অমর: বিড়লা হাউসে শায়িত মহাত্মা গান্ধীর মৃতদেহ। ছবি: সংগৃহীত।
অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ২২ জানুয়ারি— মসজিদ-মন্দির নিয়ে এত দিনের টানাপড়েনের শেষ অবধি একটা সমাধান হল তবে। এই বিবাদ-বিসম্বাদ পিছনে ফেলে এ বার এগিয়ে যাওয়া যাবে। বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিতে তৈরি হওয়া রামলালার মন্দিরে দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিন যাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই প্রবল হিন্দুত্ববাদী, এমনটা ধরে নিলে সহজ হত ঘটনাক্রম ব্যাখ্যা করা, কিন্তু বড় রকমের একটা অতিসরলীকরণও হত। যত জন ভারতবাসী ভাবলেন যে, ২২ তারিখ একটা পর্বান্তর ঘটল, তাঁদের মধ্যে কত জন সচেতন ভাবে সেই পর্বান্তরের চরিত্রের কথা ভাবলেন? কত জন ভাবলেন যে, প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের মন্দিরে মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলে তা পাল্টে দেয় গোটা দেশের চরিত্রকেই? পঁচাত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে, বহু বিচ্যুতি বহু স্খলন সত্ত্বেও ভারতের আত্মায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, সংবিধান প্রথমেই যে ধর্ম-স্বাধীনতা ও ধর্ম-সাম্যের কথা বলে, এই ঘটনা তাকে নস্যাৎ করে দিতে চায়? রাষ্ট্র কারও পক্ষপাতী হলে সবাইকে শাসনের অধিকার হারায়?
কত জন ভারতবাসীর মনে এই সব প্রশ্ন জাগল, সে কথায় না হয় খানিক পরে যাওয়া যাবে। ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রবল সঙ্কটের সম্মুখীন ভারত কি আগে কখনও হয়নি, কখনও কি চূর্ণবিচূর্ণ হয়নি কোনও অলঙ্ঘ্য প্রতীক? হয়েছে তো বটেই— সংবিধান রচনার কাজটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই হয়েছে। আজকের তারিখেই, ১৯৪৮ সালে। সে দিন বিড়লা হাউসের লনে সান্ধ্য প্রার্থনাসভায় যাওয়ার পথে নাথুরাম গডসের পিস্তল থেকে ছিটকে আসা তিনটে গুলি বুকে আর পেটে গেঁথে যায় মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর।
গান্ধীকে হত্যা করার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখিত নয় সে, ৩০ তারিখই থানার হাজতে বসে জানিয়েছিল নাথুরাম। আদালতে বিচারের সময় জানিয়েছিল, গান্ধী হিন্দু স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক, তাই তাঁকে হত্যা করা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৪৪ সালেও দু’বার গান্ধীকে হত্যা করার চেষ্টা করে নাথুরাম, দু’বারই ধরা পড়ে যায়, দু’বারই গান্ধী তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে অসম্মত হন। ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতেই— বিড়লা হাউসেই— গান্ধীর প্রার্থনাসভায় বোমা ছুড়ে মারে মদনলাল পওয়া নামে এক পঞ্জাবি উদ্বাস্তু। তারও অভিযোগ ছিল, গান্ধী কেবলই মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করে চলেছেন। এই জানুয়ারিতেই জীবনের শেষ অনশনে বসেছিলেন গান্ধী— তাঁর তিন দফা আবেদনের দু’টি ছিল যথাক্রমে ভারতীয় হিন্দুদের, ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি। হিন্দুদের তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা ত্যাগ করে তাঁদের সহৃদয় আশ্রয় দিতে; কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছিলেন, ব্রিটেনের থেকে যুদ্ধকালীন স্টার্লিং ব্যালান্স বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ন্যায্য ভাগ অবিলম্বে দিতে হবে পাকিস্তানকে। তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ উদ্বাস্তুদের দল বিড়লা হাউসের সামনে মিছিল করে স্লোগান দিয়েছিল তাঁর মৃত্যুকামনা করে, নাথুরামের গুলিতে তাঁর হত্যার মাত্র কয়েক দিন আগেই।
হিন্দু হয়েও হিন্দুস্বার্থকে গুরুত্ব দেন না, সেই কারণেই কি গান্ধী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রতীক— নিজের ধর্মকে অস্বীকার করার ‘সেকুলার’ প্রকল্পের আদিপুরুষ? সে কথা বলার উপায় নেই: ব্যক্তিজীবনে গান্ধী অতি ধার্মিক, সনাতন হিন্দুধর্মে অবিচলিত নিষ্ঠা তাঁর (এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে: ‘সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে’, আবাপ পৃ ৪, ২৮-১)। তাঁকে ইসলামের প্রধানতম শত্রু, এবং হিন্দু নেতা হিসাবে দেখানোর রাজনীতিও এতই গভীরে প্রোথিত ছিল যে, তাঁর মৃত্যুর পরে পাঠানো শোকবার্তায় পাকিস্তানের কায়েদ-এ-আজ়ম মহম্মদ আলি জিন্না লিখেছিলেন, হিন্দুদের পক্ষে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
দু’পক্ষের মৌলবাদীরাই যাঁকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, এমনকি হত্যা করতে উদ্যত হয়, তাঁর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংশয়াতীত। দেশভাগের আবহে কংগ্রেস থেকে মুসলিম লীগে নাম লেখানো মিয়াঁ ইফতিখারুদ্দিন গান্ধী-হত্যার পর পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছিলেন, “অন্যদের থেকে নিজের জাতির বা গোষ্ঠীর মানুষকে রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছেন, এমন নেতার উদাহরণ অনেক রয়েছে। কিন্তু, নিজের লোকের থেকে ‘অপর’-কে রক্ষা করার ব্রতে প্রাণ দিয়েছেন, এমন উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই। একটি জাতি-পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত কোনও মানুষ অন্য একটি জাতির স্বার্থরক্ষার জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করলেন, মানবতার মৌলিক ধর্মের প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কী হতে পারে?”
এই লোকটিকে মেরে ফেলা গেলেই হিন্দুদের বিপদ কাটে, সে রকমই ভেবেছিল নাথুরাম। যে দেশে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল, আজকের ভারতের চেয়ে সেখানে ধর্মীয় আবেগ কম থাকার কথা নয়— তার সর্বাঙ্গে তখন ধর্মের ভিত্তিতে হওয়া দেশভাগের ক্ষত। দেশের মানুষও কি গান্ধী-হত্যায় ভেবেছিলেন যে, যা হোক একটা সমাধানে পৌঁছনো গেল এ বার? না, তেমনটা ঘটেনি। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে যাঁরা গান্ধীর মৃত্যুকামনা করে মিছিল করেছিলেন, গান্ধী-মৃত্যুর পর তাঁদেরও অনেকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন শোকে— অনুভব করেছিলেন, কী ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেল। দু’বছর আগে নোয়াখালিতে যাঁরা তাঁর শান্তিযাত্রার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন, গান্ধী-নিধনের পর তাঁরাই পালন করেছিলেন অরন্ধন; আফসোস করেছিলেন যে, কেন সময় থাকতে তাঁরা গান্ধীর কথায় গুরুত্ব দেননি। এমনকি, যে হিন্দুত্ববাদীরা এখন নাথুরাম গডসের প্রতি ভক্তির কথা সর্বসমক্ষে বুক ফুলিয়ে বলেন, তার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের পূর্বসূরিরাই প্রাণপণে অস্বীকার করেছিলেন গডসের সঙ্গে আরএসএস-এর সম্পর্কের কথা— নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে যতই বলুন সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা, নাগপুর সে কথা স্বীকার করার সাহস দেখায়নি। কারণ, ১৯৪৮-এর নাগরিকদের সিংহভাগ জানতেন, যে ক্ষতি হল, তাকে পূরণ করার সাধ্য ইতিহাসেরও নেই। সেই ক্ষতি ঘটিয়েছে যারা, তাদের ক্ষমা করা চলে না। গান্ধী-হত্যার পর অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন তাঁর দেখানো সর্বধর্মসমন্বয়ের, অপরের প্রতি সহৃদয় গ্রহণশীলতার পথে হাঁটার। সেই শপথ কত দূর রক্ষা করা গিয়েছিল, সে প্রশ্ন আছে— কিন্তু, গ্রহণশীলতার সর্বোচ্চ প্রতীককে হত্যার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাঁর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ গ্রহণের নাগরিক সচেতনতার তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরেও আর একটা ধ্বংসলীলার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকের মনে হয়েছিল, দু’হাত দিয়ে আগলানো দরকার সেই সহিষ্ণুতার উত্তরাধিকারকে। অক্ষত বাবরি মসজিদের চেয়ে করসেবকদের আক্রমণে ধ্বস্ত কাঠামোটি আরও বেশি করে হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা— এক দল বিদ্বেষী যে অসহ্য অন্যায় করেছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি তার প্রতিকার করবে কী ভাবে? কোনও অজুহাতেই যে পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদ ধ্বংস করা চলে না, সেটা অন্যায়— এই বোধ শুধু ‘সেকুলার এলিট’ মহলে ছিল না, সাধারণ ভাবে ধর্মবিশ্বাসী ভারতীয়দের মধ্যেও ছিল। নেতারাও বিলক্ষণ জানতেন কথাটা। যিনি দেশ জুড়ে রথযাত্রা করলেন, গোটা দেশের হিন্দুদের তাতালেন ইট হাতে অযোধ্যায় যেতে, সেই লালকৃষ্ণ আডবাণীও ৬ ডিসেম্বর-পরবর্তী সময়ে বারে বারেই দাবি করে এসেছেন, মসজিদ ধ্বংস হতে দেখে তিনি নাকি কেঁদেছিলেন। আডবাণী জানতেন, তাঁর পথনির্দেশিকা মেনে যে ঘটনাটি ঘটল,
ভারতের বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত বর্বরতাকে ধর্ম আর অন্যায়কে ধর্মযুদ্ধ বলে ভুল করবে না, এ আশঙ্কা লালকৃষ্ণ আডবাণীর ছিল।
আজ মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার আগে প্রধানমন্ত্রীকে দু’বার ভাবতে হয় না, আসল পর্বান্তর এখানে। তাঁদের রাজনীতির জয়ও এখানেই। এর আগে অবধি ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে আঘাত করত কিছু বিদ্বেষী লোক; বৃহত্তর নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের মুখ চেয়ে থাকত সেই বর্বরতার কলুষ দূর করে ফের সহৃদয় সহাবস্থানের ঈপ্সিত পথে ফিরে আসার জন্য। রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর আশ্রয়স্থল হবে, এমনটাই স্বাভাবিক ছিল বেশির ভাগ মানুষের কাছে। এত দিনে তার থেকে সরে এলেন ভারতের অনেক মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দ্বিধ পক্ষপাত তাঁদের কাছে ভয়ঙ্কর ঠেকল না, একটা মন্দিরের উদ্বোধনে সরকারি ছুটি কারও আপত্তিকর মনে হল না। যাঁরা হিন্দুত্ববাদী নন, যাঁরা এখনও গান্ধী বা নেহরুকে দেশের প্রধান শত্রু জ্ঞান করেন না, তাঁদেরও মনে হল না, রাষ্ট্র এক বার পক্ষপাতের পথ হাঁটলে তার আর ফেরার পথ থাকে না। সেই একমুখী যাত্রা কোন বিপন্নতায় শেষ হবে, ক’জনই বা উদ্বিগ্ন হলেন তা নিয়ে? ভেঙে যা সম্ভব হয়নি, মন্দির গড়ে সেটাই সম্ভব করল হিন্দুত্ববাদ।
নিদারুণ ভাবে গড়া, ভাঙার চেয়েও বড় ধ্বংসস্তূপ, কখনও সখনও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy