Advertisement
E-Paper

কেন্দ্রের জল, রাজ্যের জল

২০০৫ সালে ভারতে এনআরইজিএ পাশ হলে তা রূপায়ণের দায়িত্ব বর্তায় রাজ্য সরকারগুলির উপর। জল সংরক্ষণ ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।

An image of water body

ভারতে চব্বিশ লক্ষেরও বেশি জলাশয় রয়েছে, তার মধ্যে সাড়ে সাত লক্ষই (৩১ শতাংশ) পশ্চিমবঙ্গে। ফাইল ছবি।

দিব্যেন্দু সরকার

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৩ ০৪:৩৩
Share
Save

জলবায়ুর পরিবর্তন যখন জলশূন্য পৃথিবীর দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, তখন সরকারের কিছু হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য জল সংরক্ষণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আফসোস জাগাচ্ছে কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রক প্রকাশিত দেশের প্রথম জলাশয় গণনার তথ্য (ওয়াটারবডি সেন্সাস)। দেখা যাচ্ছে, ভারতে চব্বিশ লক্ষেরও বেশি জলাশয় রয়েছে, তার মধ্যে সাড়ে সাত লক্ষই (৩১ শতাংশ) পশ্চিমবঙ্গে। সমীক্ষার তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে রাজ্যের প্রায় ২ লক্ষ ২৭ হাজার জলাশয়ের সংস্কার করা গিয়েছিল, কিন্তু তার পর থেকে সে কাজ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। এর কারণ কী? এটা ঘটেছে কেন্দ্রীয় সরকারের এক অদ্ভুত সিদ্ধান্তে। মালিকানার হিসাবে এ রাজ্যের মোট জলাশয়ের ৬১ শতাংশ ছোট পুকুর, যার ৯৬ শতাংশেরই মালিক কোনও ব্যক্তি। ব্যক্তি-মালিকানাধীন পুকুরের জল সংরক্ষণ নিয়েই বেঁধেছে সমস্যা।

২০০৫ সালে ভারতে এনআরইজিএ পাশ হলে তা রূপায়ণের দায়িত্ব বর্তায় রাজ্য সরকারগুলির উপর। জল সংরক্ষণ ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০০৬ সালে রাজ্য সরকার নির্দেশ দেয়, প্রকল্পের অধীনে ব্যক্তিগত পুকুরের সংস্কার করা যাবে, যদি পুকুরের মালিক সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত হল, পুনঃখনন বা সংস্কার করা পুকুরে মাছ চাষ করার জন্য, বা পরিবারের ব্যবহারের জন্য চার ফুট মতো জল রেখে, অতিরিক্ত জল সকলের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে। এই চুক্তির ফলে আশপাশের চাষিরা পুকুরের জল সেচের কাজে ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। মালিকানা যাঁরই হোক, গ্রামে যে কোনও পুকুর খনন করলে, বা পুকুরের জল ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে পারলে, তা থেকে গোটা গ্রামেরই বহুমুখী সুবিধা মেলে। ভূগর্ভের জলস্তর বাড়ে, মাছচাষ করা যায়। অনেকেই ‘মিশ্র চাষ পদ্ধতি’কে কাজে লাগিয়ে মাছ চাষের সঙ্গে হাঁস-মুরগি পালন, পুকুরপাড়ে আনাজ চাষ, পুকুরের জলে সেচ করে পাশের জমিতে শস্য চাষ করে থাকেন। এ রাজ্যে অনেকেই এমন সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন।

সমস্যা হল কিছু মানুষের অতিরিক্ত লোভ, আর তার প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের অনমনীয় মনোভাব। অভিযোগ উঠল, সংস্কারের নামে নামমাত্র কাজ করিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করছেন পুকুর রূপায়ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল কোনও এক জেলায় পরিদর্শনে এসে চিহ্নিত করে এমন কয়েকটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প। ফলে জারি হল কেন্দ্রীয় ফরমান, ব্যক্তিগত জমিতে পুকুর খনন করা যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত পুকুর মজে গিয়ে থাকলে পুনরায় খনন করা, বা সংস্কারের কাজ করা যাবে না। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের তরফে সওয়াল করা হয়, কিন্তু কেন্দ্র কান দেয়নি, বরং রাজ্যকে বাধ্য করেছিল ২০১৪ সাল থেকে ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কারের জন্য খরচ করা প্রায় ১২০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় তহবিল ফিরিয়ে দিতে।

এই কঠোর পদক্ষেপের ফল কী হল? সেচের কাজে ভূপৃষ্ঠের জলের ব্যবহার কমল, আরও বেশি করে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করতে কৃষকরা বাধ্য হলেন। কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল বোর্ড (সিজিডব্লিউবি) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে একটিমাত্র ব্লক ছিল ‘ক্রিটিক্যাল’ (হুগলি জেলার গোঘাট-২)। ২০২২-এর তথ্য, ‘ক্রিটিক্যাল’ ব্লকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে বাইশ। পশ্চিমবঙ্গের ষাটটি ব্লকের ভূগর্ভস্থ জল লবণাক্ত, এই তথ্যও মিলেছে। সব মিলিয়ে, ভূগর্ভস্থ জলের জোগানে সমস্যা আছে, এমন ব্লকের সংখ্যা এখন ১১৩, যা পূর্ববর্তী দু’টি সমীক্ষার চেয়ে ৩৬টি বেশি। কেন্দ্র ও রাজ্যের টানাপড়েনে ক্ষয় হচ্ছে অমূল্য জলসম্পদের।

ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কারকে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বাইরে ঠেলে দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে এ রাজ্যের পুকুর ও ভূগর্ভস্থ জলের, তবে সমস্যাটা একমাত্রিক নয়। ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত তো একশো দিনের কাজের প্রকল্পের অর্থ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত পুকুরের সংস্কার হয়েছে এই রাজ্যে। তাতে সংখ্যার নিরিখে পুকুর সংস্কারের কাজ যতটাই হোক, সেই কাজ জল সংরক্ষণ আর জলসেচের সুযোগ কতটা বাড়িয়েছে, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। কত পরিবারকে কত বেশি দিন কাজ দিয়ে কত বেশি শ্রমদিবস তৈরি করা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় মেতে ছিল রাজ্য। ফলে, কাজের মাধ্যমে কতটা স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হল, তাতে সুস্থায়ী উন্নয়ন কতটা হল, সেই প্রশ্নগুলিকে চর্চার মধ্যে আনাই হয়নি। এমনকি তার পরিমাপের মাপকাঠিও তৈরি হয়নি।

অথচ, এ প্রকল্পকে কাজে লাগানোর সুযোগ একেবারেই ছিল না, এমন নয়। এ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ২০১৭ সাল থেকে রূপায়িত হয়েছে ‘ঊষরমুক্তি’ উদ্যোগ। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের পঞ্চান্নটি ব্লকে প্রায় ষাট হাজার একর রুক্ষ জমিকে দু’ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করা গিয়েছে। একই প্রকল্প, একই রূপায়ণকারী কর্তৃপক্ষ, কিন্তু সহভাগী উদ্যোগে গ্রামের মানুষকে যুক্ত করে ফেলতে পারায়, এবং যথাযথ দেখভাল করায়, সদর্থক পরিবর্তন আনা গিয়েছিল। সরকারি প্রকল্পে বহু অর্থ খরচ হয়, অথচ সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ হয় না কেন, এই মোক্ষম প্রশ্নটা তুলে দিল পশ্চিমবঙ্গের অজস্র মজা পুকুর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

water conservation Ponds State Government Central Government Water crisis National Water Development Agency

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}