের বিষয় ছিল: ১) গান্ধীবাদ একটি নিঃশেষিত শক্তি এবং ২) সমাজতন্ত্র কখনওই একটি উন্নততর পৃথিবীর জন্ম দিতে পারবে না। দ্বিতীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন রণজিৎ গুহ। বিশাল সংখ্যক ভোটে পরাজিত হয় মোশনটি। সভা শেষ হয় সুশোভন সরকারের বক্তৃতা দিয়ে, যেখানে তিনি নীতি এবং বাস্তবতা দুই দিক থেকে সমাজতন্ত্রের বিচার করেন, এবং সর্বোপরি ছাত্রদের শেখান তর্কের পদ্ধতি। গবেষণা করতে হলে তর্কের পদ্ধতি কী করে প্রয়োগ করতে হয়, তাও শেখাতেন সুশোভন, যত্নসহকারে, ইতিহাসের সেমিনারে। গবেষণায় আগ্রহী ছাত্ররা করত প্রবন্ধ-পাঠ, চলত আলোচনা। এই সেমিনারে ১৯৪১-এই রণজিৎ গুহ পাঠ করেছিলেন হয়তো তাঁর প্রথম মৌলিক প্রবন্ধ, বিষয় ছিল ‘ফরাসী বিপ্লবে সমাজতন্ত্র’। বক্তব্য ছিল: দরিদ্র প্রজার প্রতি সমবেদনা দেখিয়ে থাকলেও, ফরাসি বিপ্লবের চিন্তানায়করা সত্যিকারের সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেননি। রণজিতের ভাবনার ভূয়সী প্রশংসা করে সভাপতি সুশোভন বলেন যে, আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ের ফসল, তাই তাকে ওই সময়ের আদর্শক্ষেত্রের মাপকাঠিতে বিচার করলে, ইতিহাস-ভাবনার পদ্ধতিগত ভুল ঘটবে, যে ব্যাপারে রণজিতের সাবধান হওয়া উচিত। সুশোভনের সাবধানবাণীতে কোথায় যেন প্রতিধ্বনিত হয় ভবিষ্যতের খুব জরুরি কিছু ঐতিহাসিক তর্কের প্রণালী, যা আমরা দেখতে পাই ‘বাংলার নবজাগরণ’ সংক্রান্ত তাঁর নিজের লেখায়, এবং তাঁর ছাত্রের লেখা ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’-এর বিশ্লেষণ-ধারার মধ্যে।
রণজিৎ গুহের ইতিহাস চর্চা যে আসলে কোথাও ভাষা, দর্শন, সাহিত্য, এবং সর্বোপরি ভাষার দর্শনের গঠনবাদী ভাবনা, এ কথা আজ স্পষ্ট। সম্প্রতি তাঁর শতবর্ষ উদ্যাপনে আয়োজিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাচক্রে প্রায় সব বক্তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ প্রসঙ্গ তুললেন। কলেজ সম্পর্কে তাঁর টুকরো কথাগুলিকে ঐতিহাসিক তথ্যের আলোয় সাজালে অবাক হতে হয়। মানজাপ্রাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রণজিৎ গুহ বলছেন, কলেজের বাংলার অধ্যাপক শশাঙ্কশেখর বাগচীর ক্লাসে ‘ভাষা ও ছন্দ’ নামক পদ্যের আলোচনায় তিনি শিখেছিলেন শব্দ, ব্যঞ্জনা ও অর্থের পারস্পরিক সম্পর্ক। শিখেছিলেন ধ্বনির দর্শন, যা নতুন রূপে বিকশিত হয়েছিল ইংরেজির অধ্যাপক অজিত চক্রবর্তীর ক্লাসে, কোলরিজের ‘এনশিয়েন্ট মারিনার’ কবিতার আলোচনার সূত্রে। রণজিৎ গুহ বলছেন, এখান থেকেই শুরু পরবর্তী জীবনে তাঁর রসশাস্ত্র এবং কাব্যতত্ত্বের পাঠ, অভিনবগুপ্তের হাত ধরে।
ব্যক্তিগত স্মৃতি আর কলেজ আর্কাইভ থেকে উঠে আসে আরও অজানা চমকপ্রদ সূত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজের জীবনে, ভাষার দর্শনে তাঁর অন্যতম শিক্ষার কথা, পণ্ডিত গৌরীনাথ ভট্টাচার্যের কাছে, সংস্কৃত ব্যাকরণে এবং ব্যাকরণতত্ত্বে। ওই সময়ে, কলেজের কাছেই, বছর দু’-একের জন্যে রণজিৎ গুহ ভর্তি হন একটি সংস্কৃত টোলে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই সময় জুড়েই গৌরীনাথ কলেজ পত্রিকায় চার কিস্তিতে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম মৌলিক গবেষণা— স্ফোটা তত্ত্ব, ভাষার দর্শন ও পঞ্চম শতাব্দীর ভাষা-দার্শনিক ভর্তৃহরি বিষয়ে।
আসলে এমন করেই তৈরি হয় সমষ্টিগত চেতনার ভিড়। আমরা জানি সুশোভন সরকারের মধ্যে দিয়ে কী ভাবে গুহের কাছে এসে পৌঁছে ছিল ভাবনার ইতিহাস, ইউরোপীয় দর্শন ও আইনের ইতিহাস, যা সব কিছু ভিড় করে ছিল রণজিৎ গুহের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তাক লাগিয়ে দেওয়া বিশ্লেষণে। আজ আবার খোঁজা যেতে পারে এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়ান্ট ইনসারজেন্সি বইতে অতিদেশের ব্যবহার, কিংবা পাণিনির ব্যাকরণের আলোয় কৃষক-বিপ্লবের সাঙ্কেতিক লিপির পাঠে গৌরীনাথের ছায়া। বলাই যায়, যখন রণজিৎ গুহ মিলিয়ে দিতে চাইছিলেন স্যসুর, পাণিনি আর ভর্তৃহরিকে, ভাষাতত্ত্ব আর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তৈরি করতে চাইছিলেন ইতিহাসবোধকে, তার মধ্যে ভিড় করছিল প্রেসিডেন্সির সমষ্টি।
উত্তর-ঔপনিবেশিকতা আর গঠনবাদের অভূতপূর্ব সংযোগে, নিম্নবর্গের চেতনার অনন্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে, ভাষার দর্শনের আয়নায় ক্ষমতার ইতিহাসপাঠে যে রণজিতকে আমরা আজ চিনি, তাঁর ব্যক্তি-মননের আড়ালে যে সমষ্টির বৌদ্ধিক শ্রম, যত্ন আর উদ্দীপনা নিহিত ছিল, এ সব যদি পরতে পরতে খুলে ধরে না দেখি, রণজিৎ গুহকে সত্যি করে ‘পড়তে’ পারব না আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy