দুপুরের ফাগুন তাপ ছড়াচ্ছে মাথার উপর। উসুলডুংরি গ্রাম ছাড়িয়ে এসেছি অনেক ক্ষণ। কে জানে, এলোমেলো পাকদণ্ডী কোথায় গিয়ে মেলাবে! গাড়ির সারথির স্বগতোক্তি ভেসে আসে, “বেরোতে পারব তো এখান থেকে?”
সবে ফুটতে শুরু করেছে পুরুলিয়ার ‘সিগনেচার’ পলাশ। চলেছি অযোধ্যার পূর্ব ঢালে, ধানচাটানি গ্রামে। উসুলডুংরি থেকে গাড়ি চলে যায় উপরের দিকে। আমরা ঘুরলাম বাঁ দিকে। গন্তব্য ধানচাটানি।
প্রকৃতি তার অফুরান সৌন্দর্য যেন দু’হাত উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে এখানে। হাত বাড়ালেই ঘন শালের জঙ্গল। নজরে আসে নীচের উপত্যকা। ক’দিনের মধ্যেই গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে টহলদারি শুরু করবে নিরাপত্তা বাহিনী। ঢল নামবে মেজো-সেজো-ছোট নেতাদের। প্রতিশ্রুতির বান ডাকবে ধানচাটানির গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া হদহদি নদীতে! হতভাগ্য গ্রামে অবশ্য বড় নেতা পা দেন না।
পিচ রাস্তা শেষ হয়েছে আগেই। কংক্রিটের রাস্তা ধরে কালাফুলিয়া-শিমুলবেড়া-কালীঝর্না-টুডুগোড়া-ছতরাজেরা-হেঁডেলগোড়া হয়ে ধানচাটানি। পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। বঞ্চনা ও দারিদ্র আদিবাসী গ্রামগুলির শিল্পবোধকে ঢেকে দিতে পারেনি। গ্রামের তেঁতুলতলায় অনেক মানুষের ভিড়। নির্বাচনী দামামা বাজছে পুরুলিয়াতেও। কিন্তু এই গ্রাম এত নিরুত্তাপ কেন? এই গ্রামের মানুষ কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর বেশি ভরসা করেন না?
মৃদু হাসেন গ্রামের যুবক শম্ভু মুর্মু ও মণিলাল মুর্মু। শম্ভু বলেন, “প্রতি বার তো একই জিনিস দেখি। নেতারা এসে বলেন, ‘এ বার তোমাদের আর চিন্তা নেই। সব হয়ে যাবে। ভোটটা ঠিক করে দিয়ো।’ তার থেকে আপনাকে অন্য একটা কথা বলি।” কী কথা?
প্রায় আশি ঘরের গ্রামের মানুষের রেশন তুলতে যেতে হয় সিঁদুরপুর এবং লিলুডিতে, প্রায় তিন কিলোমিটার। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এই দীর্ঘ পথ তাঁদের নামতে হয় পায়ে হেঁটে। সাইকেল নিয়ে নামাটাও দুষ্কর। তা ছাড়া, সাইকেলে তো আর অত চাল-গম নিয়ে পাহাড়ে ওঠা যায় না।
রেশন তুলে গ্রামের কয়েক জন মিলে গাড়ি ভাড়া করেন। এক গাড়িতে ৩৫-৩৬ ঘরের রেশন উঠতে পারে। আর একটি গাড়ি ভাড়া করা হয় লিলুডি থেকে। চাল, আটা, গম, চিনি, কেরোসিন নিয়ে গাড়িগুলি রওনা দেয় পাহাড়ের পথে। ওই গাড়িতে গ্রামেরই তিন-চার জন চড়ে বসেন। বাকিরা আবার পাহাড়ি পথে হাঁটা শুরু করেন। সিঁদুরপুর ও লিলুডি থেকে কাঁটাডি, বড়উরমা, ঘাটবেড়া, খুন্টাড়, হেঁডেলবেড়া হয়ে গাড়ি পৌঁছয় ধানচাটানি গ্রাম। এই ঘুরপথে দূরত্ব দাঁড়ায় ৪০ কিলোমিটার। তেলের দাম বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়িভাড়াও। এখন গাড়ির ভাড়া পড়ছে প্রায় দু’হাজার টাকা।
গাঁ-গেরামের এই পাঁচালির কি এখানেই শেষ? একদমই নয়!
গ্রীষ্ম আসছে। এখন থেকেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে গাঁয়ের মানুষের। গ্রামে পাঁচটি নলকূপের মধ্যে তিনটিই অকেজো। বাপ-ঠাকুর্দার আমলের কয়েকটি ইঁদারা আছে বটে, কিন্তু সেখানের জলস্তর নেমে যায় এখানকার মানুষের দুর্দশার মতোই গভীরে!
আর তীব্র জলাভাব বলেই গ্রামের মানুষ বর্ষাকাল ছাড়া বছরে এক বারের বেশি চাষ করতে পারেন না। সেচের জলের কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেই। এত বছরেও সেচের জলের সুরাহা করা যায়নি।
তবে দীর্ঘ কাল এই ধানচাটানি গ্রাম পুলিশ-প্রশাসনের নজরে ছিল। কারণ, এর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের জন্য এই অঞ্চলে এক সময় মাওবাদীদের প্রবল আনাগোনা ছিল। জঙ্গলমহলে যখন মাওবাদী আন্দোলন ও তৎপরতা তুঙ্গে, সে সময় প্রায়শই ওই দলের কর্মীরা এই অঞ্চলে মিটিং করতে ও আশ্রয় নিতে আসতেন। পুলিশও এই গোটা তল্লাটে পা রাখতে ভরসা পেত না। পাহাড়ের মাথা থেকে গাড়ি বা মানুষের আনাগোনা নজরে রাখতেন মাওবাদীরা।
গ্রামের মানুষ জানিয়েছেন, মিটিং করতে গ্রামে এলে তাঁরা গোটা স্কোয়াডের জন্য মাংস-ভাত রান্না করতে বলতেন। এ জন্য টাকাপয়সা দিতেন তাঁরা? এক প্রবীণের মন্তব্য: “কী যে বলেন! কোনও প্রশ্নই ওঠে না।” এখানেই শেষ নয়। গ্রামের কোনও যুবক পুলিশে চাকরির ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলেও তাঁদের হুমকির মুখে পড়তে হত। সংশ্লিষ্ট যুবককে বলা হত, “এই চাকরি করবি না। পুলিশে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেলেও তোর পরিবার বাঁচবে না। ওদের শেষ করে দেব।” বলা বাহুল্য, সে সময়ে এমন ঝুঁকি নেওয়ার অবস্থায় কেউই ছিলেন না।
তা হলে কি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির মতো গ্রামবাসীদের সঙ্গে মাওবাদীদের সম্পর্ক ছিল দাতা ও গ্রহীতার মতো? এক যুবকের কথায়: “বলতে পারেন। কারণ, ওরা বলত, ওদের সঙ্গে থাকলে ওরাই আমাদের বাঁচাবে! এ কথা তো অন্য দলের নেতা-কর্মীরাও বলে!” পাশ থেকে আর এক জন বলেন, “ওরা আমাদের পুলিশে চাকরি করতে দেয়নি। অথচ, ওদের অনেকেই পরে আত্মসমর্পণ করে দিব্যি হোমগার্ডের চাকরি করছে! মাঝখান থেকে না খেয়ে আছি আমরা!”
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রাজপুতিতে। দূরত্ব ১৩ কিমি। অভিযোগ, সেখানে ডাক্তার থাকেন না। শুধু শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ফলে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় রোগীকে। গাড়িভাড়া একপিঠ আড়াই হাজার টাকা। বড় হতাশ শোনায় রাজীবলোচনের গলা, “তা না হলে মুদালিতে ফোন করি। ওখানে একটাই অ্যাম্বুল্যান্স আছে। কিন্তু ওরা বলে আগে পাহাড়গোড়ায় রোগী নামাও, তার পরে নেব। ...আমাদের কেউ আসলে মানুষ বলে গণ্য করে না... গ্রাহ্যই করে না আমাদের।” কিন্তু তাঁর, তাঁদের কথা শুনবে কে?
‘দুয়ারে সরকার’ এসেছিল চার দফায়, মুদালিতে, এখান থেকে ১৩-১৪ কিলোমিটার। সেখানে গিয়ে লোকজন ‘কাগজ’ জমা করে এসেছে। কিন্তু এখনও অনেক সরকারি প্রকল্পের সুফল তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি।
সূর্য ঢলছে অযোধ্যার গা বেয়ে। সিল্যুয়েট হয়ে যাচ্ছে শাল-পলাশ-পিয়ালের গভীর অরণ্য। ঝাপসা হচ্ছে ধানচাটানির মুখ... গণতন্ত্রের মুখ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy