অধিকার: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি। ঢাকা, ২০২১ ফাইল ছবি।
আলো জ্বালানোর কায়দা নিয়ে ডিন অব স্টাডিজ়-এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল স্টিফেনের। ডাবলিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসা ইংরেজ মাস্টারমশাই তাঁর আইরিশ ছাত্রের মুখে একটা শব্দ শুনে চমকিত— ‘টান্ডিশ’, ফানেলের মতো একটা জিনিস, যা দিয়ে ল্যাম্পে তেল ভরা যায়। এ শব্দ তিনি জীবনে শোনেননি, তোমাদের আয়ারল্যান্ডে এমন বলে বুঝি? ছাত্রের একটু মনখারাপ হয়, মনে পড়ে যায় তার মাস্টারমশাই আসলে বেন জনসনের দেশের লোক, যে ইংরেজি ভাষায় তারা দু’জন এখন কথা বলছে সেটা তারও আগে তার মাস্টারমশাইয়ের সম্পত্তি, ওঁর মুখে একই শব্দ কত আলাদা শোনায়! ‘ওঁর’ ইংরেজি ভাষাটা ‘তার’ কাছে চিরকাল অধীত, অর্জিত ভাষা হয়ে থাকবে, আপন হবে না কখনও।
নতুন সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে এম এ ক্লাসে যখন জেমস জয়েসের এই উপন্যাস পড়ছি, আমাদের কারও কারও প্রাণেও তখন এ জায়গাটা বেজেছিল। বড় বেদনার মতোই। দক্ষিণ শহরতলি কিংবা আরও দূর থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে ক্লাস করতে আসত যে বন্ধুরা, তাদের এক জন বলেই ফেলল এক দিন, এই যে ইংরেজি পড়ছি, এও তো মনে হয় ক্যানিং থেকে আসা আমার জন্য নয়। ওটা তোদের জন্য— যারা ভাল ভাল ইস্কুল-কলেজে ইংরেজি পড়ে এসেছিস। আমার সঙ্গে তো ক্লাসের অনেকে কথাই বলে না। আমিও বলি না, শেক্সপিয়র বলতে গিয়ে কোথায় ‘স’ বেরিয়ে পড়বে, কী দরকার!
এই অভিমানকে প্রবোধ দেওয়া যায়, দোষ দেওয়া যায় না। যতই বলা যায় যে, ও ভাষাটা আমাদের সবারই অর্জিত, সেই বন্ধুটি যেখানে দাঁড়িয়ে আমরাও দিনশেষে সেখানেই— মাঝেমধ্যে সাহেব পণ্ডিতরা কেউ শহরে এলে তাঁদের মুখে ওই ভাষারই উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গির দাপট আর শব্দভান্ডারের তোড় আমাদেরও চুপ করিয়ে দেয়, সে-ই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?— তবু তার মুখের আঁধার সরে না। তখনই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মনে পড়ে যায়, ভাষা নিয়ে রোজকার জীবনের এই যে আমরা-ওরা, নাগরিক-গ্রাম্য বিভেদের ফাটল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বন্ধুটি, সেই গহ্বর তো বাংলা ভাষাতেও, কত ভাবে, কত জায়গায়! ইস্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে একটি ছেলে পড়তে এল, ‘কোথায় বাড়ি?’ শুধোনোয় যেই না বলেছে ‘আদরার নিকটে,’ আমরা সবাই হেসে কুটিপাটি। ‘নিকটে’ কী রে, কাছে, কাছে বল! অল্পবয়স খুব নিষ্ঠুর হয়, ‘আদরার নিকটে’ প্রায় তার অস্তিত্বের সমার্থক হয়ে গেল আর কী। পদ্মাপার থেকে একটি ছেলে পড়তে এসেছে, সে ছোটকে বলে ‘পিচ্চি’, সরু বা রোগাকে ‘চিকন’, স্বাদু কোনও খাবার খেতে কেমন হয়েছে প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়, ‘খুব মজা!’ এও বাংলা শব্দ, এও বাংলা ভাষা, তবু কিছু কিছু মানুষের মুখে একেবারে অন্য রকম। সেই অপরত্ব অনেক সময়, বলা ভাল বেশির ভাগ সময়েই হয়ে ওঠে হাসির খোরাক— প্রমিত, শীলিত বলে পরিচিত যা, তার কাছে।
অথচ এমনটা হওয়ার ছিল না। একই ভাষার নানা কথ্যরূপে যে সৌন্দর্য, যে শক্তি, তা উদ্যাপনেরই কথা ছিল সব সময়। জেফ্রি বয়কটের ক্রিকেট-ধারাভাষ্যে ইয়র্কশায়ারি টান ততটাই সুন্দর, ফরাক্কার ও পার থেকে শুরু করে গোটা উত্তরবঙ্গের মুখে বাংলা ভাষার সুর যেমন। একই ভাষার বিবিধ বিচিত্রতাকে সামাজিক জীবনে বরণ করে নিলে বাঙালির ভাষাগর্ব সার্থক হত। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাংলার পাশে ‘নোয়াখাইল্যা’ বা ‘সিলটি’ বাংলাকে সমান উৎসাহে স্বীকার করে নিলে, মেদিনীপুর কি গঙ্গাসাগরের বাংলার সঙ্গে রংপুরের বাংলাকে মিলিয়ে দিতে পারলে বুক চিতিয়ে বলা যেত, দেখো আমাদের ভাষার শক্তি, তার গভীরতা। কিন্তু সমাজমনের উৎসাহ না পেলে, স্রেফ ভাষাতাত্ত্বিকের আগ্রহে ভাষা বাঁচে না। এই বাংলা ভাষারা তাই মরমে মরে রইল চিরকাল।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলা ভাষার এই বৈচিত্রকে আমরা স্বীকার তো করলামই না, বরং করে ফেললাম আর এক মহাপাতক, তার প্রমিত প্রামাণ্য রূপটাকেও অনাদরে ঠেলতে ঠেলতে কোণঠাসা করে দিলাম ক্রমশ। বিশ্বায়ন এল, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবও, আর কোন ফাঁকে কেন যে আমরা জাতিগত ভাবে ভাবতে শুরু করলাম এই পাল্টে যাওয়া চার পাশে বাংলা ভাষা দিয়ে জীবন-জীবিকা চলবে না, সেও এক ‘গবেষণা’র বিষয় বটে। ইংরেজির উপরে একটা ঔপনিবেশিক সমীহ আমাদের ছিলই, তার খোয়ারি একুশ শতকেও কাটল না। আমরা ইংলিশ-মিডিয়াম-মুগ্ধ হলাম, বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে কলেজ স্তরে কেউ পড়ার বিষয় হিসাবে বাছলে ভরিয়ে দিলাম বিদ্রুপে, বাংলা ভাষার লেখককে নির্লজ্জ ভাবে শুধোলাম, “এই যে লেখেন-টেখেন, এতে হয়?” ভাষার সঙ্গে অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের প্রশ্নটা জুতে দেওয়ার এই স্বভাব বাঙালি ছাড়া আর কারও আছে বলে জানা নেই, বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে অনেকটা সময় দেওয়া কারও প্রতি তার অবচেতনের তাচ্ছিল্য ধরা পড়ে ওই ‘লেখেন-টেখেন’, ‘গল্প-টল্প’, ‘নাটক-টাটক’এ।
এই যে নিজের ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতাবোধ, তাকে ঢাকাচাপা দিতে কী করণীয়? বহিরঙ্গে তাকে নিয়ে আহাউহু করা। আপাতত বাংলা ভাষা নিয়ে সেই ছেলেখেলাটিই চলছে। তারই এক-একটা রূপ প্রকাশ পাচ্ছে সমাজজীবনে। সমাজমাধ্যম তো ভেসে যাওয়ার জোগাড়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘনিয়ে এলেই কতকগুলো জিনিস ফিরে ফিরে আসে। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ‘বাংলা ভাষার’ লেখকের অন্তিম দুর্দশার কাহিনি, ভাষাগৌরব নিয়ে অতুলপ্রসাদ থেকে শামসুর রাহমানের কবিতা। আবার বাঙালির নিজস্ব আত্মকরুণার বয়ানটিও সদাপ্রস্তুত, ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ ভাইরাল হয় নিয়ম করে। এ দিকে তার রোজকার বেঁচে থাকায় কোন বাংলা ভাষার রাজত্ব? মেট্রোয় ‘অগ্নিশমন যন্ত্র উপলব্ধ’ থাকার ধাক্কা, পাতাভরা বিজ্ঞাপনে গুগল ট্রান্সলেটরের অক্ষম আড়ষ্ট বাংলা অনুবাদ, আম-বাঙালির মুখে ‘কেন কী’-র তুবড়ি। পুরসভার বোর্ড থেকে মেডিক্যাল কলেজের দেওয়ালে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। বানান নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল, ফেসবুকে ভুল বানান শুধরে দিতে গেলে ‘ভাষা নাৎসি’ খেতাব বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শেমিং’-এর অভিযোগ ধেয়ে আসতে পারে, অথবা মূর্খের কুযুক্তি: ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম, ভাবটা বোঝা গেলেই হল, ঠিক-ভুল বানান নিয়ে অত মাথা ঘামানো কেন বাপু!
ভাষা— যার সেতুবন্ধ হওয়ার কথা ছিল, তাকে আমরা করে তুললাম পাঁচিল। সাতচল্লিশ, বাহান্ন, একাত্তর... একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসপর্ব আমাদের সুযোগ দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে তার আঞ্চলিক ও প্রামাণ্য-সহ সকল রূপকে মেলানোর, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বহুস্তরী অন্তররূপটিকে দেখার, বোঝার। আমরা সে সুযোগ নিলাম না, ‘এক ভাষা এক প্রাণ’ বলে প্রত্যেক একুশে ফেব্রুয়ারিতে বুক বাজালাম শুধু, তার পরেই রাগত প্রতিস্পর্ধায় লিখতে বসলাম আমাদেরও তো আছে এক ভাষা আন্দোলন, শিলচরের উনিশে মে! এই ‘বনাম’-এর রাজনীতিই আমাদের ভাষা-বোধের সর্বনাশ করল। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ, দুই ভূখণ্ডের বাংলা ভাষা নিয়ে আজও নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন কিছু মানুষ। এ যে একটা নিবিড় গবেষণার বিষয়, দেখনদারি আর অহমিকা-সর্বস্ব এই সময় তা মানবে কেন। টিভি-সিরিয়াল সিনেমার বিনোদনে তো বটেই, তার কথাসাহিত্যেও তাই আজকাল ‘বাঙাল’ ভাষা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা প্রয়োগের নামে একটা অতিদুর্বল হাঁসজারু হেঁটেচলে বেড়ায়।
কিছুই কি হল না তা হলে? এই হাহাকার রব, অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনাই শেষ কথা? বইমেলায় রেকর্ড ভিড়, রেকর্ড বই বিক্রির খবরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যপ্রেম ফুটে বেরোচ্ছে না বুঝি? উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের রূপকারদের সামনে কোনও ‘লেগ্যাসি’ ছিল না, পথ করে নিতে হয়েছিল সংস্কৃত আর ইংরেজি এই দুই ভাষার প্রবল প্রতাপের মধ্য দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন-কে মাইলফলক ধরলে, তার পর থেকে প্রায় দেড়শো বছরে বাংলা ভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যভাষা যে রং-রূপ-গতি আয়ত্ত করেছে তা শতমুখে বলবার মতো। কত নবীন লেখকের হাতে বাংলা ভাষা ফুল ফোটাচ্ছে— কবিতায় কথাসাহিত্যে প্রবন্ধে, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালির মনে। এও ভাষার খিদমতগারিই বটে, তবে সঙ্গে এটাও মনে রাখার— ভাষা শুধু লেখক-কবি-গবেষকের চর্চার বিষয় নয়, সাহিত্যের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ না-থাকা মানুষটির কাছেও তার কিছু দাবি আছে। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বা একষট্টির উনিশে মে তারিখগুলো ইতিহাস হয়ে আছে, সে দিন নিতান্ত সাধারণ মানুষেরা বাংলা ভাষার দাবিতে এগিয়ে এসেছিলেন বলেই। আজকের বাঙালির কাছেও বাংলা ভাষা সেই নিরাপত্তা, আশ্রয়টুকু প্রার্থনা করছে। আমরা কি তাকে সেই আশ্রয় দেব, না কি করে তুলব নিজভূমে উদ্বাস্তু?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy