ছত্রভঙ্গ: বিজেপির নবান্ন অভিযান ঠেকাতে জলকামান ব্যবহার করছে পুলিশ। ১৩ সেপ্টেম্বর, হাওড়া। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বিজেপির নবান্ন অভিযান থেকে আপাতত দু’টি প্রাপ্তি। এক, রাজনীতিকে (তা সে যেমন ধারাই হোক) পিছনে ঠেলে ব্যক্তিগত চরিত্রহননের কাদা ছোড়াছুড়ি। দুই, অসংযত এবং প্রগল্ভ কিছু আস্ফালন। রাজনীতির শিক্ষার্থীমাত্রেই জানেন, এই ধরনের আন্দোলনের কতকগুলি উদ্দেশ্য থাকে। যেমন, জনসমক্ষে নিজেদের শক্তি দেখানো, পুলিশ-প্রশাসনকে যত দূর সম্ভব চাপে ফেলা, দলের ভিতরকার কোনও টানাপড়েন থাকলে তা ঢাকা দিয়ে নেতৃত্বের একটি সঙ্ঘবদ্ধ চেহারা তুলে ধরা, সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে মাঠে নামানো, সর্বোপরি মানুষের ‘মন’ বুঝে সংযোগের সূত্র তৈরির চেষ্টা করা।
বিরোধী যে দল যখনই কোনও বড় প্রতিরোধী কর্মসূচি নিয়েছে, সেখানে কম-বেশি ওই লক্ষণগুলি সামনে এসেছে। আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাঁর সমালোচকেরাও মানেন, বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতার এক-একটি আন্দোলন এক-একটি অধ্যায় রচনা করেছে। এই রকম নানা আন্দোলনের মাধ্যমে কেউ অনেকটা এগিয়ে আসতে পারেন। কেউ ততটা পারেন না। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
সে দিনের অভিযান থেকে বাংলার বিজেপি সত্যিই কতটা ‘লাভবান’ হল, দলের ‘সুসংগঠিত’ চেহারা তুলে ধরা গেল কি না, সাধারণ মানুষের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হল, সে সব বিষয়ে আলোচনার অবকাশ অবশ্যই আছে। তবে তার আগে বোঝা জরুরি, কতটা নীচে নামলে তবে ‘নেতা’ হওয়া যায়? রাজনীতিতে শালীনতার ‘সীমা’ বলে আর কিছু বাকি থাকছে কি? এই মুহূর্তে রাজ্যের শাসক এবং প্রধান বিরোধী উভয়েরই এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
নবান্ন অভিযানের সময় তাঁকে আটকাতে আসা মহিলা পুলিশকে শুভেন্দু বলেছিলেন, “ডোন্ট টাচ মাই বডি। আই অ্যাম মেল।” দাবি করেছিলেন, ‘জেন্টস’ পুলিশ আনার। মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশদের কিছু বিধিনিষেধ আছে। পুরুষদের বেলায় তেমন আছে বলে শোনা যায় না। হয়তো তাই শুভেন্দুর ওই মন্তব্য রসিকতার খোরাক হয়েছে।
কিন্তু বিষয়টিকে জঘন্য মোড়কে রাজনীতির মূল মঞ্চে টেনে আনার পিছনে কার কী স্বার্থ থাকতে পারে, তা বোধের অগম্য। আইন বা সামাজিক শৃঙ্খলাকে ব্যাহত না করে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে কে কী ভাবে ‘ব্যক্তিগত’ জীবনযাপন করবেন, সেটা যার যার নিজস্ব অভিরুচি। কী খাবেন, কী পরবেন-এর মতো এটাও ব্যক্তিস্বাধীনতা।
রাজ্যের শাসক তৃণমূল তা মানেনি। বিধানসভায় পোস্টার-মিছিল থেকে শুরু করে সাংবাদিক সম্মেলনে রঙ্গ-তামাশা পর্যন্ত নানা ভাবে এক জনকে ‘সমকামী’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার কু-চেষ্টা করা হয়েছে। যা সুস্থ রুচির পরিপন্থী। এই কাজ কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না।
ইটের বদলে পাটকেল ছুড়ে বিজেপি যা শুরু করেছে, তা-ও অত্যন্ত গর্হিত। সেখানে আবার খোদ মমতা এবং অভিষেকের নাম জড়িয়ে চলছে ন্যক্কারজনক কুৎসা প্রচার। শুভেন্দু নিজে তো বলছেন বটেই, বিজেপির লোকজনদের দ্বারা সমাজমাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কিছু নোংরা আবর্জনা। তৃণমূল এই কুৎসার প্রতিবাদ করছে, সেটা সঙ্গত। তবে তাদের অবিমৃশ্যকারিতাই যে এ-হেন পাঁক-পলিটিক্সের উৎস, তাতে সন্দেহ নেই। বিষয়টি যে স্তরে নেমে এসেছে, তাতে ‘রাজনীতি’ শব্দটিই ক্রমশ ঘৃণার উচ্চারণ হয়ে উঠবে।
একই ভাবে সরকার-বিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশ কপাল নিশানা করে গুলি চালাবে, এটা ভাবাও কাম্য নয়। বলা তো দূরের কথা! অথচ তেমনই ধারণা ব্যক্ত করে আর এক বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন অভিষেক। তাঁর বয়স কম। তারুণ্যের আবেগ বেশি। পথে নেমে লাঠি-গুলির মোকাবিলা করে আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও তেমন নেই। কিন্তু বাড়িতে যাঁকে দেখে তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ, এক সময়ের ‘অগ্নিকন্যা’ সেই মমতা নিশ্চয় বুঝবেন, কপালের মাঝখানে গুলি করতে চাওয়ার মানসিকতা রাজনীতিতে কী নিদারুণ ও সুদূরপ্রসারী সঙ্কেত বহন করে! ভুললে চলবে না যে, অভিষেক এখন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন দৃষ্টান্ত অবশ্য বেনজির বলা যাবে না। সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত এক বার পুলিশকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বন্দুকের নলে কি গর্ভনিরোধক লাগানো আছে যে, গুলিতে লোক মরে না? হাল আমলে ভোটের ডিউটিতে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনী যাতে (তৃণমূলের) বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়, সেই মারণমুখী আহ্বান শোনা গিয়েছিল বিজেপির দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুদের মুখে।
এই ধরনের অসংযত বক্তব্যের সামাজিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হতে পারে না। উপরতলার নেতারা বললে নীচের তলাতেও তার প্রভাব পড়ে। সেটা আরও মারাত্মক। কিন্তু নির্মম পরিহাস হল, যাঁরা এ সব বলেন, তাঁরা পরিণামের কথা ভাবেন বলে মনে হয় না। তাই ‘ভুল’ করলেও ‘ভুল’ স্বীকারের অভ্যাস এঁদের কারও নেই।
পরিশেষে বিজেপির অভিযান প্রসঙ্গ। জানা যাচ্ছে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য দলের ‘নবান্ন অভিযান’ নিয়ে ‘গর্বিত’। দাদারা ছোট ভাইদের পিঠ চাপড়াবেন, এতে আশ্চর্য কী! তবে তা করতে গিয়ে ভাবের ঘরে চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না।
এ কথা ঠিক যে, রাস্তার আন্দোলন সর্বদা ব্যাকরণ মেনে হয় না। শাসকেরা চেয়ারে বসে এক রকম বলেন এবং করেন। বিরোধী হয়ে গেলে তাঁদের আন্দোলনের ভাষা বদলে যায়। তাই কে ক’টা বাস ভাঙল, ক’টি পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো হল, পুলিশ কেন লাঠি চালাল বা বিক্ষোভকারীরা কেন পাথর ছুড়ল, তার নিরিখে তরজা চলতে পারে। সাফল্যের মূল্যায়ন করা চলে না। সেখানে দেখতে হবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি কী ভাবে কতটা দাগ কাটছে এবং আন্দোলনকারী দল রাজনৈতিক ভাবে তার রেশ কী ভাবে ধরে রাখতে পারছে।
এ ক্ষেত্রে বিজেপির নেতারা যা-ই বলুন, পথে-ঘাটে নবান্ন অভিযান নিয়ে মানুষের কোনও প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। অথচ সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন দুর্নীতির অভিযোগ আছে। নেতা-মন্ত্রীদের গায়ে কলঙ্কের কালি ছিটছে রোজ। জনগণও ওয়াকিবহাল। কিন্তু, লাভ হল কী?
আলোচনা যেটুকু যা হচ্ছে, তা শুধু ‘ডোন্ট টাচ মাই বডি’-কে ঘিরে। আন্দোলন যদি সত্যিই তেমন মাত্রা পেত, তা হলে ওই সব চুটকি খড়কুটোর মতো ভেসে যেত। শাসক তৃণমূল নাস্তানাবুদ হয়ে অন্য কোনও লঘু চর্চার সুযোগই পেত না!
প্রয়াত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক বার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “কেউ ট্রাম-বাসে আগুন দিতে চাইলে প্রতিবাদী মানুষ সেই সময় দেশলাই এগিয়ে দিত!” কথাটি প্রতীকী হলেও অর্থ পরিষ্কার। যে আন্দোলন মানুষকে স্পর্শ করে, তার চেহারা-চরিত্র স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। আর আন্দোলনকে সেই স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেতৃত্বের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেও মমতার দৃষ্টান্ত এসে পড়ে।
বিজেপির দিলীপ ঘোষ কেন সে দিন হাওড়া ব্রিজে উঠেই পুলিশের জলকামানের সামনে আন্দোলনে ইতি ঘোষণা করে দিলেন, শুভেন্দু কেন কলকাতা থেকে দ্বিতীয় সেতুতে ওঠার সময়েই ‘বডি’ বিতর্কে জড়িয়ে গ্রেফতার হয়ে গেলেন, সে সব প্রসঙ্গ থাক। আন্দোলনের রেশটাও যদি বিজেপি ঠিক মতো ধরে রাখতে পারত, তা হলে পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে পর দিন বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাবে বিরোধী বেঞ্চ গমগম করত। পাশেই লালবাজারে যুব-বিজেপির বিক্ষোভ জমজমাট হত। হয়নি। রাজ্য নেতারা বরং তাকিয়ে আছেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টের দিকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দরবার করারও পরিকল্পনা চলছে।
ধরে নেওয়া যায়, এ সব জেনেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্যদলের নবান্ন অভিযানে ‘সন্তুষ্ট ও গর্বিত’ হয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy