Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
Sagardighi By Election

সংখ্যালঘুরা বিমুখ কেন

২০২১ সালে জয়লাভের পর মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতরের ভার দিয়েছিলেন এক অপেক্ষাকৃত ওজনহীন মন্ত্রীর হাতে। এর ফলে সংখ্যালঘু উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যায়।

An image of Minority Protest

২০১১ সাল থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পিছনে সংখ্যালঘু ভোটের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ফাইল চিত্র।

সাবির আহমেদ
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৩ ০৪:৩৬
Share: Save:

সাগরদিঘির উপনির্বাচনের পরাজয়ে কি মুখ্যমন্ত্রী সিঁদুরে মেঘ দেখলেন? ২০১১ সাল থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পিছনে সংখ্যালঘু ভোটের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সাগরদিঘির হার যে দুশ্চিন্তার কারণ, ক্ষত উপশমে মুখ্যমন্ত্রীর বেশ কিছু পদক্ষেপ থেকে তা বোঝা যায়— যেমন, দলের সংখ্যালঘু মন্ত্রীদের নিয়ে হারের কারণ খুঁজতে কমিটি গঠন, সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্তনিগমের চেয়ারম্যান বদল থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতর মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া।

সাগরদিঘি উপনির্বাচনে শাসক দলের হারের কিছু স্থানীয় কারণ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু অনুমান করা চলে, মুখ্যমন্ত্রী টের পেয়েছেন যে, রাজ্যের বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের কারণ শুধুমাত্র ‘স্থানীয়’ নয়। কারণগুলোর খোঁজ করা যাক। প্রথমত, ২০১৪-য় রাজ্যে বিজেপির প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে শাসক দলের ‘নরম হিন্দুত্ব’-এর আঁচও পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য মাত্র দু’বার ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল, অথচ ২০১১ সালের ইস্তাহারে প্রায় দু’পাতা ব্যয় করা হয়েছিল এই প্রসঙ্গে।

২০২১ সালে জয়লাভের পর মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতরের ভার দিয়েছিলেন এক অপেক্ষাকৃত ওজনহীন মন্ত্রীর হাতে। এর ফলে সংখ্যালঘু উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যায়। যদিও সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতরের বাজেট কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটকে ছাপিয়ে গেছে। রাজ্যের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতরের বাজেট প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে পড়ুয়াদের স্কলারশিপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ করে দেশের প্রথম সারিতে। অথচ, স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার জন্য একটা চাপা ক্ষোভ গত দু’বছরে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া রাজ্যে ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’ প্রকল্প শুরু হওয়ায় সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ‘শিক্ষা লোন’ বন্ধ করে দেওয়া হয়, এতে হাজার হাজার পড়ুয়া অসুবিধায় পড়ে, কারণ সংখ্যালঘুরা সহজে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পান না।

স্কলারশিপ ছাড়াও রাজ্য সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত অন্য প্রণোদনার ফলে ও রাজ্যের মিশন স্কুলের অবদানে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে মেয়েদের শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে। তথ্যের অভাব থাকলেও সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিয়ে কিছু বিষয় খুব মোটা দাগে দেখা যাচ্ছে। অতিমারির কারণে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যখন রাজ্যে ফিরছিলেন, দেখা গেল রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেরা এই দলের মধ্যে সিংহভাগ। রাজ্যে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষায় উন্নতি আশাপ্রদ হলেও কাজের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ একেবারে আণুবীক্ষণিক, এমনকি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত কিছু কাজ, যেমন— আশাকর্মী বা অঙ্গনওয়াড়ি কাজেও জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নেই।

অথচ এই ব্যাপারে একটু উদ্যোগ করে পিছিয়ে পড়া সামাজিক গোষ্ঠীর মেয়েদের ও পরিবারের এক বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা ছিল। অন্য দিকে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেদের স্কুলছুট হয়ে যাওয়া যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের, বিশেষ করে ছেলেদের, স্কুলছুট রুখতে রাজ্যে মুসলমান সংগঠনগুলোর প্রস্তাব অনুসারে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় ইংরেজি মাধ্যম আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রস্তাব সরকার বিবেচনার মধ্যে আনছে না।

লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের একটা বড় অংশ ওবিসি হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার ফলে কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে বলে ভাবা হয়েছিল। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ওবিসি সংরক্ষণ নীতি মানা হচ্ছে না। ওবিসি সংরক্ষণের ফলে মুসলমানদের কর্মসংস্থানেও কিছু উন্নতি হয়েছে কি না, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না— কারণ সরকার কত মানুষকে ওবিসি শংসাপত্র দিয়েছে এই মর্মে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তবে ওবিসি সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে কত জনের কর্মসংস্থান হয়েছে, এ ব্যাপারে কিছুই জানা যায় না।

নির্বাচনী গবেষণায় দেখা যায় যে, ভোটার হিসাবে মুসলমান মেয়েরা দিদির পাশেই ছিলেন, অথচ এই রাজ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় প্রকল্প ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর ভাতার ক্ষেত্রে তাঁদের আর্থিক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। রাজ্যের মুসলমান মেয়েরা এ নিয়ে অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন।

রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে ভাটা পড়েছে। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়লাভের সঙ্গে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের হার বৃদ্ধি পায়। ২০০৬ সালের বিধানসভায় মুসলমান বিধায়ক ছিলেন ৪৪ জন, ২০১১ সালের নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬১ জনে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৫৩ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী মনোনীত করে, এর মধ্যে ৩১ জন বিধানসভায় প্রবেশ করেন। ২০২১ সালে তৃণমূলের সংখ্যালঘু প্রার্থী কমে দাঁড়ায় ৪২ জন, এর মধ্যে ৪১ জন জয়ী হয়েছিলেন। জোট প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র নৌশাদ সিদ্দিকি জয় লাভ করেন।

এর ফলেই সংখ্যালঘু দফতরের বিপুল বাজেট বরাদ্দ সত্ত্বেও সরকারের চিন্তাভাবনা ও বিশেষত মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটা ফাঁক তৈরি হয়ে গিয়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা দফতরের ভার নিজের হাতে নিলেন। এতে কি সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা ফিরবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Sagardighi By Election minorities Minority votes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE