দাবি: মণিপুরে সংঘর্ষের আবহে রাজধানীতে মণিপুরি ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ মিছিল, দিল্লি, ৫ মে। ছবি: পিটিআই।
গত এক সপ্তাহ মণিপুরে যে ভয়ানক হিংসা চলছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তা তাঁকে কত গভীর ভাবে আহত করত, আন্দাজ করা কঠিন নয়। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মণিপুর রাজ্যে তিনি কখনও যেতে পারেননি, তবে সিলেটের কাছে একটি গ্রামে মণিপুরি রাসলীলা দেখে (১৯১৯) এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন, যে এই নৃত্যধারা নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে। সেখান থেকে বিশ্বের মঞ্চে স্থান করে নেয় মণিপুরের রাস। তাঁর বিখ্যাত নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা মণিপুরের বীরাঙ্গনা রাজকন্যা আর অর্জুনের প্রেমকে ঘিরে এক অসামান্য কল্পকাহিনি। কিন্তু মণিপুর যে এক দিন রচনা করবে তার নিজের কুরুক্ষেত্র, এ কথা হয়তো কবির কল্পনাতেও আসেনি।
মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে যে তীব্র সংঘাত দেখছে আজকের মণিপুর, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তার নজির বেশি নেই। ১৯৪৯ সালে মণিপুর রাজত্ব স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে এই প্রথম এমন হিংস্র আক্রমণের ঘটনা দেখা গেল। কয়েক দিনের হিংসায় অন্তত পঁয়ষট্টি জন প্রাণ হারিয়েছেন, তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষ আহত হয়েছেন। ঘর পুড়েছে, গাড়ি জ্বলেছে, চার্চ আর মন্দিরে আগুন ধরানো হয়েছে। ইম্ফল উপত্যকার বাসিন্দা মেইতেই, আর পাহাড়ে বাসরত কুকি জনজাতিদের সম্পর্ক বরাবরই ছিল ভঙ্গুর, সমস্যাসঙ্কুল। এখন প্রশ্ন, সে সম্পর্ক কি আর কখনও জোড়া লাগবে? কেবল মণিপুর নয়, গোটা ভারতের জন্যই এই প্রশ্ন জরুরি।
মেইতেই আর কুকিদের মধ্যের দীর্ঘ দিনের বিরোধের কারণ বুঝতে হলে তাকাতে হবে মণিপুরের ভূগোলের দিকে। রাজধানী ইম্ফল এক সমতল উপত্যকা, যেন এক বিশাল ফুটবল মাঠ। তাকে গ্যালারির মতো ঘিরে রয়েছে পর্বতশ্রেণি, দূর থেকে দূরান্তে তার বিস্তার। মেইতেইরা রাজ্যের জনসংখ্যার তিপ্পান্ন শতাংশ, তারা অধিকাংশই থাকে ইম্ফলে, যা অতীতে ছিল তাদের রাজার শাসনাধীন রাজস্ব। মেইতেইরা প্রায় সকলেই হিন্দু। মণিপুরের জনসংখ্যার পঁয়তাল্লিশ শতাংশ হল নাগা আর কুকি জনজাতি, তারা প্রধানত পাহাড়ে থাকে, এবং অধিকাংশই খ্রিস্টান। মেইতেই আর জনজাতির মানুষদের মধ্যে প্রধান সংঘাত হল জমি নিয়ে। রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যেখানে থাকে, সেই ইম্ফল উপত্যকা হল রাজ্যের জমির মাত্র দশ শতাংশ। বাকি নব্বই শতাংশই হল পাহাড়। জনজাতির জমি যে হেতু অন্যদের বিক্রি করা নিষিদ্ধ, তাই মেইতেইরা চিরকালই বঞ্চিত বোধ করেছে। ও দিকে নাগা বা কুকিদের ইম্ফলে জমি কিনতে বাধা নেই, এবং তারা তা কিনেও চলেছে। ফলে মেইতেইরা মনে করছে, তারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ছে।
বছর দশেক আগে মেইতেইদের মধ্যে একটি অংশ জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতির দাবি তোলে। তারা কেন্দ্রীয় জনজাতি মন্ত্রককে আর্জি জানিয়ে চিঠি দেয়। কেন্দ্র সে চিঠি পাঠিয়ে দেয় মণিপুর সরকারকে, কারণ নিয়ম অনুসারে জনগোষ্ঠীর পরিচয় পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া রাজ্য সরকারকেই শুরু করতে হবে। রাজ্য সরকার বিষয়টি কার্যত চাপা দিয়ে দেয়। মেইতেই আবেদনকারীরা তখন আদালতের দ্বারস্থ হয়। ২৭ মার্চ মণিপুরের হাই কোর্ট এই মামলার রায় দেয়। ১৯ এপ্রিল সেই রায় ওয়েবসাইটে আপলোড হওয়ার পরেই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে।
ওই রায়ে কী বলা হয়েছে, তা-ও স্পষ্ট নয়। আদালত কি রাজ্য সরকারকে বলেছে, মেইতেইদের জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতির প্রশ্নে রাজ্যের সুপারিশ কী, তা চার সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রকে জানাতে হবে? না কি বলেছে, মেইতেইদের জনজাতি হিসাবে স্বীকার করার সুপারিশ করা হোক কেন্দ্রের কাছে? সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে জানিয়েছে, দ্বিতীয়টি বলার এক্তিয়ারই নেই হাই কোর্টের।
মোট কথা, মেইতেইরা যদি জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পায়, তা হলে তারা পাহাড়ে জমি কিনতে পারবে, এবং স্কুল, কলেজ, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ পাবে। ফলে কুকিদের সব দিক থেকেই অনেক তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে, জমিও হারাতে হবে। একেই গত নভেম্বর থেকে কুকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে, কারণ বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের নির্দেশে আটত্রিশটি গ্রামের মানুষকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। কুকি-অধ্যুষিত চুরাচাঁদপুর জেলার ওই গ্রামগুলি ছিল সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যে। সরকারের অভিযোগ ছিল, মায়ানমারে সংঘাতের জেরে সীমানা পেরিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জায়গা করে দেওয়ার তাগিদে কুকিরা অরণ্যে ঢুকে নতুন নতুন জনবসতি তৈরি করছে। মায়ানমার সীমানার ওপারে বসবাস করে চিন জনজাতি, যাদের সঙ্গে কুকিদের দীর্ঘ দিনের আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই জনজাতিদের মধ্যে পারস্পরিক আনুগত্য খুবই গভীর। কুকিদের ক্ষোভের আর একটি কারণ, এন বীরেন সিংহের সরকার মণিপুরের পাহাড়ে আফিম চাষের উপরে লাগাম টানার চেষ্টা করেছে। কুকি এবং মায়ানমারের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা মাদক পাচার চক্রকে কাঁচামাল জোগান দিচ্ছে, এই অভিযোগ তুলেছে সরকার।
গ্রাম থেকে বিতাড়িত, ক্ষিপ্ত কুকিরা ১০ মার্চ প্রথম ইম্ফলের রাস্তায় প্রতিবাদ করে, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জনজাতির বিরোধিতার অভিযোগ তোলে। সেই আগুনে ঘি ঢালে মণিপুর হাই কোর্টের রায়। মেইতেইরা জনজাতি বলে ঘোষিত হতে পারে, এই সম্ভাবনায় কুকিদের মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। বিশেষত ৩ থেকে ৫ মে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে মণিপুর। ইম্ফলে মেইতেইরা কুকিদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, পাহাড়ে কুকিরা আক্রমণ করে মেইতেইদের। দু’পক্ষই লাগামছাড়া হিংসায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
এই তীব্র উত্তেজনার মধ্যে কোনও পক্ষ না নিয়ে নীরব ছিল নাগা জনজাতি, যারা মণিপুরের পাহাড়ে বাসরত জনজাতির এক বড় অংশ। কিন্তু কত দিন তারা চুপ করে থাকবে, সেটাই প্রশ্ন। নাগা আর কুকি, অথবা নাগা আর মেইতেই, কারও মধ্যেই সম্পর্ক খুব মধুর নয়। নাগা চরমপন্থী সংগঠন এনএসসিএন (আইএম) ভারত সরকারের কাছে বৃহত্তর নাগা রাজ্য দাবি করেছে। তাদের ‘নাগালিম’ মানচিত্রে মণিপুরের পাহাড়ের কিছু অংশও রয়েছে। কুকি বা মেইতেইরা তা মানতে রাজি নয়। তবে কুকি-মেইতেই বিরোধের পরে এখন বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নতুন কোনও সমঝোতা হয় কি না, তা-ও দেখতে হবে।
এর মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করেছে মিজ়োরামেও। মিজ়োরাও কুকি-চিন-জ়ো জনজাতি গোষ্ঠীর সদস্য। মায়ানমার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের শিবির রয়েছে তাদের রাজ্যে। মেইতেইদের একটি বড় অংশ বসবাস ও জীবিকা নির্বাহ করে মিজ়োরামে। সে রাজ্যে রাজ্যসভার এক সাংসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে সতর্ক করেছেন— যদি মণিপুরের জনজাতিদের সঙ্গে অবিচার হয়, তা হলে মিজ়োরামে মেইতেইরা শান্তিতে থাকতে পারবে, এমন গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না।
মেইতেইরা জনজাতি স্বীকৃতি পাবে কি না, সেই প্রশ্নটি এখন সুপ্রিম কোর্টে, শুনানি হবে ১৭ মে। কিন্তু কেবল আদালত মণিপুরের এই সঙ্কটের সমাধান করতে পারবে, এমন আশা করা বাতুলতা। মেইতেই এবং কুকি, দু’পক্ষকেই শান্তির জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ, আবার হিংসা ছড়ালে তা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই অস্থিরতা ছড়াতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy