রমাপদ চৌধুরী। ফাইল চিত্র।
বাংলা সাহিত্যের সুবিপুল সম্ভারে একেবারে নিজস্ব ভাষা, শৈলী ও পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠা সহজ নয়, কিন্তু রমাপদ চৌধুরী সম্পূর্ণ নিজের সাহিত্য রচনা করতে পেরেছেন। তাঁর লেখায় পূর্বতন বা সমসাময়িক, কারও লিখনরীতির প্রভাব নেই।
সম্ভবত সংস্কৃত ভাষা, নাটক ও কাব্যপ্রভাবে বাংলা কাব্যসাহিত্য খানিক অলঙ্কারবহুল। ইংরেজিতে সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে পুরনো ক্লাসিক রচনার প্রতি এক রকম মোহময় মর্যাদা থাকার কারণেও বাংলা সাহিত্যে ভাষার কৃৎকৌশল চর্চার বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র যে বাংলা গদ্যে উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন, রবীন্দ্রপর্বেই তার বহুল পরিবর্তন ঘটেছে। সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্তি ঘটাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছেন। নিজস্বতা নির্মাণের উদ্যোগে কেউ ভাষার ভার বৃদ্ধি করেছেন, কেউ আবেগপ্রধান রচনায় প্রয়াসী, অনেকে জটিল বাক্যগঠন বা যতিচিহ্নের ব্যবহারে নতুনত্ব দেখাতে চেয়েছেন। সেই নিরিখে, প্রথম থেকেই রমাপদ চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসের ভাষা বাহুল্যবর্জিত, নির্মেদ।
তাঁর লেখার ধরনেও কোনও দেখানেপনা নেই। যে ভাষা ভাবনার, যে ভাষা রোজকার জীবনে প্রয়োজনীয় লেনদেন সম্পন্ন করে, তিনি তাকেই বরণ করেছেন। সহজ গদ্য তাঁর, ভাষা ও শৈলীর সারল্যে তাতে তৈরি হয়েছে এমন এক গমনভঙ্গিমা যাকে নাতিবৃহৎ কিন্তু ভরানদীর প্রবাহ বলে মনে হয়। সেই গদ্যে আছে গভীরতা, নাব্যতা, স্বচ্ছতা; পাল তোলা নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জলজ বাতাস। গতি।
সাহিত্যের পাঠযোগ্যতার পক্ষে ভাষার সহজতা ও শৈলীর বোধগম্য নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। আবার দুরূহ ভাষার মধ্যে, বাক্যগঠনের জটিলতার মধ্যে যদি বিষয় মিলিয়ে দেওয়া যায়, তা হয়ে দাঁড়ায় অবিস্মরণীয় কাব্য বা সাহিত্য, যেমন বঙ্কিম সাহিত্য অথবা মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য। সাহিত্যে সরল জটিল দুই-ই বরণীয়, কিন্তু সে পাঠকের দৃষ্টিতে। সাহিত্যিককে বার বার এসে দাঁড়াতে হয় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত নির্বাচনের সামনে— যিনি সাহিত্য রচনা করবেন একমাত্র তিনিই উপলব্ধি করতে পারেন, কোন ভাষা তাঁর বিষয়ের সঙ্গে মানানসই। খরস্রোতা, কঠিন পাথরে নির্ভয়ে আছড়ে পড়া দুরন্তবাহিনী নদীর মতোই হোক কিংবা শান্ত প্রবাহিণী, শেষ পর্যন্ত ভাষা ও শৈলীর সম্বন্ধকে হয়ে উঠতে হবে সার্থক। সাহিত্যিক যা দেখছেন, উপলব্ধি করছেন, যতটুকু যে ভাবে বলতে চাইছেন তার পূর্ণ প্রকাশ।
এখানেই রমাপদ চৌধুরীর সহিষ্ণুতা ও সংযম। তাঁর বৈশিষ্ট্য। এই দিকটি বিশ্লেষণ করতে গেলে অবশ্য উল্লেখ্য, রমাপদ চৌধুরীর জীবনে পারিপার্শ্বিকতা। ১৯২২-এ জন্ম, তিনি দেখছেন ভারত ও বিশ্ব-রাজনীতির নিয়ত পরিবর্তনশীল ঘটনাগুলি। দেখছেন স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসীর সংগ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলার দুর্ভিক্ষ, ভারতের বিভাজন, শরণার্থীর ভিড়, সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের হাহাকার, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আমরণ যুদ্ধ। হতাশ, অসহায়, ক্লান্ত, ব্যথাতুর মানুষ।
তাঁর লেখায় এই সব মানুষের কথা, নিটোল ঘটনার বুনোটে। তাঁর গভীর বোধ সাহিত্যরচনার প্রকরণ নির্বাচনে ছিল নির্ভুল। যে জীবনের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, যে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সুখ-অসুখের কথা বলেছেন, সেই সব মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের বেঁচে থাকা ওই বাহুল্যবর্জিত ধরনেই পাঠকের হৃদয় জয় করেছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত অকালে বিগতযৌবনার অঙ্গে বহুমূল্য রত্ন যেমন বেমানান, তাঁর রচনায় কথার ফেনিলতাও তেমনই হত।
দেখার চোখ বড় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তাঁর। তাই লিখতে পেরেছেন দ্বীপের নাম টিয়ারং, আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া, বাড়ি বদলে যায় অথবা অভিমন্যু। তাঁর শতাধিক গল্প ও পঁয়তাল্লিশটি উপন্যাস এক বার পড়ে মুখ ফিরিয়ে রাখার নয়, কারণ, বাস্তবের যে কঠোরতা তিনি দেখেছিলেন, তাঁর মধ্যেকার সাহিত্যরস সে সবে জারিত হয়ে সৎ, বিশ্বস্ত ও বাস্তববাদী গল্প-উপন্যাস রচনা করেছে নিরন্তর। এমনকি লালবাঈ উপন্যাস লেখার মধ্যেও শুধু ললিত প্রেমের কথা বুনে তোলার কোনও প্রয়াস ছিল না তাঁর, বরং, ইতিহাস-সচেতন চিন্তক হিসেবে নিজের সাহিত্যপ্রতিভার সার্থক প্রয়োগ করেছেন।
এই ইতিহাসচেতনা, রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে তীব্র দৃষ্টি তাঁর প্রতিটি রচনায় সময়ের চিহ্ন রাখে। তিনি দেখাতে পারেন কী ভাবে শহর গ্রাস করে গ্রাম, স্বার্থপরতা হত্যা করে সারল্যকে, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ন্যূনতম নিরাপত্তার অভাবে কেমন করে উদ্দেশ্যহীন ভেসে চলে বেঁচে থাকার আকুলতা, দারিদ্র ও বিবেকহীনতা কী ভাবে খুন করে নিষ্পাপ শিশুদের।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছর পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে বহু অস্থিরতার সাক্ষী তিনি। অনিবার্য ভাবেই তাঁর লেখায় প্রবেশ করেছে সে সব। কালের দলিল রচনার মতো দেখিয়েছেন শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে আকস্মিক দহন— যখন হত্যা ও প্রতিহত্যার মধ্যে দিয়ে তরুণ সমাজ স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। মর্মস্পর্শী সে সব রচনা অনুভবে আচ্ছন্ন করে পাঠককে। ভাবায়।
তাঁর বর্ণনায় চিত্ররূপময়তা আকর্ষণ করেছে চলচ্চিত্রকারদের, তৈরি হয়েছে অনেকগুলি ছবি। বহু সম্মান ও পুরস্কার, খ্যাতি তাঁকে জনমান্য করেছে, কিন্তু তাঁর অনন্য সাহিত্যবৈশিষ্ট্য, নিরলঙ্কার ভাষা বেছে নেওয়ার মতোই, সাহিত্যজীবনেও অপূর্ব সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কলমের কালি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর লিখবেন না। উস্কে দিয়েছেন বিতর্ক, লেখকের কি অবসর নেওয়া উচিত নয়? বহু বছর পর দেশ পত্রিকায় হারানো খাতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়, সেই অসামান্য ব্যক্তিগত কথন পাঠক যেমন উপভোগ করেছেন, তেমনই দুঃখও পেয়েছেন রমাপদ চৌধুরীর অবসৃত কলমের জন্য।
ছিলেন সুখ্যাত সম্পাদকও। নিয়মনিষ্ঠ, আপাতকঠিন সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীর ভিতরে অনুজ সাহিত্যিকের প্রতি নীরব স্নেহধারাও ছিল, অনেকেই তার স্বাদ পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ধূমপান তাঁর প্রিয়, বেহিসাবি সিগারেট খেতেন। পছন্দ করতেন সূর্য সেন স্ট্রিটে কালিকার চপ-কাটলেট। পেটে সইবে কি না, অম্বল হবে কি না ভেবে কাতর হতে তেমন দেখা যেত না তাঁকে। শান্ত, মিতবাক এই লেখকের মধ্যে এক বেপরোয়া ধরন ছিল। লেখার ক্ষেত্রে যে সংযম তিনি দেখিয়েছেন, তাও কি ওই পরোয়াহীন নির্দ্বিধচিত্ততারই প্রকাশ নয়?
দীর্ঘায়ু তিনি, ছিয়ানব্বই বছর বয়সে প্রয়াত। আর চারটি বছর জীবিত থাকলে শতবর্ষী সাহিত্যিকের আশীর্বাদ পাঠককে ধন্য করত। পাঠক যাঁকে হৃদয়াসনে রাখেন, তাঁর রচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও সেখানে চিরায়ু, এ-ই সান্ত্বনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy